ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

যে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে

সাইদ রহমান
🕐 ১০:২২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৯

ভাষা আন্দোলন স্ফুলিঙ্গ শুধু ঢাকায় নয়, ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশের আনাচে কানাচে, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। বৃহত্তর ও অগ্রসর জেলাগুলোতে এই আন্দোলনের শুরু থেকেই নিয়মিত সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ ছিল চোখে পড়ার মতো।

রংপুরের ছাত্রসমাজ ভাষা সংগ্রামের পুরো সময়জুড়ে ধারাবাহিক আন্দোলন করেছে। তবে এর মধ্যে ১৯৫১ সালে ঘটে গেছে এক অভূতপূর্ব ঘটনা, আন্দোলনে যা নতুন মাত্রা যোগ করে। ছাত্র-ছাত্রীদের একটি মিছিল যাচ্ছিল রংপুর জজকোর্টের সামনে দিয়ে। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে মুহূর্তেই মিছিলটি ঢুকে পড়ে আদালত চত্বরে। মিছিল থেকে এক দুঃসাহসী ছাত্রী সোজা এজলাসে গিয়ে জজের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কেন আপনি ইংরেজিতে রায় লিখছেন?’ ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই জজের হাত থেকে কলমটি ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙে ফেলেন সেই দুঃসাহসী ছাত্রী। সঙ্গে সঙ্গেই এজলাস ত্যাগ করে সেই ছাত্রী আবার মিছিলে যোগ দেন। দুঃসাহসী সেই ছাত্রী ছিলেন একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে রংপুরের অন্যতম শহীদ, রংপুর শহরের মুন্সীপাড়ার বিখ্যাত কাজী পরিবারের সদস্য শহীদ মিলি চৌধুরী। একজন ছাত্রীর এই সাহস সেদিন রংপুরে ভাষা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। এ ছাড়াও রংপুরের ভাষা সৈনিকদের মধ্যে প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও শিক্ষক শাহ আবদুর রাজ্জাক ও শাহ তবিবর রহমান অন্যতম।

ভাষা আন্দোলনে প্রতিবাদে মুখর ছিল চট্টগ্রামের শিক্ষার্থী-জনতা। ১৯৪৭-৪৮ সালেই তমুদ্দুন মজলিসের শাখা গঠিত হয় চট্টগ্রাম ডিগ্রি কলেজের ছাত্র সোলায়মান খানের উদ্যোগে। সোলায়মান খান ছাড়াও চট্টগ্রাম তমুদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক চৌধুরী শাহাবুদ্দীন খালেদ, ড. মাহফুজুল হক, ইব্রাহীম চৌধুরী, অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সোলায়মান প্রমুখ ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামের হরিখোলার মাঠে ৪ দিনব্যাপী সংস্কৃতি সম্মেলনে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সভাপতির যে ভাষণটি প্রদান করেন সেটি শুধু বাংলা ভাষা নয়, পূর্ব বাংলার স্বাধিকার চিন্তা ও জাতির সাংস্কৃতিক আধারকে বেগবান করে তুলেছিল। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে ধর্মঘট ও হরতাল পালিত হয়। আন্দরকিল্লায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তরুণ সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীকে আহ্বায়ক, আওয়ামী মুসলিম লীগ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ ও রেল শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুনর রশিদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। কমিটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ক্লাব, যুব সম্প্রদায়, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শ্রমজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত হন।

মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ছোঁয়া খুব সহজেই এসে লাগে বরিশালে। কারণ রাষ্ট্রভাষার জন্য গঠিত কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন বরিশালের কৃতি সন্তান কাজী গোলাম মাহবুব। ১৯৪৭ সালের শেষভাগে বরিশালের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম কবীর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার ওপর একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেন। সভায় বাংলার পক্ষে বক্তব্য রাখেন অ্যাডভোকেট অবনী ঘোষ, অ্যাডভোকেট মোবারক আলী, রফিকুল ইসলাম, বি এম কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ডি এন চ্যাটার্জি । বরিশালে ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিএম কলেজের ছাত্ররা ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। তারা পৃথক ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন। এর আহ্বায়ক ছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি এবং বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া।

সিলেটে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ১৯৫২ সালের বেশ আগে। সিলেটের মানুষ ১৯৪৭ সাল থেকেই তাদের অসন্তোষ প্রকাশ শুরু করে। ওই সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে সিলেটে প্রকাশ্যে সভাও হয়েছে। সিলেটে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন সিলেট আইন মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সদস্য মনির উদ্দিন আহমদ। ১৯৫২ সালে তিনি সিলেট জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন। তার মতে, ভাষার দাবিতে সিলেটে প্রথম প্রকাশ্য সভা হয় ১৯৪৭ সালের ৯ নভেম্বর। সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের ওই সভার মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। ১৯৪৮ সালের ১১ জানুয়ারি পাকিস্তানের যোগাযোগমন্ত্রী আবদুর রব নিশতার সিলেটে এলে মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আবদুস সামাদের (আবদুস সামাদ আজাদ) নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হিসেবে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করার দাবি জানান।

রাজশাহীতে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম বাংলা ভাষার পক্ষে মিছিল হয়। শহরের ভুবন মোহন পার্কে অনুষ্ঠিত এ সভায় লোকনাথ হাইস্কুলের শিক্ষক আব্দুস সাত্তার মাস্টার-এর বক্তব্যে জেগে উঠেছিল রাজশাহীর ছাত্র-জনতা। ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ দেশব্যাপী ‘ভাষা দিবস’ উদযাপন হয়েছিল। এ উপলক্ষে রাজশাহী কলেজের ছাত্রদের একটি মিছিল শহর প্রকম্পিত করে ফায়ার বিগ্রেডে পৌঁছাতেই সরকারের মদদপুষ্ট পুলিশ বাহিনী মিছিলে অতর্কিত হামলা করে পেটাতে থাকে। এতে গোলাম রহমান, আব্দুল লতিফ, ব্রতিষ ঘোষ, ফজলুল রহমান, এমএজি তওয়াবসহ আরো অনেকেই আহত ও রক্তাক্ত হন।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper