ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

চলচ্চিত্রে-উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ

শফিক হাসান
🕐 ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০২০

হুমায়ূন আহমেদের তাবত সৃষ্টিতে বড় স্থান দখল করে আছে মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন বিভীষিকার মধ্য দিয়ে গেছেন তিনি ও তার পরিবার। হুমায়ূনের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ মারা যান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে। নিজেও আটক হয়েছিলেন, বেঁচে যান অলৌকিকভাবে। প্রাণে বাঁচলেও মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল ঘটনাপ্রবাহ, (না)পাক বাহিনীর নৃশংসতা, রাজাকারের উত্থান তাকে স্বস্তি দেয়নি। দায়বোধ থেকেই বিস্তর কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তার গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে যখন স্বাধীনতার বিষয়-আশয় উচ্চারণ করা যেত না, অভিনব কায়দায় সুসংহত অবস্থান প্রকাশ করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তখনকার একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভিতে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটক ‘বহুব্রীহি’তে টিয়া পাখির মুখ দিয়ে বলিয়েছেন ‘তুই রাজাকার’।

‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। বিয়োগান্তক প্রেমের এই চলচ্চিত্রের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ছিল মুক্তিযুদ্ধ। ভাটি অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন এক গ্রামের অহংকারী, বদমেজাজি জমিদার সকলের কাছে ঘৃণিত। কিন্তু নিরীহ গ্রামবাসী সরাসরি ঘৃণা জানাতে পারে না। এই জমিদার মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়িতে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প করতে দিয়েছিলেন। রাজাকার বাবার প্রতি ঘৃণায় একমাত্র ছেলে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেখেনি বাবার মুখ। গ্রামেও ফেরেনি। জমিদারের নাতনিরা বড় হয়ে গ্রামে বেড়াতে এলে একটু একটু পাল্টে যান। শেষ দৃশ্যে ক্ষমা চান গ্রামবাসীর কাছে। একাত্তরের দেশবিরোধী ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তার বাড়িটি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য দান করেন।

যুদ্ধাপরাধীদের যখন বাড়বাড়ন্ত অবস্থা, এমন পরিস্থিতিতি রাজাকারকে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইয়ে হুমায়ূন আহমেদ দেশপ্রেমের মহিমাই ভাস্বর করে তুলেছেন। তবে শিল্প-সত্য ও বাস্তব-সত্য সবসময় এক হয় না। নাটকে-চলচ্চিত্রে রাজাকারের মনোভাবের পরিবর্তন দেখানো গেলেও বাস্তবে সেটা কমই ঘটেছে। প্রায় পাঁচ দশকে পৌঁছেছে স্বাধীনতাপ্রাপ্তি। দীর্ঘ এই সময়ে কতজন রাজাকার প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন! রাজাকারের ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিদেরও পূর্বসূরিদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে দেখা যায়নি। এই ভয়াবহ ও দুর্বিনীত পরিস্থিতি এটাই জানান দেয়Ñ একাত্তরের ভূমিকার জন্য তারা লজ্জিত নন। দেশকে তুলনা করা হয় মায়ের সঙ্গে, সেই মায়ের ধর্ষণ-চেষ্টায়ও বিব্রত নন রাজাকারকুল। এটা একই সঙ্গে লজ্জা ও আশঙ্কার জায়গা। রাজাকার-মৌলবাদীদের উত্তরসূরিদের কথা বাদ দিলে নতুন প্রজন্মের চেতনায় আলো ফেলছে সৃজনশীল এসব কর্ম। এটাই ভরসার জায়গায়। মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের চর্চা যত বেশি হবে, ততই পোক্ত হবে দেশপ্রেম ও মাতৃঋণের দায়।

হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র ‘শ্যামল ছায়া’। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জড়ো হয় একটি নৌকায়। এই নৌকার যাত্রীরা অনিরাপদ। মুক্তাঞ্চল সন্ধানী। গন্তব্যের অনুসন্ধানে ভেসে চলে নৌকাটি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে পুত্র ও নাতিহারা এক বৃদ্ধ নৌকাটি ভাড়া করেন। নানা জায়গা থেকে আশ্রয় নেয় অনেকেই। একপর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হুমায়ুন ফরীদি নৌকায় ওঠেন। ঘটনা পরম্পরায় তিনি চিৎকার করে ওঠেন- বর্ডার পার হতে পারলেই কত্ত বড় কলকাত্তা! পরক্ষণেই মিইয়ে যান- কলকাতায় যাব কেন, কলকাতা তো আমার দেশ না! মাওলানার ভূমিকায় অভিনয় করেন রিয়াজ। নিজের ধর্মবোধ থেকেই একসময় প্রশ্নের মুখে বলতে বাধ্য হন- তিনি যুদ্ধের বিপক্ষে, অখণ্ড পাকিস্তান চান। ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া-বিবাদ হতেই পারে। শেষপর্যন্ত বাস্তবতা অনুধাবন করে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যান। একজন গোঁড়া মাওলানার মনোজগতে বিবর্তন অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে।

হুমায়ূন আহমেদের বৃহৎ কলেবরের উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’। নীলগঞ্জ হাইস্কুলের আরবি শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরী চান না দেশ স্বাধীন হোক। তাহলে দেশের মানুষকে হিন্দুর গোলামি করতে হবে। শেষপর্যন্ত ভাবনার পরিবর্তন হয়। চারজন হিন্দুকে জোরপূর্বক খৎনা করানোর আয়োজনে তিনি রুখে দাঁড়ান। জানিয়ে দেন, ‘পরাধীন দেশে জুম্মার নামাজ হয় না।’ নামাজ পড়াতে অস্বীকৃতি জানানোর দৃঢ় প্রত্যয় তাকে সত্যিকারের ধার্মিক ও মানবতাবাদী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করে।

উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটেছে এভাবে- ‘নাইমুল কথা রাখেনি। সে ফিরে আসতে পারেনি তার স্ত্রীর কাছে। বাংলার বিশাল প্রান্তরের কোথাও তার কবর হয়েছে। কেউ জানে না কোথায়। এই দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার কবরের মাঝে তারটাও আছে। তাতে কিছু যায় আসে না। বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানকে ধারণ করেছে। জোছনার রাতে সে তার বীর সন্তানদের কবরে অপূর্ব নকশা তৈরি করে। গভীর বেদনায় বলে, আহা রে- আহা রে।’

এভাবেই হৃদয় দুমড়েমুচড়ে দেশপ্রেম দীক্ষা ও ইতিহাসের শিক্ষা দিয়ে যান হুমায়ূন আহমেদ। কথার জাদুঘর হিসেবে ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করেন; সেই মায়া ত্যাগ করে বেরিয়ে আসার সাধ্য কার আছে!

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper