ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মারিও

আলবের্তো মোরাভিয়া অনুবাদ : অমল সাহা

বিশেষ আয়োজন
🕐 ২:৫০ অপরাহ্ণ, মে ১১, ২০২১

মারিও

তেরোবার নোবেল মনোনয়নপ্রাপ্ত ইতালিয়ান বিশ্ববিখ্যাত লেখক আলবের্তো মোরাভিয়ার পোশাকী নাম আলবের্তো পিনশার্লে। লেখক নাম আলবের্তো মোরাভিয়া। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক। ১৯২৯ সালে একুশ বছর বয়সে প্রথম উপন্যাস লিখেই সমস্ত ইউরোপে ইতিহাস গড়ে ফেলেন। এটিই ছিল ইউরোপের প্রথম অস্তিত্ববাদী উপন্যাস। বহু কারণের জন্য মোরাভিয়াকে ইউরোপের অস্তিত্ববাদী সাহিত্যের জন্মদাতা বলা হয়। ভিত্তোরিও দি সিকো পরিচালিত ও সোফিরা লোরেন অভিনীত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর বিশ্ব বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘টু ওমেন’ মোরাভিয়ার উপন্যাস ‘লা সিইওসাইয়ারা’ বা ‘দি ওমেন ফ্রম সিইওসাইয়ারা’ অবলম্বনে নির্মিত হয়। ১৯০৭ সালে ২৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বিরাশি বছর বয়সে ১৯৯০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রোমে মারা যান। রোমের কেম্পো ভেরানোতে তাকে সমাহিত করা হয়।

এ ঘটনা এভাবেই ঘটেছিল। আমি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলাম। আমার বউ ফিলোমেনা তখনও ঘুমাচ্ছিল। আমি আমার যন্ত্রপাতির ব্যাগটা নিলাম। এরপর খুব সন্তর্পণে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। ভিয়া গ্রামসির মন্টি পেরিওলিতে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা ব্রয়লার ফুটো হয়ে গিয়েছিল। সেটা আমাকে মেরামত করতে হবে। সেটা মেরামত করতে কতটা সময় আমার লাগতে পারে? নিশ্চিত, দু’ঘণ্টা তো বটেই। আমাকে পাইপটা নিতে হবে তারপর ঠিক করে ফিরিয়ে নিয়ে লাগাতে হবে। কাজটা শেষ করে আমি বাস এবং ট্রাম চড়ে আবার ভিয়া দেই কেরোনারিতে ফিরে আসব। এখানেই আমার বাসা এবং দোকান। এবার সময়ের একটা হিসাব করা যাক, দু’ঘণ্টা যাবে মন্টি পেরিওলিতে, সেখানে যেতে লাগবে আধা ঘণ্টা, আসতে লাগবে আধা ঘণ্টা, সব মিলিয়ে তিন ঘণ্টা। তিন ঘণ্টা আর এমনকি সময়? কাজের পরিমাণ অনুযায়ী হয়তো একটু কম বা বেশি। আমি মেরামতির কাজের জন্য তিন ঘণ্টা সময় নিয়েছিলাম; যদি অন্য কেউ হতো...।

আসুন, এবার ঘটনাগুলো যেভাবে ঘটেছিল সেভাবে দেখা যাক। আমি ভিয়া দেই কেরোনারিতে ফিরে আসার সময় দেয়ালের নিচের রাস্তাটা দিয়ে একা দ্রুত হাঁটছিলাম। হঠাৎ শুনলাম কেউ যেন আমাকে নাম ধরে ডাকছে। ঘুরে দাঁড়ালাম, দেখি ফেডি, একটা বাড়ির কেয়ারটেকার যে নাকি আমাদের বাসার বিপরীত দিকে থাকে। এই ফেডি, একটা গরিব মানুষ। ওর পা দুটো বাতে এমন ফুলে গিয়েছে, দেখতে এখন হাতির পায়ের মতো লাগছে। সে ঠিকমতো শ্বাসও নিতে পারছে না। আমাকে বলল, ‘আইজ কি গরম আর ধুলাবালির বাতাস বইতাছে... তুমি তো বাপু ওদিকেই যাইবা, আমার এই বাজারের ব্যাগটা এট্টু ধরবানি...?
বুড়িকে বললাম, ‘অবশ্যই... আমি এটা হাসিমুখেই নেব।’ এরপর যন্ত্রপাতির ব্যাগটা আমার এক কাঁধ থেকে আরেক কাঁধে নিয়ে ফেডির ব্যাগটা হাতে তুলে নিলাম। ফেডি তার লম্বা ঢিলা হড়বড়ে কোটের নিচে ফোলা থামের মতো পা নিয়ে আমার পাশে থপথপ করে হাঁটতে লাগল। একটু পর সে জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়ে, তোমার বউ ফিলোমেনা কই?’
‘বাসায়। আর কোথায় থাকবে?’
‘হুম। তাই তো বাসায় থাকন উচিত অবশ্যই।’ বুড়ি মাথা নিচু করে বলল।
‘কেন অবশ্যই? উত্তরে বললাম, এই শুধু কিছু বলার জন্য বলা।
‘অবশ্যই... আহা রে, আমার সোনার ছাওয়ালটা।’ সে বলল।
আমার মনে খটকা লাগতে শুরু করল। এক মুহূর্ত চুপ থাকলাম এরপর আমি বুড়ির কাছে জানতে চাইলাম, ‘কেন আহা রে শব্দটা বললেন? মানে কী?’
‘কারণ তোমার জইন্য আমার দুঃখ হইতাছে।’ ওই কুৎসিত বুড়িটা আমার দিকে না তাকিয়েই বলল।
‘আপনি কী বলতে চাইছেন?’
‘কী আর কমু রে বাপু, সেই সময় আর নাই... আমাগো কালের মতো আর এহনকার মাইয়া লোক নাই।’
‘কেন?’
‘আমাগো সময়ে বেডারা নিশ্চিত মনে বাড়িতে তাগোর বউ পরিবার রাইখা কাম কাইজে যাইত... যেমনটা রাইখ্যা যাইত... আইস্যা তেমনটাই দেখত। কিন্তু এহন?’
‘এখনকার দিনে কী? কী?’
‘এহনকার দিনে আর আগেকার মতো না। ঠিক আছে... ঠিক আছে... আমার ব্যাগটা দেও। তোমারে অনেক শুকরিয়া।’
এই সুন্দর সকাল আমার মাটি হয়ে গেল। উল্টা আমার মনটা বিষে জর্জরিত হয়ে গেল। বুড়ির ব্যাগটা পিছনে সরিয়ে নিয়ে বললাম, ‘আপনি যদি আমাকে সবটা খুলে না বলেন তাহলে ব্যাগটা দেব না। ফিলোমেনা এসবের মধ্যে এলো কী করে?’
‘আমি এইসবের কিছুই জানি না বাপু,’ সে বলল, ‘কিন্তুক আগে থেকে সাবধান মানে আগে থেকে কিছু অস্ত্রপাতি লইয়া রাখন আরকি।’
‘কিন্তু আপনি বলেন,’ আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘ফিলোমেনা কী করেছে?’
‘আডালজিসাকে জিজ্ঞেস কইরো।’ সে বলল। এরপর সে ব্যাগটা ছোঁ মেরে নিয়ে তার ঢোলা কোট নিয়ে দ্রুত পা ফেলে বলতে গেলে দৌড়ে চলে গেল। ভাবতেও পারিনি বুড়ি হঠাৎ করেই এমনটা করবে।
সিদ্ধান্ত নিলাম এমন পরিস্থিতিতে দোকানে যাওয়া নিরর্থক। এরপর ফিরে চললাম আডালজিসার খোঁজে। ভাগ্য ভালো, সে ভিয়া ডি করোনারিতেই থাকত। আমি ফিলোমেনাকে বিয়ে করার আগে আডালজিসার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। আডালজিসা তখনও আইবুড়ি ছিল, ওর বিয়ে হয়নি। আমার সন্দেহ হলো, এই আডালজিসাই কোনো কাহিনি ফিলোমেনার নামে ছড়িয়েছে। দৌড়ে আডালজিসার বাসার চারতলায় উঠলাম এবং হাতের মুঠো দিয়ে ধুমধাম করে ওর দরজায় আঘাত করতে লাগলাম। আমি ওকে ঘুষি মেরেই বসতাম আরেকটু হলে, কারণ সে দরজাটা হঠাৎ করেই খুলেছিল। তার গায়ের জামাটা গোটানো ছিল আর হাতে ছিল একটা ঝাড়–। সে স্পষ্ট করে দ্রুত জিজ্ঞেস করল, ‘জিনো, তুমি কী চাও?’
আডালজিসা একটা ছোটখাটো মেয়ে। আকর্ষণীয়। কিন্তু ওর মাথাটা একটু বড় আর চিবুকটাও একটু বড়সড়ই। তার এই চিবুকের জন্য তাকে অনেকে স্পেডের রাণী বা ইসকাপনের বিবি বলে। এটা অবশ্যই তার মুখের ওপর বলে না। কিন্তুওর ওপর সেই মুহূর্তে এমন ক্ষুব্ধ ছিলাম, আমি বললাম, ‘তুমি, তুমি সেই ইসকাপনের বিবি, তুমি সেই কাহিনি ছড়াচ্ছ ফিলোমেনার সম্বন্ধে, আমি যখন বাসায় থাকি না তখন সে এমন কোনো কিছু করে যা অসামাজিক, যা তার করা উচিত না? তুমিই ছড়িয়েছ?’
রাগে জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল সে, ‘এটা তো সেই ফিলোমেনা যাকে তুমি চেয়েছিলে, তাকে পেয়েছ।’
আমি ভিতরে ঢুকলাম এবং তার হাত চেপে ধরলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ছেড়েও দিলাম। তার চোখে অন্যরকম একটা আশা জাগিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছে।
‘তাহলে এটা তুমি?’ আমি বললাম।
‘না আমি না... আমি শুধু যা শুনেছি তা আরেকজনকে বলেছি।’
‘কার কাছে শুনেছ?
‘গিয়ান্নিনা।’
আমি আর ওকে কিছু না বলে যাওয়ার জন্য ফিরলাম। কিন্তু সে আমাকে পিছন থেকে টেনে ধরল এবং কামনামদির চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে ইসকাপনের বিবি বলে ডেকে চলে যেও না।’
‘কেন বলব না? তোমার চিবুকটা কি দেখতে ইসকাপনের বিবির মতো না?’ উত্তর দিয়ে নিজেকে মুক্ত করলাম এবং দৌড়ে আবার সিঁড়িতে নামলাম।
‘এক জোড়া শিংয়ের চাইতে ইসকাপনের বিবির চোয়াল ভালো।’ রেলিংয়ে নুয়ে সে আমার পিছনে চিৎকার করে বলল।
এখন খারাপ লাগতে শুরু করেছে। এটা আমার মনে হচ্ছিল না যে, ফিলোমেনার দ্বারা আমাকে এ ধরনের প্রতারণা করা সম্ভব। আমাদের তিন বছরের বিবাহিত জীবনে সে সব রকমের আদর-যতœ আমাকে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু ঈর্ষা এমন একটা সাংঘাতিক জিনিস! সেসব ভালোবাসা স্নেহের চিহ্ন এখন ফেডি এবং আডালজিসার কথার আলোকে আমার কাছে প্রতারণার চিহ্ন বলে মনে হতে লাগল। ঠিক আছে, দেখা যাক...।
গিয়ান্নিনা একই রাস্তায় কাছেই একটা পানশালায় ক্যাশিয়ার হিসাবে কাজ করত। গিয়ান্নিনা ছিল সোনালি মসৃণ চুল এবং চায়না ব্লু চোখের মেয়ে। ও ছিল শান্ত, স্থির এবং ভাবুক টাইপের মেয়ে। আমি ওই পানশালায় গিয়ে গিয়ান্নিনা যে ডেস্কে কাজ করে সেখানে গিয়ে ওকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা তুমি কি এই গল্পটা আবিষ্কার করেছ, আমি যখন থাকি না তখন ফিলোমেনা অন্য লোকজন বাসায় এনে আপ্যায়ন করে?’
সে একজন খদ্দেরকে সামলাচ্ছিল। ক্যাশ মেশিনের বোতাম টিপে একটা টিকিট বের করে গলার স্বর না উঠিয়েই আরেকজনকে বলল, ‘দুই কাপ কফি...’ এবং এরপর শান্তভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘জিনো, তুমি যেন আমাকে কী বলছিলে?’
আবার প্রশ্নটা ওকে বললাম। সে খুচরো টাকা খদ্দেরকে ফেরত দিয়ে বলল, ‘সত্যি জিনো, তুমি কী করে ভাবলে আমি ফিলোমেনার সম্বন্ধে এমন একটা গল্প বানাব? তুমি জানো ফিলোমিনা আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী।’
‘তাহলে আডালজিসা এটা স্বপ্নে পেয়েছে!’
‘না,’ গিয়ান্নিনা আমাকে শুধরে দিল, ‘না... সে এটা স্বপ্নে পায়নি... আমিও এটা তৈরি করিনি; শুধু আরেকজনকে বলেছিলাম।’
‘বা কী দয়ালু বন্ধু।’ চিল্লিয়ে না উঠে পারলাম না।
‘কিন্তু এটাও বলেছি, আমি কথাটা বিশ্বাস করিনি... আডালজিসা নিশ্চয়ই এটা তোমাকে বলেনি।’ গিয়ান্নিনা বলে।
‘ঠিক আছে, তাহলে কে এটা তোমাকে বলেছে?’
‘ভিসেনজিনা... ও শুধু এই কথাটা বলার জন্যই লন্ড্রি থেকে আমার কাছে এসেছিল।’ গিয়ান্নিনা জানায়।
একথা শোনার পর আমি গিয়ান্নিনাকে যাই বা অন্য কিছু না বলে দৌড়ে ওর পানশালা থেকে বেরিয়ে গেলাম। একদম সোজা ভিসেনজিনার লন্ড্রিতে। ভিসেনজিনাকে রাস্তা থেকে দেখতে পেলাম একটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ইস্ত্রি দু’হাত দিয়ে চেপে কোনো কিছু ইস্ত্রি করছে। ভিসেনজিনা ছোটখাটো মেয়ে। বিড়ালের মতো ভোঁতা মুখ। গায়ের রং বেশ গাঢ়। বেশ চটপটে। আমি জানতাম আমার প্রতি ওর একটু দুর্বলতা আছে। আঙুল দিয়ে ইশারা করতেই সে ইস্ত্রিমিস্ত্রি বাদ দিয়ে লন্ড্রি থেকে বের হয়ে চলে এলো। সামনে এসে বেশ আশার সুরেই বলল, ‘জিনো, আহ, তোমাকে দেখতে কি সুন্দর লাগছে!’
‘বেহায়া মেয়ে’, উত্তর দিলাম, ‘তাহলে বলো, এটা সত্য যে তুমি বলে বেড়াচ্ছ আমি যখন দোকানে থাকি তখন ফিলোমেনা পুরুষমানুষ ঘরে ডেকে এনে মাস্তি করে?’
উত্তরে ভিসেনজিনা ওর এপ্রনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে এদিক-ওদিক হেলেদুলে একটু মন খারাপ করেই বলল, ‘তুমি কি রাগ করবে যদি ফিলোমেনা একটু-আধটু করেই থাকে?’
‘কথার উত্তর দাও,’ আমি জিদ ধরলাম, ‘তাহলে তুমিই জঘন্য গল্পটা ফেঁদেছ?’
‘আহ্ তুমি কি হিংসুটে!’ ও নিজের কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, ‘বাব্বা! মেয়েরা তাদের বন্ধুর সঙ্গে একটু গল্প করারও অনুমতি পাবে না?’
‘তাহলে তুমিই...’ আমি আবার বললাম।
‘সত্যি তোমার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে।’ হঠাৎ এই ফাজিল পাজি মেয়েটা আমাকে বলে, ‘তুমি কী করে চিন্তা করো তোমার বউকে নিয়ে ভাবব? আমি ওসব গল্পফল্প তৈরি করিনি... এটা আমি অ্যাগনেসের কাছে শুনেছি। ও-তো ওই পুরুষটার নামও জানে।’
‘তাহলে বলো, ওই ব্যাটার নাম কী?’
‘তারচেয়ে ভালো তুমি অ্যাগনেসের কাছেই যাও... ও-ই তোমাকে বলবে।’
আমি নিশ্চিত যে এখনই হয়তো ফিলোমেনা আমাকে প্রতারণা করছে। এমনকি মানুষটার নামও সবাই জানে! আমার মাথা গরমের জন্য কাঁধের ব্যাগটাকে এখন ওজনহীন মনে হচ্ছে, অথবা আমার মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছে, আমি ফিলোমেনাকে খুনও করতে পারি। এটা বিশ্বাসের মধ্যেই আনতে পারছি না, ফিলোমেনা, আমার বউ, এখন অন্য এক ব্যাটার সঙ্গে...!
অ্যাগনেসদের সিগারেটের দোকানে গেলাম। অ্যাগনেস ওর বাপের দোকানে সিগারেট বিক্রি করে। ওর কাউন্টারে একটা টাকা ছুড়ে দিয়ে বললাম, ‘দুইটা নাজিওনালি দাও।’
অ্যাগনেস সতের বছর বয়সী একটা যুবতী মেয়ে। একঝাঁক বুনো উসকুখুসকো শুকনো চুল ওর মাথার ওপর খাড়া হয়ে আছে। ফোলা ফ্যাকাসে রংহীন মুখ। মুখে মেখেছে মুক্তা রঙের পাউডার। আর চোখ দুটি ছিল যেন লরেল বেরির মতো জাম রঙের। আমি ওকে চিনতাম। ভিয়া ডি করোনারির সবাই ওকে চিনত। এছাড়া ভিয়া ডির সবার মতো আমিও জানতাম মেয়েটার ছিল টাকার প্রতি খুব লোভ। টাকার বিনিময়ে সে নিজের কলিজাটাও বিকিয়ে দিতে পারত। যখন সে একটু কুঁজো হয়ে আমাকে সিগারেট দিচ্ছিল কানের কাছে গিয়ে বললাম, ‘তার নামটা কী?’
‘কার নাম?’ অবাক হয়ে বলল।
‘আমার বউয়ের বয়ফ্রেন্ডের নাম।’
সে আমার দিকে তাকালো যেন সে ভয়ানক ভয় পেয়েছে। আমার মুখে হয়তো তখন একটা কুটিল ভাব ফুটে উঠেছিল। তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমি, আমি এ সম্বন্ধে কিচ্ছু জানি না।’
হাসতে চেষ্টা করলাম, ‘আরে শোনো, আমাকে বলো। এখন সবাই জানে। আমিই একমাত্র বান্দা যে নাকি এটা জানে না।’
সে আমার দিকে তাকাল। মাথা নাড়াল। এরপর আমি বললাম, ‘দেখ যদি তুমি আমাকে নামটা বলো, এই এটা তোমাকে দেব।’ পকেট থেকে এক হাজার লিরার নোটটা বের করলাম, যেটা আজ সকালে ব্রয়লারের পাইপ মেরামত করে দেওয়ার জন্য মজুরি হিসেবে রোজগার করেছিলাম। নোটটা দেখে সে চনমন করে উঠল। মনে হলো আমি যেন ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছি। তার ঠোঁট নড়ে উঠল, চারদিকে তাকাল এরপর নোটের ওপর হাতটা রেখে গলার স্বর নিচু করে বলল, ‘মারিও’।
‘তুমি এ ব্যাপারে কী করে জানলে?
‘আপনি যে বিল্ডিংয়ে থাকেন তার দারোয়ানের কাছ থেকে।’
সুতরাং এটা সত্য। এটা ছিল ‘শীতলতর এবং উষ্ণতর’ খেলার মতো। আমি মনে মনে এর মধ্যেই আমার বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়েছি। এক্ষুনি নিজের ফ্লাটের ভিতরে ঢুকব। সিগারেটের দোকান থেকে দ্রুত বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। বাসাটা আর মাত্র কয়েকটা দরজার পরই। হাঁটতে হাঁটতে নামটা বারবার বলতে লাগলাম, ‘মারিও... মারিও।’ আমি সব মারিওর নাম বলে বলে স্মরণ করতে লাগলাম। চোখের কাছে যারাই পড়েছে। গোয়ালা মারিও, আলমারির মিস্ত্রি মারিও, সবজিঅলা মারিও... আরেক মারিও যে নাকি এক সময় সৈনিক ছিল, এখন বেকার... আরেক মারিও শুয়ার জবাই করার কসাইয়ের ছেলে... মারিও মারিও মারিও... এরকম দশ লাখ মারিও এই রোমে আছে আর নিশ্চিত যে এর একশ’জন মারিও হয়তো এই ভিয়া ডি কেরোনারিতে বাস করে। আমি আমার বিল্ডিংয়ের দরজার কাছে গেলাম। সোজা দারোয়ানের ঘরে গেলাম। এ বুড়িও ফেডির মতো বৃদ্ধ আর মুখে বেশ ঘন গোঁফের উপস্থিতি, দেখলাম বুড়ি পা এবং পাছার মাঝখানে একটা পা গরম করার চুল্লি রেখে পা ছড়িয়ে বসে আছে। কোলের উপর বিছানো চিওরি সালাদ তৈরির পাতা। দরজার ভিতর মাথা গলিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি বলছি শুনুন, আপনি কি এই গল্পটা সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন, আমি যখন বাসায় থাকি না তখন মারিও নামের এক লোককে আমার বউ ফিলোমেনা বাসায় নিয়ে আসে?’
সে বিরক্ত হলো বলে মনে হলো। বুড়ি আমাকে উত্তর দিল, ‘কেউ কোনো গল্প তোমার বউয়ের নামে আবিস্কার করেনি... এটা তোমার বউই আমাকে নিজে বলেছে।’
‘ফিলোমেনা?’
‘হ্যাঁ। সে আমাকে বলেছে, এমন এমন একজন যুবক আমার কাছে আসবে আমাকে দেখতে, তার নাম মারিও, তাকে বলবেন, যদি জিনো বাসায় থাকে, তবে তাকে উপরে উঠতে বারণ করবেন। আর জিনো যদি না থাকে তবে তাকে উপরে পাঠিয়ে দেবেন...’ এরপর বুড়ি বলল, ‘ছেলেটা আসছে, দেখ গিয়ে সে এখন উপরেই আছে।’
‘সে এখন উপরে?’ আমি নিশ্চিত হতে চাইলাম।
‘নিশ্চিত সে উপরেই আছে... প্রায় এক ঘণ্টা আগে উপরে গিয়েছে।’
তাহলে মারিও নামের কেউ শুধু আছেই নয়, সে ফিলেমেনার সঙ্গে ছিল, আছে, ফ্লাটের ভিতরে এবং এক ঘণ্টা ধরে। আমি ধুমধাম করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলাম এবং ঝড়ের বেগে তিনতলায় উঠে দরজায় টোকা দিলাম। ফিলোমেনা এসে দরজা খুলে দিল। তাকে বরাবরের মতোই প্রশান্ত ও স্থির কিন্তু এখন একটা ভয়ের ছায়া চোখে দেখা যাচ্ছিল। রাগে গরগর করতে করতে বললাম, ‘আচ্ছা, আমি যখন বাসায় থাকি না তখন মারিও তোমাকে দেখতে আসে?’
‘কিন্তু এতে কী...’ সে বলতে শুরু করল।
‘আমি সব জানি’ আমি চিৎকার করে উঠলাম। ভিতরের দিকে যেতে চাইলাম। কিন্তু সে পথ আটকালÑ ‘একটু শান্ত হও... কী ব্যাপার তোমার হয়েছে? একটু পর না হয় এসো।’
এরপর আমাকে ঠিক রাখতে পারলাম না। ওর মুখের উপর একটা কষে থাপ্পড় মারলাম এবং চিৎকার করে উঠলাম, ‘তাহলে এই ব্যাপার, না? এটা আমার কাছে কোনো ব্যাপার না, না?’ ফিলোমেনাকে একপাশে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে এরপর দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম।
শয়তান মেয়েদের গল্প নেয়, মেয়েদের শয়তান দলে নেয়! সেখানে সত্যিই মারিও বসেছিল। টেবিলে বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছিল। কিন্তু এটা সেই মারিও নয় যেটা আলমারি বানায়, এটা সেই মারিও নয় যেটা সবজিঅলা, এটা শুয়োর জবাই করে সেই কসাইয়ের ছেলে মারিও নয়। এটা সেগুলোর কোনো মারিওই নয় যেগুলোর চিন্তা করতে করতে এসেছি। এটা স্রেফ ফিলোমেনার ছোটভাই মারিও। আমার শালা। এই চিজ সিঁধ কেটে করার দায়ে দু’বছর জেল খেটেছিল। যেদিন জেল খেটে প্রথম বাইরে বেরিয়েছিল সেদিনই ফিলোমেনাকে আমি বলে দিয়েছিলাম, ‘শুনে রাখো, তোমার এই ভাইকে যেন কোনোদিন আমার বাসায় না দেখি... ওর কথা যেন তোমার মুখে কোনোদিন না শুনি।’
কিন্তু বেচারা বোন, চোর হওয়া সত্ত্বেও ভাইকে খুব ভালোবাসত। তাই ফিলোমেনা ঠিক করেছিল, আমার অনুপস্থিতিতে ওর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবে। মারিও যখন আমাকে রাগান্বিত অবস্থায় দেখতে পেল সে ভয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আমি হাঁফ ছেড়ে বললাম, ‘আরে! মারিও নাকি?’
সে তোতলাতে লাগলো, ‘আমি, আমি চইলা যাইতাছি দুলাভাই। কিচ্ছু মনে করবেন না আমি চইলা যাইতাছি...।’
কী ব্যাপার? যে কেউ দেখে বলবে, আমাকে মনে হয় প্লেগে ধরেছে আর মারিও আমার কাছ থেকে ছুটে পালাতে চাইছে।
শুনতে পেলাম ফিলোমেনা বারান্দায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এখন আমার খুব লজ্জা করতে লাগল। এসব কী করেছি! মারিওকে বললাম, ‘না না, থাকো। অন্তত আজকের দিনটা থাকো। আমাদের সঙ্গে ডিনারটা খাও। ঠিক আছে... ফিলোমেনা ঠিক কিনা? ফিলোমেনা ততক্ষণে চোখে জল নিয়ে দরজার কাছে ফিরে এসেছে। তার দিকে ফিরে বললাম, ‘সব ঠিক আছে তো, মারিও যদি আমাদের সাথে ডিনার করে?’
বিষয়টা সামাল দেওয়ার জন্য যা যা করার দরকার সব করলাম। এরপর বেডরুমে গিয়ে ফিলোমেনাকে ডেকে আনলাম। ফিলোমেনাকে একটা চুমু দিয়ে আবার শান্তি স্থাপন করে ফেললাম। কিন্তু গল্প যা ছড়িয়েছিল সেটার রেশ কিন্তু রয়েই গেছে। একটু ইতস্তত করলাম তারপর মারিওকে ডেকে বললাম, ‘এই মারিও, আমার সঙ্গে ওয়ার্কশপে চলো। আমার বস হয়তো তোমাকে একটা কিছু করার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।’
সে আমাকে অনুসরণ করে বাইরে বেরিয়ে এল। যখন আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম, আমি ওকে বলে দিলাম, ‘তোমাকে এখানে কেউ চেনে না... তুমি গত কয়েক বছর ধরে মিলানে কাজ করতে, বুঝেছ? এটাই বলবে।’
‘ও কে।’ মারিও বলল।
আমরা নিচে নেমে এলাম। হাত ধরে মারিওকে বুড়ির কাছে নিয়ে গেলাম এবং পরিচয় করিয়ে দিলাম, ‘এটা মারিও। আমার শালা, মিলান থেকে এসেছে। এখন থেকে আমাদের সঙ্গে এখানেই থাকবে।’
‘বা, খুব ভালো। আনন্দের খবর...।’
রাস্তায় যেতে যেতে ভাবলাম, ‘আনন্দের সীমা নাই। আনন্দ সবটাই আমার। যত্তসব! এই বেশি কথা বলা গল্প মারা মেয়েমানুষগুলোর জন্য আমি এক হাজার লিরা নষ্ট করলাম আর এই ঝামেলায় পড়ে বাসার মধ্যে একটা চোর ঢোকালাম!

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper