ঐতিহ্যের তীর্থভূমি জয়পুরহাট
আবদুল আলীম
🕐 ৩:৩২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৮, ২০১৯
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি জয়পুরহাট। এ জেলায় বেড়ানোর জন্য রয়েছে বেশকিছু আকর্ষণীয় স্থান- এর মধ্যে বারশিবালয় বা দ্বাদশ শিবমন্দির, আছরাঙ্গা দীঘি, হিন্দা-কসবা শাহী জামে মসজিদ, আদিবাসী ভাস্কর্য, নান্দাইল দীঘি, লকমা রাজবাড়ি, পাথরঘাটা, নিমাই পীরের মাজার, গোপীনাথপুর মন্দির, দুয়ানী ঘাট পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ জেলাকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন করেছেন আবদুল আলীম।
পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি
পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমিটি জয়পুরহাট জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে জয়পুরহাট সদর উপজেলার চকবরকত ইউনিয়নের পাগলা দেওয়ান গ্রামে অবস্থিত। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তৎকালীন স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের প্ররোচনায় কোনোরকম উস্কানী ছাড়াই পাক সেনারা ১২২ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। উক্ত স্থানে গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে একটি স্মৃতিশৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
লকমা রাজবাড়ি
জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার পশ্চিম কড়িয়া গ্রামে ঐতিহাসিক লকমা রাজবাড়ি অবস্থিত। বাড়িটিতে বর্তমানে লকমা চৌধুরীর পরনাতীসহ উত্তরাধিকারী ও স্থায়ী বাসিন্দা সমন্বয়ে ৪২ জন সদস্য সমিতি করে দেখাশোনা করেন। লকমা চৌধুরীর পরনাতী জানান, প্রায় ২০০-৩০০ বছর পূর্বে বাড়িটি নির্মাণ হয় এবং বর্তমানে এখানে প্রায় ১৫ বিঘা জমি আছে।
উক্ত জমিতে বিভিন্ন শস্য উৎপাদনের পাশাপাশি ফল ও ফুলের বাগান দেখা যায়। স্থানীয় লোকজন জানান, দালান দুটির একটি ঘোড়াশাল এবং অপরটি হাতীশাল ছিল। তার একটু সামনে মাটির একটি ঢিবি রয়েছে সেখানে ইউ আকৃতির বহু পুরাতন দ্বিতল ভবনের অবস্থান। জনশ্রুতি আছে যে, ভবনের কিছুটা অংশ মাটির নিচে ডেবে গেছে। লকমা চৌধুরীর বাড়ির পূর্ব পাশে কর্মচারীর ঘর ও কবরস্থান রয়েছে। বর্তমানে রাজবাড়িটি সংস্কারের অভাবে ধ্বংস হতে চলেছে। এখনও প্রতিদিন অনেক লোক স্বচক্ষে রাজবাড়িটি দেখার জন্য আসেন।
শিশু উদ্যান
জয়পুরহাট জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। জয়পুরহাট জেলার উত্তরে রয়েছে গাইবান্ধা জেলা, দিনাজপুর জেলা এবং ভারত সীমান্ত, দক্ষিণে রয়েছে বগুড়া জেলা ও নওগাঁ জেলা, পূর্বে বগুড়া জেলা ও গাইবান্ধা জেলা এবং পশ্চিমে নওগাঁ জেলা ও ভারত সীমান্ত। ৯৬৫.৮৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই জেলাটির অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র শিশু উদ্যান। অবসর বিনোদন এবং শিশুর ক্রমবিকাশকে ত্বরান্বিত করতে জেলা শহর থেকে মাত্র এক কিলোমিটার পশ্চিমে বুলু পাড়ায় অবস্থিত এই শিশু উদ্যানটি। ৬০ একর জায়গার উপর স্থাপিত উদ্যানটি শিশুদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়।
এছাড়া স্থানীয় সব বয়সী নারী পুরুষের কাছেও এটি সমান আকর্ষণের। উদ্যানের পাশাপাশি এখানে রয়েছে একটি রিসোর্টও। নির্মল বিনোদনের পাশাপাশি স্থানটিতে শিশুদের জীববৈচিত্র্য, সামাজিক, পারিবারিক এবং জ্ঞান বিজ্ঞান ও সাহিত্যের নানাবিধ উপস্থাপনের মাধ্যমে বহুমুখী শিক্ষা দানের লক্ষ্যে উৎসাহব্যঞ্জকভাবে নির্মিত। খেলাধুলার নানা উপকরণের মধ্যে আছে নাগরদোলা, চড়কি, সুইমিং পুল, দোলনাসহ আরও অনেক রাইড। আছে চিড়িয়াখানা, থ্রিডি মুভি, ফুডকোর্ট ও বিশাল সুসজ্জিত বাগান। বাগানে রয়েছে বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকের ম্যুরাল। নানা রকম গাছপালা আর লতাপাতা দিয়ে ঘেরাও এই উদ্যানটি শিশু বৃদ্ধ সবার অবসর কাটাতে দারুণ আয়োজনে সমৃদ্ধ। এখানে পরিবার পরিজন সমেত পিকনিক করার জন্য রয়েছে পিকনিক স্পট। আছে শুটিং স্পটও।
হিন্দা-কসবা শাহী জামে মসজিদ
ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শন হিন্দা-কসবা শাহী জামে মসজিদ। জয়পুরহাট শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ক্ষেতলাল উপজেলার বড়াইল ইউনিয়নের হিন্দা গ্রামে এ মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটির কাঠামোতে কাচ, চীনামাটির টুকরা ও মোজাইকসহ এর দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন রকম নকশা, যা মোঘল স্থাপত্য শিল্পের অনুকরণে করা হয়েছে। মসজিদের কক্ষের দৈর্ঘ্য ৪৯.৫০ ফুট ও প্রস্থ ২২.৫০ ফুট। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের কথা চিন্তা করে এর পাঁচটি গম্বুজ তৈরি করা হয়েছে।
মাঝের বড় একটি ও চারপাশের চারটি ছোট গম্বুজ রড ছাড়াই তৈরি হয়েছে। মসজিদের উত্তর পাশে ৪০ ফুট লম্বা মিনার রয়েছে। পূর্ব পাশে রয়েছে হযরত শাহ্ সুলতান বখতির চারজন শিষ্যের মাজার। বাংলা ১৩৬৫ সালে বাগমারী পীর হিসেবে পরিচিত চিশতিয়া তরিকার অন্যতম পীর হযরত আব্দুল গফুর চিশতীর (রহঃ) নির্দেশে মাওলানা আব্দুল খালেক চিশতি আমলে তারই তত্ত্বাবধানে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। হযরত আব্দুল গফুর চিশতী (রহ.) নিজেই এর নকশা তৈরি ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
আদিবাসী ভাস্কর্য
পাঁচবিবি উপজেলার ধরঞ্জী ইউনিয়নের নন্দইল গ্রামে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আদিবাসীদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম আদিবাসী ভাস্কর্য। নির্মাণের প্রথমদিকে আদিবাসী সম্প্রদায়সহ স্থানীয় এলাকাবাসী ভাস্কর্যকে ঘিরে নানাবিধ আশায় আশাবাদী হলেও কয়েক বছরের ব্যবধানে ভাস্কর্যটির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ, অযত্ন আর অবহেলায় আজ ভাস্কর্যটির সৌন্দর্য হারাতে বসেছে।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধার সাবেক কমান্ডার মিছির উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন দিবসে আমরা শুধুমাত্র পুষ্পস্তবক দেই। পবিত্রতা বা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কমিটির। ভাস্কর্য রক্ষণাবেক্ষণ কমিটির সভাপতি সুজিত টুডু বলেন, আমি মৌখিকভাবে অনেকবার মূল উদ্যোক্তা আমিনুল ইসলাম বাবুল ভাইয়ের কাছে বলেছি। তিনি ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
গোপীনাথপুর মন্দির
জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলা সদর হতে মাত্র ৬-৭ কিলোমিটার পূর্বে গোপীনাথপুরে একটি অতি প্রাচীন মন্দির রয়েছে। এটি গোপীনাথ ঠাকুরের মন্দির নামের পরিচিত। যতদুর জানা যায়, আজ থেকে পাঁচশ’ বছর পূর্বে ভারতের নদীয়া জেলার শান্তিপুর ছিল শিক্ষা-দীক্ষায় খুব নামকরা স্থান। শান্তিপুরে প্রভুপাদ অদ্বৈত গোস্বামী সবসময় ঈশ্বরের ধ্যান করতেন। তার সত্রী সীতা দেবীও ছিলেন সতী-সাধ্বী নারী। এ সময় ২৪ পরগনার যুবক নন্দ কুমার এবং নদীয়া জেলার আর এক যুবক যজ্ঞেশ্বর রায় প্রভুপাদ অদ্বৈত গোস্বামীর কাছে এসে দীক্ষা গ্রহণ করতে চাইলে অদ্বৈত গোস্বামী মহোদয় তাদের সব কথা শুনে সীতাদেবীর কাছে পাঠান। সীতাদেবী ধ্যান যোগে জানতে পারেন যে, এই যুবকরা পূর্ব জন্মে জয়া ও বিজয়া নামে দুই সখী ছিলেন।
নন্দিনী প্রিয়া বরেন্দ্র এলাকায় বর্তমান জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামের ১ কিঃমিঃ উত্তরে গভীর জঙ্গলে নদীর ধারে একটি মন্দির স্থাপন করেন। জনশ্রুতি আছে যে, ১৫২০ থেকে ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ নন্দিনী প্রিয়ার পূজা পার্বনে এবং অতিথি সেবার কথা শুনে খুশি হন এবং তাম্রফলকে লিখে পূর্ণগোপীনাথপুর ও গোপালপুর মৌজার সব সম্পত্তি দেবোত্তর হিসেবে প্রদান করেন। পূর্ণ গোপীনাথপুর মন্দিরটি নির্মিত হয়। পাল যুগের নির্মাণ কৌশলের সঙ্গে এ মন্দিরটির কাঠামো নির্মিত হয়। ১৩০৪ বাংলা সালে এক ভূমিকম্পে এ মন্দিরটি ভেঙে পড়ে। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বর্তমান মূল মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণ করা হয়। এখনও পুরাতন কারুকার্যের কিছু নমুনা মূল ভবনে রয়েছে। মন্দিরটির উচ্চতা ৫০ ফুট এবং এর নির্মাণ ব্যয় ১ লাখ টাকা হয়েছিল। তাই পিকনিক স্পট হিসেবেও স্থানটি খ্যাতি লাভ করেছে।
বারশিবালয় মন্দির
জয়পুরহাট সদর থেকে তিন মাইল উত্তর-পশ্চিমে ছোট যমুনার তীরে বেল-আমলা গ্রাম অবস্থিত। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা নিভৃত স্থানে বারটি শিবমন্দির রয়েছে। মন্দিরগুলো কোন যুগে এবং কার দ্বারা তৈরি তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে মন্দিরের গঠন প্রণালি ও নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত দেখে মনে হয় এগুলো সেন যুগে তৈরি। কারণ সেন রাজা বল্লভ সেন ছিলেন শিবের উপাসক তথা শৈব। এতদঞ্চলে সেন রাজাদের কিছু কীর্তি রয়েছে। যেমন পাঁচবিবির লখমা ও পাথরঘাটা। এর থেকে ধরে নেওয়া যায় রাজা বল্লাল সেন শিব উপাসনার জন্য এখানে এসব মন্দিরগুলো নির্মাণ করেছিলেন।
নিমাই পীরের মাজার
পাথরঘাটা নিমাই পীরের মাজারের পাশে একটি পাথরের দণ্ড পোঁতা আছে। এটা পীর সাহেবের আশা বলে পরিচিত। একটি সিংহমুখাকৃতি কারুকার্য খচিত পাথরের ওপর উপবেশন করে তিনি একতববাদের বাণী প্রচার করতেন। চৈত্র মাসের প্রথম সোমবারে এখানে মাজার জিয়ারত উপলক্ষে ইসালে সওয়াব এবং মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ইসালে সওয়াবের কয়েক দিন পর এখানে স্নান উপলক্ষে হাজার হাজার হিন্দু নর-নারীর সমাবেশ ঘটে। এ উপলক্ষে এখানে এক বিরাট মেলা হয়।
এটি পাথরঘাটার মেলা নামে পরিচিত। এখানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বহু পাথর পড়ে থাকতে দেখা যায়। বলা হয় যে, নিমাই পীরের আস্তানা থেকে পাথরে বাঁধা একটি ঘাট ছিল। এই রাস্তায় তুলসী গঙ্গা নদীর তীরে একটি পাথরের সেতু ছিল। সেতুটি বহু পূর্বে ভেঙে গেছে। সেতুটি প্রায় ১৫০ ফুট দীর্ঘ ছিল। নদীর পূর্ব তীরে পাথর ও ইটের গাঁথুনি দেখা যায়। অনেকে সেতুটির খিলান বলে মনে করেন। পীর সাহেব উপস্থিত ভদ্রম-লীকে একখ- করে পাথর বসে দিতেন। প্রবাদ আছে, পীর সাহেব পাথরগুলো অলৌকিক উপায়ে নদীপথে এখানে এনেছিলেন।
আছরাঙ্গা দীঘি
জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। এর মোট আয়তন ২৫.৫০ একর। ধারণা করা হয় প্রায় ১২০০ বছর পূর্বে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১০৭০ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট এ দীঘি খনন করা হয়। অনেকের মতে, তাহিরপুর রাজ পরিবারের সদস্য মনু ভুট্ট এ দীঘি খনন করেন। ১৯৯২ সালে এ দীঘিটি পুনরায় খনন করা হয়।
এ দীঘিটি খননকালে ১২টি মূর্তি পাওয়া যায়, যা বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। বর্তমানের দীঘিটির চর্তুদিকে পাড়ে একটি পাকা রাস্তা করার কাজ চলছে। দীঘিটির চারদিকে অসংখ্য গাছ-পালা এবং দীঘিটির স্বচ্ছ পানি মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে, যা সকলকে আকৃষ্ট করে। প্রতি বছর অসংখ্য ভ্রমণ পিপাসুর এখানে আগমন ঘটে।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228