ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সাহিত্যে ‘বঙ্গবন্ধু-যুগ’ প্রচলন হওয়া জরুরি

মিল্টন বিশ্বাস
🕐 ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১৭, ২০১৯

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাঁহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব। তাঁহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ব্যক্তি যার মধ্যে আমরা স্বদেশকে উপলব্ধি করি। তিনি ছিলেন সমস্ত সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতিভূ। তাকে অবলম্বন করেই আমরা স্বদেশকে হানাদারমুক্ত করেছিলাম এবং স্বদেশীয় সমাজ ও জনতাকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছিলাম; গণতন্ত্রকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। আর এখনো তার মাধ্যমেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে যেমন যোগাযোগ রক্ষিত হয় তেমনি তাকে স্মরণ করেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠি।

বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘বঙ্গবন্ধু’ একটি প্রভাব বিস্তারকারী শব্দ। স্বাধীনতার আগে ভাষা-আন্দোলন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের এমন কোনো বিষয় নেই যার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ছিল না। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান ছিলেন। অর্থাৎ সে সময় তাকে কেউ অবহেলা-উপেক্ষা কিংবা বাতিল করতে পারেনি। তিনি মানুষের প্রতিটি চৈতন্যে প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং মানুষ তার সম্পর্কে কিছু না কিছু বলে আত্মতৃপ্তি অর্জন করেছে। ভারতীয় সাহিত্যে মহাত্মা গান্ধী যেমন মানুষের কাছে লেখার উৎস ও প্রেরণায় পরিণত হয়েছিলেন তেমনি বঙ্গবন্ধু অনেক লেখককেই কেবল নয় বরং দেশের শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুতে উন্মোচিত হয়েছেন। তাকে কেন্দ্র করে কবির চেতনা-মননে অব্যক্ত বেদনার নির্ঝর নিঃসরণ হয়েছে। আবার বাংলা কথাসাহিত্যে তার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দুঃখ বাংলাদেশের সাহিত্যে ‘বঙ্গবন্ধু-যুগ’ নাম দিয়ে একটি সময় বা পর্ব এখন গড়ে ওঠেনি। অথচ ভারতীয় সাহিত্যে ‘গান্ধী যুগ’ বলে একটি কালপর্ব নির্দিষ্ট হয়েছে।

বিশেষত ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সাহিত্যের দুই যুগের বেশি সময় গান্ধীযুগ হিসেবে চিহ্নিত। কেন এই চিহ্নিতকরণ? কারণ, এই মহামানবের জীবন ও কর্মের ব্যাপক প্রভাব। ভারতের এমন কোনো ভাষা-সাহিত্য-শিল্পকর্ম নেই যেখানে গান্ধীজি নেই। সেই তুলনায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্যে অপ্রতুল হলেও এই স্বাধীনতার মহানায়কের জীবন ও কর্ম আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের চেতনায় নাড়া দিয়েছে। বিশেষত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পটভূমি বিপুলসংখ্যক কবি-সাহিত্যিককে আন্দোলিত করেছে। মহানায়কের কথা, কাজ, শখ, বাগ্মীতা, বক্তব্য, তার শারীরিক অঙ্গভঙ্গি সবকিছুর দ্বারা আলোড়িত হয়েছেন সৃজনশীল ব্যক্তিরা। বাগ্মীতায় জনগণকে মুগ্ধ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। সেজন্য সামাজিক মানুষের হৃদয়ে প্রবেশে তার কষ্ট করতে হয়নি। জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহজ-সরল মাধ্যম ব্যবহার করেছেন বঙ্গবন্ধু; তাতে মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। একই কারণে গান্ধীজি পরিহিত একখণ্ড সাধারণ পোশাকই মহিমান্বিত হয়ে উঠেছিল সারা ভারতবর্ষে। গৌতম বুদ্ধ, রামকৃষ্ণ পরমহংস- এসব মহান ব্যক্তির উত্তরাধিকারই ছিলেন তিনি।

মানুষ ও তার সমাজকে নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে পাল্টানোর ক্ষমতা এদের ছিল। যদিও গান্ধীজিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন মিথ ও কিংবদন্তি আর তিনি তাই পাল্টে ফেলেছিলেন তার নীতি-আদর্শ এবং প্রচারের পন্থা। সাংবাদিকতাকে আশ্রয় করেছিলেন তিনি। ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’, ‘নবজীবন’, ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ এবং ‘হরিজন’ পত্রিকা ছিল তার মুখপত্র। আর তিনি বিরামহীনভাবে পদযাত্রা করেছিলেন ভারতবর্ষের বিস্তৃত জায়গায়। এভাবে মানুষকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন।

গান্ধীর রাজনৈতিক প্রভাব ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল, চেতনাকে করেছিল পরিশুদ্ধ, ধারণা দিয়েছিল পাল্টে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাহিত্য-চলচ্চিত্র-কবিতার মুখ্য উপাদান। ১৯৮২ সালে নির্মিত জরপযধৎফ অঃঃবহনড়ৎড়ঁময- এর ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্রটি পৃথিবীব্যাপী মানুষকে আন্দোলিত করেছিল। ইংরেজিতে লেখা মুলক রাজ আনন্দ্, রাজা রাও, আর কে নারায়ণের উপন্যাস পড়ে এ ছবির নির্মাতা গল্পের উপকরণ সাজিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ ধরনের ছবি বাংলাদেশে এখনো তৈরি হয়নি। তবে গান্ধী যেমন ভারতের ভাষা-সাহিত্যকে নতুন উদ্দীপনায় মুখরিত করেছিলেন তেমনি বাংলা সাহিত্যকে বঙ্গবন্ধু তার চিন্তা ও জীবনযাপন দিয়ে সচকিত করে তুলেছিলেন। তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনা গল্পের প্রয়োজনে পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। অধিকাংশ গল্প-উপন্যাস ঘটনাকেন্দ্রিক হলেও বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত পরিস্থিতি, তার রাজনৈতিক আদর্শ, মানুষের জন্য ত্যাগের মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। গ্রাম বাংলার সহজ-সরল মানুষের কাছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে তার মৃত্যু ছিল হাহাকারের; সেই অবস্থা তুলে ধরেছেন সাহিত্যিকরা।

যদিও কোনো উপন্যাসে ‘মুজিববাদে’র অনুপুঙ্খ রূপায়ণ নেই তবু একটি ‘বাঙালি আদর্শ’ তার জীবনকে কেন্দ্র করে তুলে ধরেছেন লেখকরা। নাগরিক মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে লোকায়ত মানসে মুজিব চিরন্তন হয়ে ওঠার কাহিনীও তৈরি হয়েছে। এই মহানায়ক জীবনকে গড়ে নিয়েছিলেন বাঙালি ঐতিহ্যের পরিপূরক করে। আর শ্রমজীবী মানুষের প্রাণের নেতা হওয়ার জন্য তাকে হাসিমুখে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। এই সাধারণ জনতার কাছে তার পৌঁছে যাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তার চেতনা ছড়িয়ে পড়েছিল যাত্রায়, পালায়, কীর্তনে। গান্ধীজি ভারতবর্ষকে ‘সীতা মা’তে পরিণত করেছিলেন আর ব্রিটিশ শাসককে করেছিলেন রাবণের প্রতীক। কেবল ধর্মভাবকে কাজে লাগিয়ে রামায়ণের ধারণা ঢুকিয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে করেছিলেন প্রসারিত। বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনতার কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন মানুষের অধিকারের কথা বলে। এজন্যই জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে তার জীবন, আদর্শ, মতবাদকে কেন্দ্র করে অসঙ্খ কবিতা লেখা হয়েছে। চিত্রকলা ছড়িয়ে পড়েছে তার অভিব্যক্তিকে কেন্দ্র করে।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে কবি-লেখকরা সামনে কোনো বিকল্প দেখতে পাননি। এ কারণে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে। এদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রও ধরেছেন কোনো কোনো লেখক। আর সেসময় থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেছেন সঙ্গোপনে। তারই পরিণতিতে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই সাহিত্যে নতুন চিন্তার অঙ্কুরোদগম হয়েছে। ধনী থেকে গরিব, জ্ঞানী থেকে নিরক্ষর তাকে কেন্দ্র করে রচিত ও পরিবেশিত গানের মুগ্ধ শ্রোতা এখনো। যে জনতা নয় মাসের যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছে সেই দেশবাসীর প্রতি তার অকৃত্রিম দরদ টের পেয়েছিলেন সবাই। অসহায়, দুঃখী, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে তাকে সাধারণ মানুষের মতোই জীবন-যাপন করতে হয়েছিল।

মূলত বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, তার অতি সাধারণ জীবন-যাপন তাকে লেখকদের কাছে ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করে। তিনি যদিও আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন কিন্তু বৃহত্তর অর্থে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বস্তরের মানুষের মাঝে। তার সম্পর্কে কিংবদন্তির প্রয়োজন ছিল না যদিও তাকে কেন্দ্র করে স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে নানান রহস্যময় ঘটনার প্রসঙ্গ। রাজা রাও, মুলক রাজ আনন্দ্ এবং আর কে নারায়ণের গল্প-উপন্যাসে গান্ধীকে যেমন কাহিনী বর্ণনায় নানা ঘটনা ও চরিত্রের বিচিত্র প্রকাশে তুলে ধরা হয়েছে; তেমনি বাংলা গল্প-উপন্যাস-কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শতাব্দী লালিত মূঢ়তা থেকে মুক্তির মন্ত্র। তার আন্দোলন ছিল হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে, দেশের কমিউনিস্ট সর্বহারাদের বিরুদ্ধে নয়। বরং সর্বহারারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিসেনাদের হত্যা করেছিল তার চিত্র রয়েছে অনেক গল্পে। সাধারণ মানুষকে অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে রক্ষার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করা ও ভালোবাসায় সবাইকে কাছে টানা ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অপরাধ ও অপরাধীকে প্রশ্রয় না দেওয়া, সৎ ও নীতিপরায়ণ থাকা এবং ভণ্ডামি না করা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না দেওয়া, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা না করা তার সমগ্র জীবনের মুখ্য আদর্শ। বর্তমান বাংলা সাহিত্যে বঙ্গবন্ধুর সেই চেতনা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্রই। এজন্যই বাংলা সাহিত্যে ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ‘বঙ্গবন্ধু-যুগ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার এখনই সময়। যদিও তার চেতনার প্রভাব শতাব্দী থেকে শতাব্দী প্রসারিত হয়েছে এবং আগামীতেও তা বহাল থাকবে তবু মাতৃভূমির জন্য তার অবদানকে স্মরণ করে সাহিত্যের ‘দশক ওয়ারি যুগ বিভাজন ও হিসেবে’র পরিবর্তে বাংলাদেশে তার আদর্শের জয়গান উচ্চারিত হবে ‘বঙ্গবন্ধু-যুগ’ চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে।

লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস,
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper