কামাল লোহানী ও দুজন ছায়া মানুষ
শফিক হাসান
🕐 ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ, জুন ২২, ২০২০
কামাল লোহানীর বাসায় পৌঁছাতে মাড়াতে হয় কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়াসহ আরো গাছগাছালির ছায়া। রাজধানীতে এখনো কিছু গাছ অবশিষ্ট আছে; সেই ঐতিহ্যের সাক্ষী অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি। ৩২ নম্বর রোডের বামদিকে লেক, ডানদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়ি। এ জায়গা অতিক্রম করে কিছুক্ষণ পায়ে হাঁটলে দেখা মেলে আরেকটি ছায়া সুশীতল বাড়ির। সেখানে থাকেন মনীষী কামাল লোহানী।
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, অতঃপর সাংস্কৃতিক জাগরণ- এই তিন পর্বে অল্প সংখ্যক মানুষ অবদান রাখতে পেরেছিলেন। ‘নির্মাতা’ কামাল লোহানী রয়েছেন সম্মুখ সারিতে। শুধু ‘রেডিওর ভেতরে’ই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বারবার এসেছেন বাইরে, জনসম্মুখে। সকাল সন্ধ্যায়। বরেণ্যজনদের মধ্যে একধরনের লুকোছাপার প্রবণতা থাকে, তা অনুপস্থিত কামাল লোহানীর জীবনচর্যায়। জাতির যে কোনো সংকটে, আন্দোলন-সংগ্রামে তার উপস্থিতি অনিবার্য। শাহবাগের রাস্তায় তার মৃদু অথচ শাণিত যুক্তিগুলো ঝলসে উঠত বারবার। কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতো কোষে কোষে।
ক্ষুদ্রায়তন বাক্যে বুঝিয়ে দিতেন সংকটের স্বরূপ। শাহবাগকেন্দ্রিক যে সাংস্কৃতিক বলয়, সেখানে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। জাতীয় গণগ্রন্থাগারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায়ই দেখা যেত তাকে, অতিথির আসনে। কামাল লোহানীর উপস্থিতি মানেই যেন প্রাণবন্ত একটি অনুষ্ঠান; আয়োজকদের মনে খুশির ঝিলিক!
কতবার, কত অনুষ্ঠানে লোহানী ভাইয়ের জ্ঞানগর্ভ কথামালায় ঋদ্ধ হয়েছি। তাকে হেঁটে যেতে দেখলে নিমেষেই ছোটখাটো জটলা লেগে যেত। ভক্ত-অনুরাগীরা ভালোবাসার পরশে জড়িয়ে রাখতে চাইত তাকে। ভালোমন্দ খোঁজখবর রাখার তাগিদ সার্বক্ষণিক। পরিচিত দৃশ্যের বাইরে এসে একদিন গেলাম তার বাসায়। সঙ্গে বন্ধুবর অজয় কুমার রায়, সে বাসা চেনানোর দায়িত্বে। শুক্রাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে কিনে নিলাম সেদিনকার পত্রিকা। বাসায় ঢুকে খোলা কাগজ তুলে দিলাম কামাল লোহানীর হাতে। বললাম, ‘নিয়মিত আপনার কলাম ছাপতে চাই।’
এতক্ষণ চোখের কাছে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। পত্রিকা নামিয়ে হাসলেন একটু- ‘সেটা কি সম্ভব? এই যে তোমরা দুজন সামনে, আমি দেখতে পাচ্ছি দুটি ছায়া! কেউ আমাকে অনুষ্ঠানে নিলেও হাত ধরে নিয়ে যায়, আবার বাসায় পৌঁছে দেয়।’
এমন অবস্থায় লেখার জন্য চাপ দেওয়া যায় না। জানালেন আত্মজীবনী ‘লিখছেন’ তিনি। সময় করে এক তরুণ বাসায় আসে, তিনি মুখে বলেন সে কম্পোজ করে। দেশ বিষয়ে, উন্নতি-অবনতিসহ আরো বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করলেন তিনি। আলাপের সূত্রধর অজয় কুমার রায়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে নানান কথা বলে যাচ্ছিলেন তিনি। একপর্যায়ে চমৎকৃত হলাম তার মুখে দিনাজপুরের সংস্কৃতিকর্মী মইনউদ্দিন চিস্তির কথা শুনে। বললেন, ‘উদীচীর ট্যুরে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে জেনেছি চিস্তি অসুস্থ।’ পরে মইনউদ্দিন চিস্তি মারা যান। কামাল লোহানীর মতো বটবৃক্ষ প্রান্তে থাকা একজন কর্মীর স্বাস্থ্যের খোঁজও রাখেন এটা মুগ্ধ করেছিল।
আলাপের এক ফাঁকে আমি তার হাতে তুলে দিই সাক্ষাৎকারমূলক বই- ‘মুখোমুখি রতনতনু ঘোষ’। বইটা তাকে ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে যৌথভাবে উৎসর্গ করা। খুশি হলেন কামাল লোহানী। চোখের সামনে নিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। স্মৃতিচারণ করলেন প্রয়াত রতনতনু ঘোষকে নিয়ে।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই লিখেছেন কামাল লোহানী। যে বইগুলো জাতিকে পথ দেখাবে, মুখ চেনাবে। আমরা যারা সৃজনশীল কর্মে সঙ্গে জড়িত, নানা জায়গায় বিরামহীন ঠকে যাই। একবার এক প্রকাশক প্রস্তাব দিলেন, কামাল লোহানীর একটা বই সম্পাদনা করে দিতে হবে। তিনি সারা জীবন যেসব বরেণ্য ও ঘনিষ্ঠজনকে নিয়ে লিখেছেন সেসব লেখার গ্রন্থরূপ। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমলে রেখে অস্বাভাবিক পারিশ্রমিক হাঁকলাম। ফলে কাজটা আর করা হয়নি। আজ মনে হচ্ছে, পরশপাথরকে অবহেলা করেছি। প্রস্তাবটা আগপিছ না ভেবে গ্রহণ করা উচিত ছিল।
কামাল লোহানী আছেন, থাকবেন ভোরের সূর্যোদয়ে, পাখির গানে; আমাদের সংস্কৃতিতে, যাপিত জীবনের প্রাত্যহিকতায়।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228