দেশ অন্তঃপ্রাণ
কাজল রশীদ শাহীন
🕐 ১২:২৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৮
শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসান। লেখালেখিতে অন্তঃপ্রাণ এই শিক্ষক প্রগতি পন্থায় সমর্পিত থেকে সারা জীবন কাটিয়েছেন নেপথ্যে, নীরবে-নিভৃতে। তার অপ্রকাশিত লেখা, ডায়েরি ও চিঠিপত্রে দেশপ্রেমের নেপথ্য-নায়কের চিত্র মূর্ত হয়েছে। জন্মসূত্রে তিনি বাংলাদেশি না হলেও ভেতরে-বাইরে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশটির প্রতি ছিল তার নিবিড় টান। এমনকি মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তিনি দেশপ্রেমের প্রশ্নে আপস করেননি। দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে শতভাগ নিমগ্ন থেকে আত্মোৎসর্গে উজ্জ্বল প্রতিভূত হয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক রাশীদুল হাসান।
বাঙালি জাতির সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত একাত্তরের দিনগুলোতে তিনি রাজধানী ঢাকায় থেকেছেন। তবে আত্মগোপন কিংবা নীরবে-নিভৃতে- লোকচক্ষুর আড়ালে নয়, শিক্ষকতার মহান পেশায়। প্রতিটি ক্লাসে ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। যুদ্ধাক্রান্ত এই দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সর্বস্ব দিয়ে দেশমাতৃকার সেবা করতে।
মুক্তবুদ্ধি, অসাম্প্রদায়িক ও বামপন্থী চিন্তাধারার অধিকারী রাশীদুল হাসান বাঙালির প্রতিটি আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। কবিতা, প্রবন্ধ ও নিয়মিত দিনপঞ্জি লেখার অভ্যাস ছিল। ১৯৭১-এর অপ্রকাশিত ডায়েরির একুশে ফেব্রুয়ারিতে তিনি লিখেছেন ‘আটই ফাল্গুন বা একুশে ফেব্রুয়ারির নানা তাৎপর্য আজ আবিষ্কৃত এবং এখনো ক্রমাবিকাশমান। প্রথমত, এ ছিল বাঙলাদেশের বা পূর্ব পাকিস্তানের পাঁচ কোটি বাঙালির মাতৃভাষা বাঙলার রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতির আন্দোলন। পরে এই আন্দোলন বাঙলাদেশের সর্বক্ষেত্রে সর্বাত্মক মুক্তির প্রতীকে উন্নীত হলো। আমার কাছে এই আন্দোলনের যে চেহারা আজ প্রকাশিত, তার দুটি দিক সব থেকে তাৎপর্যময়। প্রথম, এর সবল ও সপ্রাণ সৃষ্টিশীলতা। সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি ও সমাজনীতির সর্বক্ষেত্রে একটা স্বনিষ্ঠ ও বেগবান আত্মজিজ্ঞাসা। এক পবিত্র এ নির্মল আত্মাবিষ্কার। দ্বিতীয়, এর সর্বজনীনতা, ধর্ম-বর্ণ সমাজ ও বিশ্বাস নির্বিশেষে এই প্রথম সবার আপন উৎসব বাঙালিরা পেল। ঈদোৎসব যেমন মুসলমানের পুজোৎসব যেমন হিন্দুর, একুশে ফেব্রুয়ারি বা আটই ফাল্গুনোৎসব তেমন নয়, এ উৎসব বাঙলা ভাষাভাষী হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের একান্ত আপনার মহোৎসব।’
রাশীদুল হাসান ওপার বাংলার বীরভূমের বড়শিজা গ্রামে ১৯৩২ সালের ১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার ভাবতা আজিজিয়া মাদ্রাসা থেকে মেট্রিক এবং ১৯৪৯ সালে আইএ পাস করেন ঢাকার ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে।
১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক এবং ১৯৫৮ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ১৯৫৪-৫৫ সাল নরসিংদী, ১৯৫৬-৫৯ সাল পাবনা এডওয়ার্ড এবং ১৯৫৯-৬৭ সাল পর্যন্ত বীরভূম জেলার কৃষ্ণচন্দ্র কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের লেকচারার ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তার প্রিয় শিক্ষাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ছিলেন। এমনকি শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবেও তিনি সমাহিত হয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে। ‘হে আমার দেশ’ শিরোনামের একটি কবিতাতে তার মনোবাঞ্ছা প্রকাশ পেয়েছে এভাবে: হে আমার দেশ/আমি তোমার সঙ্গে আছি/সুখে শোকে অজস্র সংকটে/যে তোমাকে ছেড়ে যাবে যাক/আমি যাবো নাকো/চিরকাল র’বো আমি/তোমার আত্মার আত্মীয় হয়ে/তোমার নিঃস্বতা আজ আমার ভূষণ।... তোমার নিঃস্বতা দিয়ে/তোমার হৃদয়ে আজ/আমার হৃদয়/কথা কয়।/হে আমার দেশ/তুমি আমি আজ/এমন গভীর কাছাকাছি!!
শিক্ষার্থী-অন্তঃপ্রাণ ছিলেন রাশীদুল হাসান। স্ত্রীকে লেখা অপ্রকাশিত এক চিঠিতে তার সেই মনোবাঞ্ছার প্রকাশ ঘটেছে এভাবে: ‘আগামী ১৯ শে অক্টোবর (১৯৬৭) ইউনিভার্সিটি খুলবে। সেই দিন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হবে। দোয়া কোরো, আমি কলেজ জীবনে যেমন সুনামের সঙ্গে অধ্যাপনা করে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন সেই সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে পারি।’
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে রাশীদুল হাসানকে। ওই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার কথা বলেন, দেশপ্রেমের কথা বলেন। চিরদিনের শান্ত, সৌম্য মানুষটি হানাদার বাহিনীর কাছেও এই সত্য স্বীকার করেছিলেন। মৃত্যু-শঙ্কা আছে জেনেও তিনি বলেছিলেন, ‘একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি যা বলেছেন, ঠিক বলেছেন। এটাকে তিনি তার কর্তব্য বলে মনে করেন। দেশের এই সংকটে একজন শিক্ষক হিসেবে এটাকে তার অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব বলে মনে করেন।’
এরপর ১২ দিন নাজিমউদ্দিন রোডের জেলখানায় আটক রাখা হয় রাশীদুল হাসানকে। নানা প্রকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়, পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায়-অত্যাচারের সাফাই গাওয়ার জন্য ও তাদের পক্ষে মিথ্যে বিবৃতি দেওয়ার জন্য। কিন্তু দেশপ্রেমের প্রশ্নে আপসহীন আর সত্যের পথে অবিচল রাশীদুল হাসানকে দিয়ে এই কাজটি করানো সম্ভব হয়নি। তাকে কাফের, মুরতাদ, নাস্তিক নানা ফতোয়া দেওয়া হয়। দেশদ্রোহীর তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় তার নামের সঙ্গে। কিন্তু তার সুললিত কণ্ঠে কোরআন শরিফের সুরা রাহমান-এর পাঠ শুনে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে পাকিস্তানি এক মেজর জেলখানা থেকে ছেড়ে দেন তাকে।
মুক্তজীবনে ফিরে এসে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। বন্ধু আর স্বজনদের অনেকেই নিষেধ করেন। কিন্তু চেতনা যার নায়কোচিত পৌরুষতুল্য, তিনি তো থেমে যাওয়ার কিংবা দমবার মানুষ নন। শহীদ হওয়ার মাত্র দুই দিন আগে, ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন
আমাদের রাত্রিগুলো
আমাদের রাত্রিগুলো মাছের পেটের মুন
সারা রাত আমরা সব জান-নূন হয়ে আছি
আমাদের প্রার্থনার ধ্বনি
তোমার প্রাণে কী পৌঁছাবে?
আমরা সবাই আজ প্রার্থনার মতো
আমরা সবাই আজ প্রতীক্ষার
বিগলিত মুহূর্তের ধারা
আমাদের রাত্রিগুলো
ইস্রাফীলের শিঙ্গা হয়ে ঝরে
আমাদের রাত্রিগুলো
ভয়ঙ্কর ঝড়ের মুন
হলুদ পাতার মতো আমরা সব ঘুরপাক খাই
আমাদের প্রার্থনার ধ্বনি
তোমার প্রাণে কি পৌঁছেনি?
রাশীদুল হাসানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা। যার বিখ্যাত উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত-এর সাক্ষী ছিলেন মাত্র দুজন মানুষ। তারা হলেন রাশীদুল হাসান ও তার স্ত্রী বেগম রোকাইয়া রশীদ। আলবদর বাহিনীর হাতে দুই বন্ধু ধৃতও হন একই সঙ্গে। এবং একত্রেই নির্মম মৃত্যুর শিকার ও সমাহিতও হন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাশীদুল হাসান নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। আর বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভাষায় কবিতা, প্রবন্ধ গানসহ নানা বিষয়ে লেখালেখি করতেন। দুঃখজনক হলো, এসবের সামান্য কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ডায়েরির পাতাগুলো তিনি কেটে একটি গোপন স্থানে রেখেছিলেন, যা পরে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। প্রাপ্ত অংশে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত দিনপঞ্জি লেখা রয়েছে, তারপরের পৃষ্ঠাগুলো কাটা।
অবশ্য ডায়েরির অংশগুলো পাওয়া না গেলেও অন্যান্য লেখালেখির নিদর্শন ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত উদ্ধারকৃত অপ্রকাশিত দুটি ডায়েরি, চারটি লেখালেখির খাতা ও বেশ কটি চিঠি এবং অগ্রন্থিত কিছু লেখা নিয়ে তার লেখালেখির পরিমাণ অপ্রতুল হলেও সেখানে একজন সৎ সজ্জন খাঁটি দেশপ্রেমিক মানুষের চিত্রই প্রতিফলিত হয়। ৭ মার্চে উপস্থিত হয়েছিলেন রমনায় বঙ্গবন্ধুর জনসভায়। ডায়েরিতে যার সাক্ষ্য মেলে এভাবে: ‘...এতো লোক রমনার মাঠ কখনো দেখেনি। পনর লক্ষাধিক হবে। অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক বাঁশের লাঠি হাতে এসেছেন। স্বাধীনতা ও সংগ্রামে শপথ-স্লোগানে মুখরিত সভা। কোথাও পাকিস্তানি পতাকা নেই। স্বাধীন বাঙলার সুন্দর পতাকায় সভা শোভিত। এমন কখনো দেখেনি!!’
স্বাধীন বাংলাশে ও তার স্বাধীন পতাকা কোনোটাই দেখে যেতে পারেননি অধ্যাপক রাশীদুল হাসান। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার এ দেশীয় দালাল আলবদরদের হাতে স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে নির্মমভাবে নিহত হন তিনি। তিনি জীবদ্দশায় যেমন ছিলেন নেপথ্য নায়ক, তেমনি মৃত্যুর পরে নেপথ্য নায়ক হিসেবে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228