ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের সাহিত্য

রফিকউল্লাহ খান
🕐 ৯:৫১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৮

বাঙালি জীবনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা বৈপ্লবিক যুগান্তরের সম্ভাবনায় তাৎপর্যবহ ও সদূরপ্রসারী। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি স্বৈরশাসনবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনের অনিঃশেষ চেতনা আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের মতো শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের গণজাগরণ ও বৈপ্লবিক চেতনার স্পর্শে এক অপরিমেয় সম্ভাবনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে আমাদের সাহিত্যলোক। সেই উজ্জীবনী শক্তি একাত্তরের রক্তস্নাত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সময়েও বহমান।

সংগত কারণেই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমাদের জীবনে ও সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে নতুন করে মূল্যায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। স্মৃতি ও বিস্মৃতির দোলাচলে বাঙালি জাতিসত্তা যেরূপ বিভ্রান্তি ও সংকটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, জাতীয় জীবনের এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের সেই রেনেসাঁসীয় গতি ও শক্তির পুনঃপর্যবেক্ষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কেবল বর্তমান প্রজন্মের জন্যই নয়, বিভ্রান্তিপ্রবণ সমাজমানসের জন্যও এই পর্যবেক্ষণের উপযোগিতা কম নয়।
স্থুল অর্থে স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশে সাহিত্যে বিভাগোত্তর কাল অপেক্ষা একটি নতুন বিষয় সংযোজিত হয়েছে। সে বিষয়টি হলো, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু গভীরতর অর্থে, চেতনার পরিমাপে মুক্তিযুদ্ধ একটি ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক রূপ ও স্বরূপে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যে অভিব্যক্ত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সংরক্ত চেতনা, গণতন্ত্রায়ন ও শিল্পায়নের অবাধ বিকাশের সম্ভাবনায় নবগঠিত রাষ্ট্রসত্তায় ব্যক্তির আকাশচুম্বী স্বপ্ন একটা সামষ্টিক চরিত্র নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে ষাটের দশকের শেষার্ধে উদ্ভূত অনেক কবি এবং সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক জঙ্গমতার মধ্যে আত্মপ্রকাশকামী তরুণ কবিদের মধ্যে কখনো কখনো চেতনাগত ঐক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ষাটের দশকের অনেক কবি স্ব-উদ্ভাবিত পরিণত আঙ্গিকে অভিন্ন কাব্যসত্তাকেই যেন প্রকাশ করলেন। পঞ্চাশের দশকের শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী এবং ষাটের দশকের অধিকাংশ কবিই নিজস্ব কাব্য-অবয়বে সমকালের সংরক্ত চেতনা ধারণ করলেন। ষাটের দশকের শেষদিকে আবির্ভূত বেশ কয়েকজন কবি এ সময়ে আত্মপ্রকাশের তীব্রতায়, ব্যক্তি ও সমষ্টির নির্বাধ আবেগজীবন উন্মোচনের ঐকান্তিকতায় এবং দেশপ্রেমের রক্তিম কাব্যকলা সৃষ্টিতে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টিতে সমর্থ হন। মুক্তিযুদ্ধের পর চল্লিশ, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের কবিরা আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব কাব্যসত্তার সন্ধান পেলেন। সৃজন-মননের যৌথ রাগে অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানকে তারা নিজ নিজ বোধের মাত্রা অনুযায়ী রূপদান করলেন। এ সময়ে কবিতাচর্চায় সক্রিয় আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান এবং সানাউল হকের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ নতুন বোধের উৎসমুখ হয়ে উঠেছে। যেমন, কোথাও পড়ে না চোখে বধ্যভূমি, অথচ প্রত্যহ/নিহতের সংখ্যা বাড়ে। কোথাও একটিও/লাশ কিংবা কবর পড়ে না চোখে, অথচ প্রত্যহ/শবাধার ব্যস্ত হয়ে হেঁটে যায় এবাড়ি ওবাড়ি। (আহসান হাবীব) অনেক শেখানো অনেক পড়ানো/বহু পুরুষের মর্চে ধরানো/ভাগ্যটার/ঝুঁটি ধরে নাড়া দেবার সময়/এসেছে এবার...(আবুল হোসেন) আমার মনে হয়/সমুদ্রের সামনে যুগ-যুগান্তের সাক্ষ্য বিদ্যমান/মহাকালকে এখানে অনুধাবন করা যায় একটি/প্রার্থনার কাম্যে। (সৈয়দ আলী আহসান)।
উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুচ্ছ পরিণত অভিজ্ঞতা ও গভীরতর আবেগধর্মের সাক্ষ্যবাহী। পঞ্চাশের দশকে উদ্ভূত কবিদের চেতনা ও সৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের আবেদন বহুমাত্রিক। শামসুর রাহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হাসান হাফিজুর রহমান, আজীজুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ফজল শাহাবুদ্দীন, জিয়া হায়দার, আবুবকর সিদ্দিক, শহীদ কাদরী প্রমুখ যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর জীবনসমগ্রতার অঙ্গীকারকে বিচিত্রভাবে প্রকাশ করেছেন। ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে সিকদার আমিনুল হক, আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, মহাদেব সাহা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান প্রমুখ কবিতার বিপ্রতীপ এক নতুন ধারা সৃষ্টি করলেন। ষাটের দশকের উপান্তে নির্মলেন্দু গুণের সমাজ ও রাজনীতিমনস্কতা, আবুল হাসানের ব্যক্তির আত্মরতি, নৈঃসঙ্গ ও আত্মহননেচ্ছা এবং মোহাম্মদ নূরুল হুদার ঐতিহ্যমনস্কতা সমাজ-চৈতন্যের ত্রিমুখী প্রান্তকে অভিন্ন বিন্দুতে সমন্বিত করার প্রবণতায় বিশিষ্ট। কিন্তু চল্লিশ, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে গঠনমানে মধ্যবিত্তের আত্মপ্রতিষ্ঠার তীব্র প্রচেষ্টার প্রতিফলন ঘটেছিল। ফলে প্রত্যেক কবির মধ্যেই এক ধরনের স্বাবলম্বী কাব্যসত্তা নির্মাণের প্রয়াস সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ষাটের দশকের শেষার্ধে অবির্ভূত বেশ কয়েকজন কবি স্বাধীনতাযুদ্ধের অব্যবহিত আগে ও পরে আত্মপ্রকাশের তীব্রতায়, ব্যক্তি ও সমষ্টির আবেগ-জীবন উন্মোচনের ঐকান্তিকতায় এবং দেশপ্রেমের জনরঞ্জক কাব্যকলা সৃষ্টিতে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যে আসাদ চৌধুরী, মাহমুদ আল জামান, হুমায়ুন কবির, হুমায়ুন আজাদ, সানাউল হক খান, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, জাহিদুল হক, অসীম সাহা, সাজ্জাদ কাদির, মাহবুব সাদিক, হেলাল হাফিজ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এসব কবির মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী কবিতায় আমরা লক্ষ করব সমাজসত্তা ও ব্যক্তিসত্তার টানাপড়েন, আত্মকেন্দ্রিকতার আতিশয্য, ব্যক্তিত্ববর্জিত আত্মরতি ও আত্মকুণ্ডলায়ন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের কবিতাকে বারবার ফিরে আসতে হয়েছে সমষ্টিজীবনের আঙিনায়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বাস্তবতাই প্রতিনিয়ত অনিবার্য করে তুলেছে আত্মসন্ধান ও সত্তাসন্ধানের প্রাসঙ্গিকতা। জীবনাবেগের এই সংরক্ত, তীব্র ও গভীর অন্তর্লক্ষণকে ধারণ করবার মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যকর্মের সাফল্য সূত্র। বিশেষ করে, কথাসাহিত্য বিবেচনার ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য প্রযোজ্য। আর্থসামাজিক কাঠামো এবং চেতনার এই বিবর্তনের পটভূমিতেই বিবেচ্য আমাদের কথাসাহিত্যের গতিপ্রকৃতি, স্বভাবধর্ম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত উপন্যাসের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞান ও জীবনবোধের সংশ্লেষ সেখানে দুর্লক্ষ্য। ঔপন্যাসিকের জীবনচেতনা ও সমাজবোধের গভীরতা কোনো কোনো উপন্যাসকে তীব্র, তীক্ষণ, গূঢ়ভাষী শিল্পকর্মে পরিণত করেছে। শহীদ আনোয়ার পাশার (১৯২৮-৭১) রাইফেল রোটি আওরাত (১৯৭৩) আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার বস্তুনিষ্ঠ শিল্পরূপ। উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাস। উপন্যাসের নায়ক সুদীপ্ত শাহীন প্রকৃতপক্ষে আনোয়ার পাশারই আত্মপ্রতিবাসের প্রতিচিত্র। পঁচিশে মার্চের সেই কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়াল, নির্মম, জান্তব নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত সময়ের অনুপুঙ্খ উপস্থাপন ঘটেছে এই উপন্যাসে। সুদীপ্ত শাহীনের অভিজ্ঞতায় সেই বীভৎস, দীর্ণ নগ্ন রূপ পাঠককে আতঙ্কিত ও শিহরিত করে বটে, কিন্তু প্রত্যক্ষ অবলোকনের অবিকল উন্মোচন আমাদের জীবনের এক বস্তুসত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, যার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের সংখ্যা চার : জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), দুই সৈনিক (১৯৭৩) এবং জলাঙ্গী (১৯৭৬)। যে ব্যাপক, গভীর ও সমগ্রতাস্পর্শী জীবন-অনুধান উপন্যাস নির্মিতের মৌল শর্ত, মুক্তিযুদ্ধ আশ্রয়ী উপন্যাসে শওকত ওসমান সে শর্ত পূরণে যেন অমনোযোগী। শওকত আলীর যাত্রা (১৯৭৬), রশীদ হায়দারের খাঁচায় (১৯৭৫) ও অন্ধ কথামালা (১৯৮১), মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন (১৯৭৬), সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬), সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের জীবনতরু, রাবেয়া খাতুনের ফেরারী সূর্য (১৯৭৪), আমজাদ হোসেনের অবেলায় অসময় (১৯৭৫), মিরজা আবদুল হাইয়ের ফিরে চলো (১৯৮১) প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধের উপকরণনির্ভর উল্লে¬খযোগ্য উপন্যাস। গ্রাম এবং নগরজীবনের পটভূমিকায় মুক্তিযুদ্ধকালে বিচিত্র প্রসঙ্গ উল্লিখিত উপন্যাসগুলো বিন্যস্ত হয়েছে।
রশীদ করিমের আমার যত গ্লানি (১৯৭৩) এবং মাহবুব তালুকদারের অবতার (১৯৭৩) মুক্তিযুদ্ধকালীন মধ্যবিত্তের জীবনযন্ত্রণার শিল্পরূপ। উপন্যাস হিসেবে ততটা সাফল্যস্পর্শী না হলেও ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থের বন্দি দিন বন্দি রাত্রির (১৯৭৬) চেতনা ও বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধের মৌল আবেগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। হুমায়ূন আহমেদের শ্যামল ছায়া (১৯৭৩), সৌরভ (১৯৮৪) এবং ১৯৭১ (১৯৮৬) উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকালে বিবিধ প্রসঙ্গ বিন্যস্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধের অনুষঙ্গবাহী সার্থক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে যার নাম স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখযোগ্য, তিনি সৈয়দ শামসুল হক। নিষিদ্ধ লোবান’এ রতি চেতনার (libido) আধিক্য থাকলেও বিলকিসের পরিণাম ইতিবাচক সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল। তার দ্বিতীয় দিনের কাহিনী (১৯৮৪) বিষয় ও আঙ্গিকে এ ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। শিক্ষক তাহেরের স্মৃতিচারণা ও আত্মোপলব্ধি মুক্তিযুদ্ধের পরিসরকে ব্যপ্ত সমগ্র ও দূরসঞ্চারী চেতনায় উদ্ভাসিত করে। নিষিদ্ধ লোবান থেকে বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ পর্যন্ত উপন্যাসগুলো বিশ্লেষণ করলে কেবল সৈয়দ হকের শিল্পীসত্তা নয়, বাঙালি জাতিসত্তার ক্রম রূপান্তরের ইতিহাসও অনেকটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
গতিশীল চেতনার শিল্পপ্রয়াসের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ছোটগল্পের গৌরবময় স্বাতন্ত্র্য। কবিতা কিংবা উপন্যাস অপেক্ষা ছোটগল্পের অবয়বেই বাংলাদেশের কথাশিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য শিল্পরূপ নির্মাণে বেশি মাত্রায় সমর্থ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী-সম্পাদিত বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭১) সংকলন। সংগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার তীব্র, তীক্ষ্ম, রক্তাক্ত অনুভবই সংকলনভুক্ত গল্পগুলোর বৈশিষ্ট্য। গ্রন্থটিতে সন্নিবেশিত বাংলাদেশের কয়েকজন তরুণ ও প্রবীণ কথাশিল্পীর লেখা গল্পগুলো তাই নিছক যুদ্ধ-সাহিত্য নয়; বরং বাঙালি জাতীয় মানসের বর্তমান বিপ্লবী প্রতিরোধ চেতনার কয়েকটি রূপরেখা।’ গ্রন্থ-অন্তর্ভুক্ত ষোলোটি গল্পের সবগুলোই যে সাফল্যস্পর্শী হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে সময়ের তীব্র টান প্রতিটি গল্পেই বিধৃত। কেবল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটগল্প সংকলনের সংখ্যাও কম নয়। যেমন বশীর আল হেলালের প্রথম কৃষ্ণচ‚ড়া (১৯৭২), হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), শওকত ওসমানের জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৭৫), আবু জাফর শামসুদ্দীনের রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা (১৯৭৭), আবুবকর সিদ্দিকের মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৭৭), সাদেকা সফিউল্লাহর যুদ্ধ অবশেষে (১৯৮০), খালেদা সালাহউদ্দিনের যখন রুদ্ধশ্বাস (১৯৮৬), এহসান চৌধুরীর একাত্তরের গল্প (১৯৮৬), সৈয়দ ইকবালের একদিন বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য গল্প (১৯৮৬), সৈয়দ শামসুল হকের জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০) বিপ্রদাস বড়ুয়ার যুদ্ধ জয়ের গল্প (১৯৮৫), সাদা কফিন (১৯৮৪) ও মুক্তিযোদ্ধারা (১৯৯১); কাজী জাকির হাসানের যুদ্ধের গল্প (১৯৯১) সেলিনা হোসেনের পরজন্ম মুক্তিযুদ্ধকালীন জীবন ও তৎসংলগ্ন চেতনার বিচিত্রমাত্রিক অনুভবের শব্দরূপ। এ ছাড়াও সৈয়দ শামসুল হকের প্রাচীন বংশে নিঃস্ব সন্তান (১৯৮১) বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের মু হীন মহারাজ (১৯৭৪), শওকত আলীর লেলিহান সাধ (১৯৭৭), রাবেয়া খাতুনের মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী (১৯৮৬) রশিদ হায়দারের তখন (১৯৮৭) হারুন হাবীবের বিদ্রোহী ও আপন পদাবলী (১৯৮৫) প্রভৃতি গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধ-আশ্রয়ী গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আবুল হাসনাত-সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৮৩) হারুন হাবীব-সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প (১৯৮৫) এবং মুক্তিযোদ্ধার গল্প (১৯৯১) গ্রন্থের প্রবীণ ও নবীন গল্পকারদের মুক্তিযুদ্ধ-আশ্রয়ী জীবন-চেতনার বিন্যাস ঘটেছে। বিষয় ও ভাবের দিক থেকে বাংলাদেশের ছোটগল্পে যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে তেমনি ভাষা ব্যবহার এবং অলঙ্কার-সৃজনেও মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ উপস্থিত। ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্নভাবে। কখনো সরাসরি যুদ্ধকে অবলম্বন করে ছোটগল্প রচিত হয়েছে, কখনো বা ছোটগল্পের মৌল ভাব সৃষ্ট হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে। কোনো কোনো ছোটগল্পে স্বাধীনতার স্বপক্ষীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং বিপক্ষীয়দের প্রতি ঘৃণাবোধ উচ্চারিত হয়েছে। আবার কোথাও বা ছোটগল্পের বহিরঙ্গে লেগেছে মক্তিযুদ্ধের স্পর্শ। মুক্তিযুদ্ধের উপাদানপুঞ্জ ব্যবহার করে বাংলাদেশের প্রায় সব গল্পকারই রচনা করেছেন ছোটগল্প।
সময়পরম্পরায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ সংগ্রাম, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্বক্ষত আন্দোলন প্রভৃতি ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার সংগ্রামশীল ও রক্তিম চেতনার রূপ ও রূপান্তরের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালের ক্রমবর্ধমান সমাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা এবং মানব-অস্তিত্বের নানামুখী সংকট কবিতা-গল্প-উপন্যাসে বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পরূপকেও প্রভাবিত করেছে।

লেখক : উপাচার্য, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper