ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কলসিন্দুরের কন্যারা

এম ইদ্রিছ আলী
🕐 ৫:৫৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১০, ২০১৮

পুরুষ নয়, নারীর হাত ধরেই বাংলাদেশের ফুটবলে একের পর এক যুক্ত হচ্ছে সাফল্যের নতুন পালক। নিজেদের সর্বোচ্চ দক্ষতা দেখিয়ে সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালকে পরাস্ত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাংলার কন্যারা। বিজয় মুকুট পরা ফুটবল কন্যাদের গৌরবান্বিত সাফল্যে আনন্দধারা বইছে দেশের ফুটবল অঙ্গনেও। বিশেষ করে বিজয়োচ্ছ্বাসে অধিক উচ্ছ্বসিত প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র বিধৌত মহুয়া-মলুয়ার জনপদ ময়মনসিংহ। তার প্রধান কারণ সাফ অনূর্ধ্ব -১৮ বিজয়ী মূল দলের হয়ে মাঠে নৈপুণ্য দেখানো ১১ ফুটবলারের ৯ জনই এ ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের কন্যা।

কথিত আলোক ঝলমলে আধুনিক শহর নয়, গারো পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষা সীমান্ত উপজেলা ধোবাউড়ার শত বছরের সুবিধাবঞ্চিত গ্রাম কলসিন্দুর। সেই কলসিন্দুরে জন্ম নিয়ে সেখানেই বেড়ে ওঠা অতিসাধারণ কন্যারা মিরাকেল গতিতে বাংলার ফুটবলকে এগিয়ে নিচ্ছেন, জয় করেছেন, দেখিয়েছেন অনেক নিচে থেকেও উঠে আসা যায়। তারা বুঝিয়েছেন সব সাধারণই সাধারণ নয়, কোন কোন সাধারণ অসাধারণ সোনার টুকরো হয়ে উঠতে পারে। কলসিন্দুর থেকে মোট ১২ জন নারী ফুটবলার জাতীয় দলের হয়ে খেলে থাকেন। এদের পাশাপাশি আরও ৩৪ জন নারী ফুটবলারকে অনুশীলন করিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করছেন স্থানীয় কোচরা।

শত সংকটেও তারা দমে যাননি। খেলার জন্য নিবেদিত প্রাণ স্থানীয় কোচ জুয়েল মিয়া। তার হাতেই ফুটবল কন্যাদের ভিত রচনা এবং এগিয়ে চলা। আর সব ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন স্বপ্নবান এক শিক্ষক কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ মহিলা ফুটবল দলের টিম ম্যানেজার মালা রানী সরকার। কলসিন্দুরের ফুটবল কন্যাদের অপরাজেয় হয়ে ওঠার পেছনে অনেক বড় অবদান রয়েছে এ শিক্ষকের।

সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা বিজয়ী ফুটবলারদের মধ্যে মারিয়া মান্ডা, তহুরা খাতুন, সাজেদা খাতুন, শামসুন্নাহার, শিউলি আজিম, নাজমা, মার্জিয়া, সানজিদা আক্তার ও মাহমুদা আক্তার ধৌবাউড়া উপজেলার কলন্দিুরের কন্যা। তারা সবাই কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। সেই স্কুল থেকেই ফুটবলে তাদের পথযাত্রার শুরু। বঙ্গমাতা গোল্ড কাপ থেকে সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ বিজয়ে অধম্য তারা। তারা এগোতে চান আরও বহুদূর।
গ্রামের কন্যাদের ফুটবল দীক্ষায় হাতেখড়ি দেওয়া কোচ জুয়েল মিয়া খোলা কাগজকে বলেন, আমি ২০১৩ সাল থেকে কলসিন্দুরের খুদে ফুটবলারদের কোচের দায়িত্ব পালন করে আসছি। ওদের হয়ে দেশের জন্য আমি আরও ভালো কিছু করতে চাই। ব্যক্তিগত কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় নয় বরং এলাকা, দেশ, জাতির জন্য কিছু করার প্রত্যাশা থেকেই আমার এ প্রচেষ্টা।

কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ মহিলা ফুটবল দলের টিম ম্যানেজার মালা রানী সরকার বলেন, ‘আমাদের মেয়েদের অর্জনে সারা দেশ আনন্দিত। আশা করি এ মেয়েরা সামনের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়েও ভালো ফলাফল করবে। এমনকি এক দিন এরা বিশ্বজয় করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের আর্থিক সাহায্যের খুবই প্রয়োজন। ৩৪ জন নতুন খেলোয়াড় প্রস্তুতে যে প্রচেষ্টা চলছে তা চালিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সহযোগিতা পেলে অনেক দূর এগোনো যেত। এ বিষয়ে আমরা সরকার ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহযোগিতা কামনা করছি।’

এবার সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপ আসরে দেশের হয়ে চারটি গোল করা ফুটবল কন্যা মার্জিয়ার বাবা মোতালেব হোসেন পেশায় একজন রিকশাচালক। মোতালেব হোসেন মেয়ের সাফল্যে আনন্দিত। তিনি বলেন, ‘মেয়ের ভালো পরিচর্যা করতে পারি নাই। তারপরও নিজে কষ্ট করে অনেক এগিয়েছে।’ তিনি আর্থিক সচ্ছলতায় এখানকার প্রত্যেক খেলোয়াড়ের পরিবারের জন্য সরকারের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই বিষয়টি দেখবেন।

ফুটবলার তহুরা খাতুনের বড় চাচা সাংবাদিক মতিউল আলম বলেন, অনতিকাল ধরে সুবিধাবঞ্চিত আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা কলসিন্দুর গ্রাম। এখানকার মেয়েরা স্থানীয় প্রচেষ্টায় বঙ্গমাতা গোল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের মাধ্যমে উঠে এসে আজ এতদূর এগিয়েছে। তারা দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছে। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক। কারও বাবা রিকশাচালক, কারও বাবা চা বিক্রেতা, মাঠের শ্রমিক কিংবা প্রান্তিক কৃষক। তারা দেশের জন্য অনেক কিছু দিচ্ছে কিন্তু সে তুলনায় তারা তেমন কিছু পাচ্ছে না। তাদের সংসার ভালোভাবে চলছে না। এ খেলোয়াড়রা যখন বাড়িতে থাকে তখন ভালো কিছু খেতেও পারে না। এদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সরকারের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

ময়মনসিংহ জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম দেলোয়ার হোসেন মুকুল জানান, আমরা গর্বিত। ময়মনসিংহ ফুটবল ফেডারেশনের পক্ষ থেকে অচিরেই তাদের সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হবে। তাদের দেখাশোনার বিষয়টি সম্পূর্ণ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডাশেনের। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই। তবে আমরা কলসিন্দুরে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিয়ে থাকি। তিনি বলেন, আমাদের মেয়েরা অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা বিশ্বজয় করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। সেই সঙ্গে তিনি নারী ফুটবল নিয়ে ক্রিকেটের মতো বৃহৎ চিন্তা করার জন্য ফুটবল ফেডারেশন ও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

 
Electronic Paper