তুমি কাব্য সাধনার ধারাতেই মঙ্গল করেছো
লিটন ঘোষ জয়
🕐 ১২:২০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১১, ২০২১
মাগুরা শ্রীপুর উপজেলার মুজদিয়া গ্রামে গেলেই রাস্তার পাশে দেখা মিলবে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি কাজী কাদের নওয়াজের বাড়ি। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে- ত্রিভুবন, শিক্ষকের মর্যাদা, হারানো টুপিসহ অসংখ্য জনপ্রিয় কবিতার জনক ছান্দসিক কবি কাজী কাদের নওয়াজের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক আবাসস্থল। তার অমর সৃষ্টি তাকে ইতিহাসের নক্ষত্র করে রেখেছে আজীবন। তেমনই প্রকৃতিপ্রেমী, নন্দনতত্ত্ব কবি কাজী কাদের নওয়াজ অমর হয়ে আছেন সাহিত্যকর্মে, সৃষ্টিতে, তার কবিতায়। তাকে নিয়ে লিখেছেন লিটন ঘোষ জয়।
মাগুরা শ্রীপুর উপজেলার মুজদিয়া গ্রামে গেলেই চোখে রাস্তার পাশে দেখা মিলবে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি কাজী কাদের নওয়াজের বাড়ি। তবে বাড়িটিতে এখন আর কেউ বসবাস করেন না। কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে- ত্রিভুবন, শিক্ষকের মর্যাদা, হারানো টুপিসহ অসংখ্য জনপ্রিয় কবিতার জনক ছান্দসিক কবি কাজী কাদের নওয়াজের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক সেই আবাসস্থল। যেখানে বসেই কবি রচনা করেছেন- কালজয়ী সব কবিতা। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এই কবির বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মুজদিয়া গ্রামে। তার জন্ম ১৯০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে মাতুলালয়ে। পিতা আল্লাহ নওয়াজ এবং মাতা ছিলেন ফাতেমুন্নেছা। কবি কাদের নওয়াজের পিতা ও পিতৃব্য উভয়েই ছিলেন জ্ঞানী ও সাহিত্যসেবী। পারিবারিক সাহিত্যমোদী পরিবেশেই বসে কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন কাদের নওয়াজ। চাচা নওয়াজ খোদা বিখ্যাত লেখক ও ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। পিতা আল্লাহ নওয়াজ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বহুভাষী এবং মা ফাতেমুন্নেছার মধ্যেই কবি প্রতিভা লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়াও স্কুল শিক্ষক দ্বিজবাবুর অনুপ্রেরণাও ছিল কাদের নওয়াজের লেখক হওয়ার পাথেয়।
মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মুজদিয়া গ্রামে বসবাসকালীন সময় থেকেই তিনি শ্রীপুরের মহেষচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ পেশার সঙ্গেই জড়িত ছিলেন। তার লেখা কবিতায় ছিল অতুলনীয় উপমা, ছন্দমিল ও নন্দনতত্ব। কবি ছিলেন সুন্দর ও জীবন ঘনিষ্ঠ বাস্তবতার পূজারী। জীবন-নিষ্ঠ ছিল বলেই দেখার চোখ তীক্ষè ও মর্মস্পর্শী। সবল একটা সরলতা আছে, যা কবিতায় প্রাকৃত রস সিঞ্চন করে। কেননা তার কবিতা আজও সময়ের কথা বলে, সম্মান ও শ্রদ্ধার কথা বলে। দেশ, মা, মাটি, মানুষ, ভালোবাসা আর কল্যাণের কথা বলে। কবি কাদের নওয়াজের কবিতা মানেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার, মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা। আর সেজন্যই মা যেন তার কবিতায় ধরা দিয়েছে জগতের শ্রেষ্ঠতর ধন হয়ে। কবি নিজেও ছিলেন শিক্ষক। হয়তো বা শিক্ষকের প্রতি তার সেই অনুরাগ থেকেই কবি লিখেছেন, ‘আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির, সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।’ কবির এই সম্মান যেন গোটা পৃথিবীর শিক্ষক জাতির জন্য সম্মানের তাজ, শ্রদ্ধার দৃষ্টান্ত উদাহরণ। যা বাংলা সাহিত্যে বিরল। আর এভাবেই কবি চির অমর হয়ে বেঁচে আছেন আপামর মানুষের অন্তরে অন্তরে। একজন মানুষের সার্থকতা এখানে তাকে তার সৃষ্টি বাঁচিয়ে রাখে, যুগ থেকে যুগান্তরে। কিন্তু এমন সার্থক মানব জনম সবার হয় না! কিছু কিছু মানুষ তার সৃষ্টি দিয়ে সময়ের ওপর চিহ্ন রেখে যায়। তার এই অমর সৃষ্টি, তাকে ইতিহাসের নক্ষত্র করে রাখে আজীবন। তেমনই প্রকৃতিপ্রেমী, নন্দনতত্ব কবি কাজী কাদের নওয়াজ অমর হয়ে আছেন তার সাহিত্যকর্মে, তার সৃষ্টিতে, তার কবিতায়।
মাগুরার অন্যতম প্রবীণ কবি মিয়া ওয়াহিদ কামাল বাবলু কবি কাজী কাদের নওয়াজ সম্পর্কে তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘কবি কাজী কাদের নওয়াজ একাধারে শিক্ষক, কবি, বহুভাষা-পারদর্শী পণ্ডিত, ঔপন্যাসিক ও অতি সাহসী একজন মাতৃভাষাপ্রেমিক ছিলেন। তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারীও ছিলেন। কবি কাজী কাদের নওয়াজ, শিশু-কিশোর কাব্য ও নীতিকাব্যেই অমরত্ব যার। এই এক অনন্যধারায় তিনি আজও তুলনাহীন। তার কবিতায় মাতৃভক্তি, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা, শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, দেশপ্রেম ও নিঃসর্গ প্রেম সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। ‘মা’ কবিতার মাতৃভক্তির প্রথম দুটো লাইন আজও বাংলার ঘরে ঘরে কাপড়ে রঙিন সুতোয় লিখে বাঁধাই করা অবস্থায় শোভিত দেখা যায়, শিশুশিক্ষার পাঠে দেখা যায়। কথাগুলো হলো-
‘মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই,/ইহার চেয়ে নাম যে মধুর তিন ভুবনে নাই।/সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক, মাথার পরে আজি,/অন্তরে মা থাকুক মম, ঝরুক স্নেহরাজী।’
কবি কাজী কাদের নওয়াজের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অনেক স্মৃতি আছে। জহিরুল ইসলাম জহির, পরিতোষ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুসসহ আমাদের আরও বেশ কয়েকজন কবি বন্ধুদেরকে সঙ্গে নিয়ে তার বাসভবনে একাধিকবার তিনি কবিতার আসর করেছেন। কবিকে আমরা শ্রীপুর থেকে মাগুরাতে এনে তরঙ্গ সাহিত্য নাট্যগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দিয়েছি। তাকে প্রধান অতিথি করে সে সময় মাগুরা প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে সাহিত্যের নানা অনুষ্ঠান করেছি। তার কবিতা সবসময় আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। কবি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন চিরকাল আমাদের মাঝে। তিনি ছিলেন গণমুখী কবি। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এই কবির জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি রইল অকৃত্রিম ভালোবাসা। মাগুরার আরেক অন্যতম গীতিকবি ও সাংবাদিক শামীম খান কবি কাজী কাদের নওয়াজ প্রসঙ্গে বলেন, বিগত শতকের ত্রিশের দশকে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে এসে ইউরোপীয় ভাবধারায় সাহিত্য সাধনার চেষ্টায় নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছিল। একুশে পদক পাওয়া কবি কাজী কাদের নওয়াজ উভয় ধারার মধ্যে নিজেকে স্বতন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তখন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও স্বতন্ত্রধারায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে নিজের অবস্থান বাংলা সাহিত্যে পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। কবি কাজী কাদের নওয়াজ তবুও আলাদা একজন। কবি কাজী কাদের নওয়াজ তার সৃষ্টি সম্ভারকে অনভিপ্রেত বাহুল্য ও দুর্বোধ্যতা মুক্ত রেখেছেন অত্যন্ত সচেতনভাবে। ঐতিহ্য, প্রেম, প্রকৃতি ও স্বদেশ তার কবিতার বিষয়বস্তুকে অধিক তাৎপর্য দিয়েছে।
সহজ-সরল ভাব ও ভাষায় রচিত তার কাহিনীধর্মী এবং নীতিকথামূলক শিশুতোষ রচনার সংখ্যা অধিক। তার কবিতায় সত্য-সুন্দর আর সুনীতিকে আঁকড়ে ধরেছেন, পথ দেখিয়েছেন আমাদেরকে। তার কবিতায় তাকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবে আমাদের মাঝে। কবি কাজী কাদের নওয়াজের জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি রইলো অশেষ শ্রদ্ধা।
শিক্ষা
কবি কাদের নওয়াজের শিক্ষা শুরু নিজ গৃহে। ১৯১৪ সালে তিনি বর্ধমান জেলার মাথরুন ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কবি নজরুলও এক সময় এ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ১৯২৪ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯২৯ সালে বহরুমপুর থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং পরবর্তীতে বিটিএ ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
সাহিত্যিক হিসেবে সম্মান
সাহিত্যিক জীবনে কাদের নওয়াজ পেয়েছেন অভাবিত সম্মান। ভূষিত হয়েছেন একুশে পদকে। এ ছাড়া শিশু সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, মাদার বক্সসহ অসংখ্য সাহিত্য পুরস্কার।
কর্ম জীবন
কবি কাজী কাদের নওয়াজ ১৯৩৩ সালে স্কুল সাব ইনস্পেক্টর হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে তিনি বেছে নেন। দেশ বিভাগের পর ১৯৫১ সালে তিনি প্রথম ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৬ সালে দিনাজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই তিনি মাগুরায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের প্রতি তিনি ছিলেন স্নেহপ্রবণ ও আদর্শপ্রাণ। শিক্ষা ও শিক্ষকদের মর্যাদার উচ্চ আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ নামক বিখ্যাত কবিতা।
শেষ জীবন
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ছান্দসিক কবি কাজী কাদের নওয়াজ ১৯৮৩ সালের ৩ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন। মাগুরার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে নানা সামাজিক কর্মকা-ে তার অসংখ্য অবদান থাকলেও মৃত্যুর পর তিনি একেবারেই উপেক্ষিত। তার বাড়িটি এখন অযতœ আর অবহেলায় পড়ে আছে। বাড়ির চারধারের মূল্যবান ঝাউগাছগুলো এখন উধাও। মৃত্যুর পর ২ যুগ পেরিয়ে গেলেও তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। এতে দিনে দিনে পলেস্তারা খসে গেছে। ক্ষয়ে গেছে বাড়ির অনেকাংশই। চুরি হয়ে গেছে বাড়ির দরজা-জানালা থেকে শুরু করে ঘরের সব আসবাবপত্রই। মানবতাবাদী এই কবির স্মৃতি রক্ষার্থে এখনই উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। কবি কাজী কাদের নওয়াজের প্রতি রইল জন্মবার্ষিকীর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
কাজী কাদের নওয়াজ প্রসঙ্গে
মাগুরার আরেক অন্যতম গীতিকবি ও সাংবাদিক শামীম খান কবি কাজী কাদের নওয়াজ প্রসঙ্গে বলেন, বিগত শতকের ত্রিশের দশকে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে এসে ইউরোপীয় ভাবধারায় সাহিত্য সাধনার চেষ্টায় নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছিল। একুশে পদক পাওয়া কবি কাজী কাদের নওয়াজ উভয় ধারার মধ্যে নিজেকে স্বতন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তখন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও স্বতন্ত্রধারায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে নিজের অবস্থান বাংলা সাহিত্যে পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। কবি কাজী কাদের নওয়াজ তবুও আলাদা একজন। কবি কাজী কাদের নওয়াজ তাঁর সৃষ্টি সম্ভারকে অনভিপ্রেত বাহুল্য ও দুর্বোধ্যতা মুক্ত রেখেছেন অত্যন্ত সচেতনভাবে। ঐতিহ্য, প্রেম, প্রকৃতি ও স্বদেশ তার কবিতার বিষয়বস্তুকে অধিক তাৎপর্য দিয়েছে। সহজ-সরল ভাব ও ভাষায় রচিত তাঁর কাহিনীধর্মী এবং নীতিকথামূলক শিশুতোষ রচনার সংখ্যা অধিক। তবে সংখ্যা বিচারে নয়; নীতিকথা ও শিশুশিক্ষার বিষয়বস্তুর পাঠক-প্রিয়তার নিরিখে অল্পকিছু লেখাই তাঁকে সাহিত্যে অমরত্বের আসন তৈরি করে দিয়েছে। তাঁর কবিতায় সত্য-সুন্দর আর সুনীতিকে আঁকড়ে ধরেছেন, পথ দেখিয়েছেন আমাদেরকে। তাঁর কবিতায় তাঁকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবে আমাদের মাঝে। কবি কাজী কাদের নওয়াজের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি রইলো অশেষ শ্রদ্ধা।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228