প্রথম শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা
সাত কোটি এই দাবির মৃত্যু তুমি
কাজী রোজী
🕐 ১২:৪৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৮
কবি মেহেরুন্নেসার জন্ম কলকাতার খিদিরপুরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম শহীদ নারী কবি মেহেরুন্নেসা। মেহেরুন্নেসা একাডেমিক লেখাপড়া জানতেন না অর্থাৎ তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। কোনোদিন স্কুলে যাননি, মা এবং বড় বোনের কাছেই তার হাতেখড়ি। চমৎকার সাধারণ সরল মেয়ে ছিলেন। বাংলা একাডেমির কপিরাইটার ছিলেন একসময়। মেহেরের পরিবার মিরপুর ৬-এর ডি ব্লকে থাকত। আর আমার বাসা ছিল সি ব্লকে। আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। অনেকদিন এমনও হয়েছে ভাত দুইটা খেয়েই তার বাসায় চলে গিয়েছি। আর তার মার সে কি আপ্যায়ন! মুড়ি, পিঠা কতকিছু যে দিত! ফিরতেই দিত না।
মেহের ‘রানু আপা’ নামে, ‘পাকিস্তানি খবর’-এর মহিলামহল পাতার সম্পাদনা করতেন। তিনি ছিলেন সত্যিকার কবিতাকর্মী। খুব আত্মবিশ্বাস ও সাহসিকতার সঙ্গে তিনি জনতার সারিতে এসে দাঁড়াতেন। কবি প্রতিভা দিয়ে তিনি আদায় করে নিয়েছিলেন কবি সুফিয়া কামালের স্নেহ আনুকূল্য। কবি আবদুস সাত্তার ছিলেন মেহেরের অন্যতম বন্ধু। ‘বেগম’ পত্রিকায় তার শেষ কবিতা, ‘জনতা জেগেছে’ প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ (তাকে হত্যা করার মাত্র তিন দিন পূর্বে)।
একাত্তরে অবাঙালি অধ্যুষিত মিরপুরে আমার নেতৃত্বে অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন কবি মেহেরুন্নেসা। তিনি বিহারিদের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকা কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২৩ মার্চ সকাল ১০টায় নিজেদের বাড়িতে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। এই অপরাধে ২৭ মার্চ তার মা, দুই ভাই ও তাকে নির্মম-নিষ্ঠুর বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়।
আমরা সমস্ত মিরপুর অঞ্চল নিয়েই এ অ্যাকশন কমিটি করেছিলাম। একবার মিরপুর-১ নাম্বারে একটা স্কুলে মিটিংয়ের সময়ে আমাকে মারার জন্য অবাঙালিরা তৎপর হয়ে উঠেছিল। তখন শহীদ মামা আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। মামা আমাকে আগলে রেখে সামনে থেকে আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। এই মিরপুরের বাংলা স্কুলে অবাঙালিরা বস্তাভরা বাঙালিদের চোখ ফেলে রেখেছিল।
মিরপুরের আইসক্রিম ফ্যাক্টরি, আয়রন ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে বেরিয়েছি আমি আর মেহের। যাতে অবাঙালিরা আমাদের একটা ছেলেকে অন্তত চাকরি দেয়। তারা দেয়নি কোনোদিন। মেহের একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘রোজী, আমাদের অপরাধটা কি?’ আমি বললাম অপরাধ একটাই ‘আমরা বাঙলায় কথা বলি, বাঙালি। ওরা উর্দুতে কথা বলে ও অবাঙালি।’
এগারো নম্বর বাসস্ট্যান্ডের কাছে ছোট্ট এক বাঙালি ছেলের দোকান ছিল। টুকটাক জিনিসপত্র বিক্রি করত। আমরা দূর থেকে দেখলাম, কীভাবে অবাঙালিরা দোকান ভেঙে লুটপাট করেছে। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে আমাদের কাছে দৌড়ে এলো। আমি আর মেহের কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে কোনো রকমের সান্তনা দিলাম।
মিরপুরের আতঙ্ক কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আমি এমনি এমনি দাঁড়াইনি। ট্রাইব্যুনালে বলেছি, ‘কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে দাঁড়িয়েছি, মাই লর্ড।’
মেহেরের মা বুকে কোরআন নিয়ে বলেছিল, ‘আমি তো কলমা জানি, বাবা! আমি তো আরবি পড়তে পারি। আমাকে কেন মারবে?’ ওরা কেউ কিছু শুনেনি। ওই কাদের মোল্লার সহচর অনুচররা বাড়িতে ঢুকে মেহেরের পরিবারকে জবাই করে হত্যা করেছিল। সেদিনই আমি মাটি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এদের বিরুদ্ধে এক দিন না এক দিন রুখে দাঁড়াবোই।
২০১২ সাল। আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত। রোজার দিন। খেতে পারছিলাম না। তারপরও ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যগ্রহণের সময় বলেছি, “ভাষার দাবিতে মাহবুবুল আলম চৌধুরী যখন বলেছিলেন, ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’ ঠিক একই কথার পুনরাবৃত্তি করে গেলাম মাই লর্ড। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আমি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।”
মেহেরুন্নেসার শেষ কবিতা
জনতা জেগেছে
মুক্তি শপথে দীপ্ত আমরা দূরন্ত দুর্বার,
সাত কোটি বীর জনতা জেগেছি, এই জয় বাঙলার।
পাহাড় সাগর, নদী প্রান্তর জুড়ে
আমরা জেগেছি, নবচেতনার ন্যায্য নবাঙ্কুরে।
বাঁচবার আর বাঁচাবার দাবি দীপ্ত শপথে জ্বলি,
আমরা দিয়েছি সব ভীরুতাকে পূর্ণ জলাঞ্জলি।
কায়েমি স্বার্থবাদীর চেতনা আমরা দিয়েছি নাড়া,
জয় বাঙলার সাত কোটি বীর, মুক্তি সড়কে খাড়া।
গণতন্ত্রের দীপ্ত শপথে কণ্ঠে কণ্ঠে সাধা-
আমরা ভেঙ্গেছি, জয় বাঙলার যত বিজয়ের বাধা।
কায়েমি স্বার্থবাদী হে মহল! কান পেতে শুধু শোনো-
সাত কোটি জয় বাঙলার বীর! ভয় করিনাকো কোনো।
বেয়নেট আর বুলেটের ঝড় ঠেলে-
চিরবিজয়ের পতাকাকে দেবো, সপ্ত আকাশে মেলে।
আনো দেখি সাত কোটি এই দাবির মৃত্যু তুমি,
চিরবিজয়ের অটল শপথ, এ জয় বাঙলা ভূমি।
[সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকায় কবির মৃত্যুর ঠিক ৪ দিন আগে প্রকাশিত]
লেখক : কবি, সংসদ সদস্য
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228