ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্র বদলের অভ্যুদয়

তুষার রায়
🕐 ১২:৪৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৫, ২০১৯

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ’ নামে লিখেছেন উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে খোলা কাগজের পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তুষার রায়।

খোলা কাগজ : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে কি ছিল বলে আপনি মনে করেন?
ড. মীজানুর রহমান : বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এ তিনটি বিষয় একসূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশ নামের একটা রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অবিকল্প নেতৃত্ব। বাংলাদেশ নামের যে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো এটা কিন্তু এক দিনের কোনো ঘটনা না। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় যে পাকিস্তান আন্দোলন হলো সেখানে কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তান যে আদর্শ লালন করে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে পৃথক হয়েছে বঙ্গবন্ধু সেই পাকিস্তানি চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি চেয়েছেন অসাম্প্রদায়িক উদার স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তা। তার চেতনায়, মননে, মগজে সবসময় জাগরুক ছিল বাঙালির অধিকার, বাঙালির সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয় নিশ্চিত করা। শোষণ আর নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে আমাদের এ অঞ্চলের মানুষ জাতির জনকের নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। আমি মনে করি, জাতির জনককে হত্যার নেপথ্যে ছিল সাম্প্রদায়িকতা আর পাকিস্তান পন্থাকে ফিরিয়ে আনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুরু থেকেই অনুমান করেছিলেন, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে বাঙালির চেতনা বিকশিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তখন থেকেই শুরু হয় আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মালিক হই। কিন্তু দেখা গেল, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে কেবল রাষ্ট্রনায়ক অথবা স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যা করা হলো তা নয়। ইতিহাসের কলঙ্কময় এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশকে ফের পূর্ব পাকিস্তানে রূপান্তর করা হয়। সব ধরনের মৌলবাদী চিন্তা-চেতনার অনুষঙ্গ ফিরে আসে। বাংলাদেশকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানিয়ে উল্টোপথে যাত্রা শুরু হয়। এতে করে আমরা আবার আমাদের বাঙালিত্বকে হারিয়ে ফেলি। বাঙালিত্ব এবং বাঙালিত্বের অনুষঙ্গের ওপর শুরু হয় একের পর এক আক্রমণ। অর্থাৎ বাঙালিত্বের বিপরীতে ধর্মীয় মৌলবাদী চেতনার বিকাশের সব ধরনের আয়োজন সম্পন্ন করা হয়।

জাতির জনকের নিরাপত্তার দায়িত্ব যাদের ছিল তাদের ভূমিকা কি ছিল?
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তায় কখনো আসেনি যে, বাঙালিরা ষড়যন্ত্র করে তাকে হত্যা করতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিষয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য তার কাছে ঠিক মতো পৌঁছেছিল কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অনিশ্চিত এ কারণেই যে, মিলিটারি ব্যুরোক্রেসিসহ যারা গোয়েন্দা সংস্থায় থাকেন, তারা তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এক ধরনের বাধার সৃষ্টি করেন।

নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিদেশি শক্তির সম্পৃক্ততা কতটা ছিল?
জাতির জনক শুরু থেকেই এটা অনুধাবন করেছিলেন বলেই তিনি বারবার পাকিস্তানি চেতনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে গেছেন। এ দেশীয় কিছু দোসর সবসময় পাকিস্তানি ভাবধারাকে বয়ে আনতে চক্রান্ত করে গিয়েছে। পাকিস্তানি মৌলবাদী চেতনার আধুনিক রূপ হচ্ছে বর্তমানের জঙ্গিবাদী কার্যক্রম। বাঙালি জাতিকে অনন্য উচ্চতায় নিতে যাওয়ার পথে যে আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছেন তা শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশে রূপ নেয়। তাই তাকে হত্যা করাটা ছিল দেশি-বিদেশি মৌলবাদী শক্তির একমাত্র টার্গেট। সুদীর্ঘকাল বঙ্গবন্ধুকে রুখতে না পেরে স্বাধীন বাংলাদেশে তাকে হত্যার যড়যন্ত্র করে এ শক্তি। জাতির জনককে হত্যা কোনো সাধারণ ক্ষমতা বদলের সামরিক অভ্যুত্থান ছিল না। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ছিল রাষ্ট্র বদলের অভ্যুদয়। এ দেশীয় কিছু সেনার সাধারণ অভ্যুত্থান না এটা। তারা ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র।
পাকিস্তান, চীন, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি। তারা বিভিন্নভাবে বাধার সৃষ্টি করেছে। আবার ঠেকাতেও পারেনি। ফলে স্বভাবতই অনেক বিদেশি শক্তির ক্ষোভ ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর। ফলে একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক চক্র এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। ১৯৭৫ সালের পর থেকে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে ক্যান্টনমেন্ট থেকে দীর্ঘদিন দেশ শাসিত হয়েছে। যেমনটা পাকিস্তানে আজও বিদ্যমান। এক কথায় পাকিস্তান ও তাদের এ দেশীয় দোসররা চেয়েছে সবসময় পাকিস্তান মডেলে দেশ চালাতে। তবে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতার আসার পর থেকে এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ।

জাতির জনককে হত্যার নেতিবাচক প্রভাব কি ছিল?
বাংলাদেশ নামক যে রাষ্ট্রটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় অর্জন করেছিলাম, তার পুরোটাই হাতছাড়া হয়ে যায় ’৭৫-এর পনের আগস্ট। কারণ সে দিন শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বা জাতির জনককেই হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অর্থাৎ বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তানে রূপান্তর করা হয়। যে আদর্শ, স্বপ্ন নিয়ে মানুষ স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছে, ঐতিহাসিকভাবে যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে এসেছিল ষাটের দশক থেকে, সব অপশক্তি ক্ষমতা দখল করে পনের আগস্টের পর। ফলে ’৭৫-এর পর বাংলাদেশ পথ হারিয়ে ফেলে। অর্জন করতে পারেনি কাঙ্খিত লক্ষ্য। ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকে।
মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার হারিয়ে ফেলে দেশবাসী। উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। নেতিবাচক সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। বাঙালির চেতনার ওপর আঘাত আসতে থাকে।
আমাদের সংস্কৃতিকে মুছে ফেলতে ওই চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে আশার কথা দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতা আসে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগকে দেশ ও জনকল্যাণের জন্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে জননেত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা অনন্য। আওয়ামী লীগকে নতুন প্রজন্মের আধুনিক একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে রূপান্তরের ক্ষেত্রেও তার বিরাট অবদান। এরপর থেকে বাংলাদেশ আবার খুঁজে পায় পথের দিশা।

জাতির জনককে হত্যার ধকল কতটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বাংলাদেশ?
বঙ্গবন্ধুর মতো ক্যারিশম্যাটিক বিশ্ব নেতা শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। কোনো কিছুর বিনিময়ে এ ঘাটতি কাটানো যাবে না। জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে এ অপশক্তি চেয়েছে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হয়ে উঠুক বাংলাদেশ। কিন্তু সব চক্রান্তকে ব্যর্থ করে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে অদম্য গতিতে। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র আজো থেমে নেই। বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা রুখে দেওয়ার যড়যন্ত্র চলছে। বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে উদার অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে বিশ্বমঞ্চে সমানের জায়গা তৈরি করে নিচ্ছে। তাই বলা যায় ঘাতকরা সফল হতে পারেনি। জাতির জনকের চেতনার মৃত্যু নেই।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper