নাদিয়া মুরাদের লড়াই
রোকেয়া ডেস্ক
🕐 ৫:০৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১০, ২০১৮
‘আমি এখানে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছি, যারা এখন গত, তাদের স্মৃতি বুকে ধারণ করে মানবতার পক্ষে আমি আমার সংগ্রাম চালিয়ে যাব’- কথাটি ইরাকি নারী মানবাধিকারকর্মী নাদিয়া মুরাদের। পুরো নাম নাদিয়া মুরাদ বাসি তাহা। তিনি প্রথম ইরাকি হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেলেন। গত ৫ অক্টোবর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী দুজনের নাম ঘোষণা করে নরওয়েজিয়ান কমিটি। তার একজন নাদিয়া। তার এই সম্মানের পেছনের কাহিনী বড় করুণ।
তবে এখন ২৫ বছর বয়সী নাদিয়া মুরাদ একজন বিশ্বনন্দিত নোবেলজয়ী নারীর নাম। নোবেল জয় করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন ইরাকের এ ইয়াজিদি মানবাধিকারকর্মী। বাস্তবতার কঠিন নির্যাতনের জাল থেকে বেরিয়ে এসে মানবতার পক্ষে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কারটি অর্জন করলেন তিনি।
প্রথম ইরাকি হিসেবে নোবেল পাওয়া ২৫ বছর বয়সী নাদিয়ার চলার পথটি মোটেও মসৃণ ছিল না। ইরাকের সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস’র বর্বরতা। শুধু প্রত্যক্ষ করেননি, শিকার হয়েছেন অবর্ণনীয় নির্যাতনের।
২০১৪ সালে আইএসের জঙ্গিরা যখন সিরিয়া এবং ইরাকে ত্রাসের রাজত্ব শুরু করে তখন থেকেই তার দুঃস্বপ্নের শুরু। একই বছরের আগস্টে এক দুঃস্বপ্নময় দিনে আইএসের কালো পতাকা বহনকারী একটি গাড়ি নাদিয়ার গ্রামে প্রবেশ করে। জঙ্গিরা পুরুষদের হত্যা করে, শিশুদের বন্দি করে এবং নারীদের জোরপূর্বক শ্রম ও যৌনদাসী হতে বাধ্য করে।
আইএসের সেই ধ্বংসাত্মক ঝড়ের মুখে একটি পক্ষের কাছে যৌনদাসী হিসেবে মুরাদকে বিক্রি করে দেয় জঙ্গিদের আরেকটি পক্ষ। এরপর সিরিয়ান, ইরাকি, তিউনিসিয়ান ও ইউরোপিয়ান আইএস জঙ্গিদের নিষ্ঠুর লালসার শিকার হতে হয় তাকে। যন্ত্রণার যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে কাটতে থাকে তার একেকটি মুহূর্ত। তিন মাস পর নভেম্বরে অনেক কষ্ট-সংগ্রাম ও কৌশল করে পালাতে সক্ষম হন মুরাদ। পালিয়ে এসে চুপ হয়ে যাননি তিনি। নিরাপদ জীবন যাপনের পরিবর্তে যোগ দেন আইএসের হাতে বন্দি ইয়াজিদি নারীদের মুক্তির সংগ্রামে। রুখে দাঁড়ান নারী পাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। পরিণত হন ইয়াজিদিদের মুক্তির প্রতীকে।
নাদিয়া কাজ শুরু করেন ইয়াজিদি সম্প্রদায়সহ যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের শরণার্থীদের আইনজীবী হিসেবে। মানবাধিকার আদায়ে এ ভূমিকার জন্য তাকে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে সম্মানজনক শাখারভ পুরস্কারেও ভূষিত করা হয়। ২০১৫ সালে তিনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সামনে তুলে ধরেন নিজের ভয়ানক অভিজ্ঞতা।
জাতিসংঘে নাদিয়া মুরাদ বলেন, ‘আমাদের যখন বন্দি করা হলো, তখন ওদের যৌন নির্যাতনের বিষয়ে শোনা কথাগুলো স্মরণ করে মনে-প্রাণে চাইছিলাম, এমন পাশবিক লালসার শিকার হওয়ার আগে যেন আমাদের মেরে ফেলা হয়। কিন্তু ওরা আমাদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে দিল তাদেরই আরেকটি পক্ষের কাছে। এরপর কী যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে! প্রতিটা মুহূর্তে মনে হয়েছে, আমাদের মেরে ফেলা হয় না কেন, কেন আমাদের এভাবে তিলে তিলে নির্যাতন করা হচ্ছে?’ নাদিয়া সেই বক্তব্যে জানান, ‘তিন হাজারেরও বেশি নারী আইএসের হাতে যৌনদাসী হিসেবে বন্দি রয়েছে। আইএস এই হতভাগ্যদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে! ইচ্ছেমতো জায়গায় বিক্রি করছে নারীদের’।
এছাড়া নিজের জীবনের এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীকে জানাতে ‘দ্য লাস্ট গার্ল’ নামে একটি বই লেখেন নাদিয়া, যা ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়। ওই বইতে তিনি লেখেন, ‘কখনো কখনো ধর্ষিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই সেখানে ঘটতো না। এক সময় এটা প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে যায়।’
আইএসআই জঙ্গিরা নাদিয়া মুরাদের মাসহ ছয় ভাইকে মেরে ফেলে। পরে ইয়াজিদিদের একটি মিত্র সংগঠনের মাধ্যমে নাদিয়া জার্মানিতে বোনের কাছে চলে যান। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন।
সেই থেকে তিনি মানবতাবাদী কর্মে উৎসর্গ করেছেন নিজেকে। নারীর বিরুদ্ধে যে কোনো অন্যায়ে তিনি সোচ্চার হয়ে ওঠেন এবং অত্যাচারিত গণমানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তার যুদ্ধ শুরু করেন। এখনো তিনি নিখোঁজ ও নির্যাতিত ইয়াজিদিদের জন্য তার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ লক্ষ্যে ‘নাদিয়াস ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এ ছাড়া ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে তিনি যে কঠিন ভূমিকায় দাঁড়িয়েছেন, তার পুরস্কার হিসেবে তাকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হলো।