সাধারণ মানুষ অসাধারণ কৃতী
ড. আনিসুজ্জামান
🕐 ১:৫৯ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৪, ২০১৯
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন কাহিনী কতটা সাধারণ এবং কতটা অসাধারণ এটা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য নয়, কিন্তু তার তাৎপর্যটুকু গ্রহণ করতে কিছু বিবেচনা শক্তির প্রয়োজন হয়। পূর্ববঙ্গের এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম, বেশ একটু দেরি করে লেখাপড়া করে-বাইশ বছর বয়সে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন-তিনি গিয়েছিলেন সব কর্মকেন্দ্র রাজধানী কলকাতায়। সেখানে গিয়ে জড়িত হয়েছিলেন মুসলিম লীগের রাজনীতিতে, ছাত্রনেতার মর্যাদাও পেয়েছিলেন। কিন্তু তাও একচ্ছত্র প্রভাবের অধিকারী হননি।
ছাত্র হিসেবে মনোযোগী ছিলেন না। বিএ পাস করতে এক বছর সময় বেশি লেগেছিল। তার পরপরই সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের হয়ে জানপ্রাণ দিয়ে খেটেছিলেন। ফরিদপুরে কর্মী হিসেবে খুব নাম হয়েছিল তাঁর। তারপরই তো দেশভাগ, পাকিস্তানের সৃষ্টি। কিন্তু যে পাকিস্তানের জন্যে তাঁর এত আন্দোলন, সেই পাকিস্তানে এসে স্থান হলো তাঁর ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে এবং অচিরেই সরকারবিরোধী ভূমিকায়। ভাষা আন্দোলনে। তিনি কারাগারে গেলেন, বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা হলেন, কিন্তু তখনো তার সাধারণ সম্পাদকের পদটির জন্য তিনি বিবেচিত হননি।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পর থেকে তিনি বিশেষভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় এসে দাঁড়ালেন। দু-দুবার ক্ষণস্থায়ী মন্ত্রিত্ব লাভ এবং বারবার কারাভোগ তাঁকে ক্রমশ, রাজনীতির সামনের সারিতে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তখনো তিনি ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর ছায়ায়। মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে গেলেন, আইউবের সামরিক শাসনের মধ্যভাগে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হলো। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা, পূর্ব বাংলার স্বার্থহানি বিষয়ে তাঁর সতর্কবাণী এবং সর্বশেষে, ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতিরূপে ছয় দফার উত্থাপন তাঁকে জীবনের অসাধারণ পর্বে উন্নীত করে।
ছয় দফার উত্থাপন শেখ মুজিবের জীবনের এবং আমাদের জাতীয় জীবনের ক্রান্তিলগ্ন সূচিত করেছিল। তিনি তা কতদূর উপলব্ধি করেছিলেন, তা বলা দুষ্কর, কিন্তু আমরা বেশিরভাগই সেকথা উপলব্ধি করতে পারিনি। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ১৯৫২ সালের পর থেকে অসাম্প্রদায়িক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছিল এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম সামরিক শাসনের প্রবর্তন সত্ত্বেও চলছিল অব্যাহত গতিতে।
তবু বাঙালির মুক্তিসনদ বলে অভিহিত করে দাবি নামা প্রণয়ন এবং আইউবের মতো স্বৈরাচারী শাসকের সম্মুখে তা উপস্থাপনের কথা কেউ ভাবতে পারেনি। এর তাৎপর্যও আমরা সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারিনি। বিশেষভাবে আমরা যারা রাজনীতিতে আন্তর্জাতিকতায় আস্থাবান ছিলাম, আমাদের মধ্যে সন্দেহ জেগেছিল যে এর পশ্চাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হয়তো কার্যকর রয়েছে। কেউ কেউ ভেবেছিলাম ১৯৪৭ সালে তো দেশ একবার খণ্ডিত হয়েছে, আবার সেই খণ্ডনের পথ ধরে কি সাধারণ মানুষের ভাগ্য ফিরবে?
কিন্তু যাঁর মনে মত ও পথ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ ছিল না-তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। আর আমাদের মনের সন্দেহটা দূর করতে সাহায্য করেছিলেন সেদিনের শাসকগোষ্ঠী।
শেখ মুজিবকে তাঁরা হুমকি দিলেন, সে হুমকি আমাদের সকলের গায়ে লাগল। শেখ মুজিবের উদ্দেশে তাঁরা প্রয়োগ করলেন অস্ত্রের ভাষা, তাতে অপমানিত বোধ করলাম আমরা। শেখ মুজিব যেখানেই বক্তৃতা করতে যান, সেখানেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, জামিন পেতে সময় লাগে। এত করেও যখন তাঁকে দমানো গেল না তখন রুজু হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা-শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামি করে। আমরাও বুঝে গেলাম, সামরিক একনায়কের তিনি এক নম্বর শত্রু। তার সঙ্গে সমস্ত জাতি এসে দাঁড়াল। জনগণের প্রতিবাদের মুখে, গণ-অভ্যুত্থানের প্রবল আলোড়নে মামলা ভেসে গেল, কারাগার থেকে মুজিব বেরিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধুরূপে। জাতির অবিসংবাদিত নেতারূপে।
বঙ্গবন্ধু আর পেছনে ফিরে তাকাননি, দেশের মানুষও নয়। ইয়াহিয়া খানের গোয়েন্দারা ভুল বুঝেছিল, বাঙালি ভুল করেনি। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয় ঐতিহাসিক, কিন্তু ১৯৭১ সালের তাঁর নেতৃত্বাধীন অসহযোগ আন্দোলন অভূতপুর্ব, তুলনারহিত। সেদিন এ দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিল অবিচ্ছেদ্যভাবে। সারা পৃথিবী অবাক হয়ে দেখেছিল এক অনগ্রসর জনপদের পঞ্চাশ একান্ন বছর বয়সের এক নেতা সমগ্র জাতিকে কী শৃঙ্খলার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে শামিল করেছে, স্থির লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হয়েছে।
তার পরের ইতিহাস প্রতারণার ইতিহাস, নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসের অমানবিক ইতিহাস। সারা পৃথিবীর বিবেকসম্পন্ন মানুষ শিউরে উঠেছিল, এসে দাঁড়িয়েছিল আমাদের পাশে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি ঘটনার মূল কেন্দ্রে অনুপস্থিত, তবু তাঁর প্রেরণা কার্যকর ছিল প্রতিটি মুহূর্তে। দেশের মানুষ তাঁর কল্যাণ কামনা করেছে। তাঁর নিরাপদ প্রত্যাবর্তন প্রার্থনা করেছে এবং এও জেনেছে যে, তিনি যদি ফিরে নাও আসেন, তাহলেও আমরা লাভ করব তাঁর শ্রেষ্ঠ উপহার-স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
তিনি ফিরে এসেছিলেন, এক বছরের মধ্যে আদর্শ স্থানীয় সংবিধান প্রণয়নে সমর্থ হয়েছিলেন, দেড় বছরের মাথায় সাধারণ নির্বাচন দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। বাস্তব পরিস্থিতির ওপরে সবটুকু নিয়ন্ত্রণের জন্য তাঁর দেওয়া সংবিধানের বড় রকম বদল তিনি নিজেই করলেন।
মানুষ যদি তার সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখে থাকে, তাঁর দানের কথা ভোলেনি। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় শক্তি দেশের মানুষের সঙ্গে একাত্মতাবোধে, তাঁর প্রতি দেশবাসীরও ভালোবাসার প্রকাশ তাঁর সঙ্গে একাত্মবোধে।
তিনি আমাদের মতো সাধারণ ঘরের মানুষ, কিন্তু হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ। আর এ অসাধারণত্বের সবচেয়ে বড় দিক হলো বাংলাদেশ নামের এই হতলাঞ্ছিত দরিদ্র জনপদের সঙ্গে তাঁর একাত্মতাবোধ। এই একাত্মতাবোধই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল আমাদের স্বাতন্ত্র ঘোষণায়, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ঝুঁকিপূর্ণ পথে অগ্রসর হতে। আত্মপরিচয়ের সংকটে তিনি ভোগেননি। নিজের বাঙালি-পরিচয়কে তিনি সবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন।
‘এই দেশেতে জন্ম, যেন এই দেশেতে মরি’-তাঁর মতো করে এই কামনা সমকালে আর কেউ করতে পেরেছেন কি না, আমার জানা নেই।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228