ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রীতিলতার শেষ লেখা...

রোকেয়া ডেস্ক
🕐 ৫:৩৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৮

আমি বিধিপূর্বক ঘোষণা করিতেছি, যে প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া, অত্যাচারের স্বার্থসাধনে নিয়োজিত সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ সাধন করিয়া আমার মাতৃভূমি ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন করিতে ইচ্ছুক, আমি সেই ভারতীয় রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখার একজন সদস্য।

এই বিখ্যাত ‘চট্টগ্রাম শাখা’ দেশের যুবকদের দেশপ্রেমের নবচেতনায় উদ্ধুদ্ধ করিয়াছে। ১৯৩০-এর ১৮ এপ্রিল এবং উহার পরবর্তী পবিত্র জালালাবাদ ও পরে কালারপুল, ফেনী, ঢাকা, কুমিল্লা, চন্দন নগর ও ধলঘাটের বীরোচিত কার্যসমূহই ভারতীয় মুক্তিকামী বিদ্রোহীদের মনে এক নূতন প্রেরণা জাগাইয়া তুলিয়াছে।
আমি এইরূপ গৌরবমতি একটি সংঘের সদস্যা হইতে পারিয়া নিজেকে সৌভাগ্যবতী অনুভব করিতেছি। আমরা দেশের মুক্তির জন্য এই সশস্ত্র যুদ্ধ করিতেছি। অদ্যকার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ স্বাধীনতাযুদ্ধের একটি অংশ। ব্রিটিশরা জোরপূর্বক আমাদের স্বাধীনতা ছিনাইয়া লইয়াছে। ভারতের কোটি কোটি নর-নারীর রক্তশোষণ করিয়া তাহারা দেশে নিদারুণ দুর্দশার সৃষ্টি করিয়াছে। তাহারাই আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধ্বংসের এবং সব অধঃপতনের একমাত্র কারণ। সুতরাং, তাহারাই আমাদের একমাত্র অন্তরায়। যদিও মানুষের জীবন সংহার করা অন্যায়, তবু বাধ্য হইয়া বড় বড় সরকারি কর্মচারীর ও ইংরেজদের জীবন সংহার করিতে আমরা অস্ত্রধারণ করিয়াছি। মুক্তিপথের যে কোনো বাধা বা অন্তরায় যে কোনো উপায়ে দূর করার জন্য আমরা সংগ্রাম করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আমাদের দলের মহামান্য ও পূজনীয় নেতা মাস্টারদা অদ্যকার এ সশস্ত্র অভিযানে যোগ দিবার জন্য যখন আমাকে ডাক দিলেন, তখন আমি নিজেকে যথেষ্ট সৌভাগ্যবতী মনে করিয়াছিলাম। মনে হইল, এত দিনে আমার বহু প্রত্যাশিত অভীষ্ট সিদ্ধ হইল এবং সম্পূর্ণ দায়িত্ব লইয়া আমি এ কর্তব্যভার গ্রহণ করিলাম।
এ উন্নত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্ব যখন আমার মতো একটি মেয়েকে এ গুরুভার অর্পণ করেন, তখন এত কর্মঠ ও যোগ্যতর ভাইয়েরা বর্তমান থাকিতে অভিযানে নেতৃত্বের ব্যাপার একজন ভগিনীর ওপর কেন ন্যস্ত হইবে, এই বলিয়া আমি আপত্তি জানাইলাম এবং একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে ওই কাজে যাইতে চাহিলাম।
কিন্তু আমি পরে পূজ্য নেতার আদেশ শিরোধার্য করিয়া লইলাম। আমি মনে করি যে, আমি দেশবাসীর নিকট আমার কাজের কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য। দুর্ভাগ্যবশত এখনো হয়তো আমার প্রিয় দেশবাসীর মধ্যে এমনও অনেকে আছেন, যাহারা বলিবেন যে ভারতীয় নারীত্বের ঊর্ধ্বতন আদর্শে লালিত একটি নারী কি করিয়া নরহত্যার মতো এ ভীষণ হিংস্র কাজে লিপ্ত হইল।
দেশের মুক্তি-সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়রা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারিব না? ইতিহাসে অনেক উদাহরণ আছে, রাজপুত রমণীরা অসীম সাহসের সহিত রণাঙ্গনে যুদ্ধ করিতেন এবং স্বদেশের স্বাধীনতা ও নারীত্বের মর্যাদা রক্ষার জন্য তাহারা শত্রুর প্রাণ-সংহার করিতে কিছু দ্বিধা করিতেন না। ইতিহাসের পৃষ্ঠা এরূপ কত নারীর বীরত্ব গাথায় পূর্ণ। তবে কেন আমরা, আজিকার ভারতীয় নারীরা বিদেশীর দাসত্বশৃঙ্খল হইতে নিজের দেশকে পুনরুদ্ধার করিবার জন্য এ মহান যুদ্ধে যোগদান করিব না? যদি বোনেরা ভাইদের সঙ্গে কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিতে পারে, তবে সশস্ত্র বিদ্রোহে যোগদানে তাহাদের বাধা কি? সশস্ত্র বিদ্রোহে অন্য দেশের বহু নারী যোগদান করিয়াছে, তবে কেন ভারতীয় নারীরা বিপ্লবের এ পন্থাকে অন্যায় বলিয়া মনে করিবে?
নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়াছে যে, আমার দেশের ভগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এ বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন, এ আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।

শিক্ষা জীবন
ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ছিল প্রীতিলতার প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯১৮ সালে তিনি এই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। প্রতি ক্লাসে ভালো ফলাফলের জন্য তিনি সব শিক্ষকের খুব প্রিয় ছিলেন। সেই শিক্ষকের একজন ছিলেন ইতিহাসের ঊষাদি। তিনি প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রানী লক্ষীবাই এর ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ের ইতিহাস বলতেন।
স্কুলে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলেন কল্পনা দত্ত। এক ক্লাসের বড় প্রীতিলতা কল্পনার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। কল্পনা দত্ত লিখেছেন ‘কোনো কোনো সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেই সময়ে ঝাঁসীর রানী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদের আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসেবে দেখা শুরু করলাম।’
১৯২৬ সালে তিনি সংস্কৃত কলাপ পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। ১৯২৮ সালে তিনি কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। অঙ্কের নম্বর খারাপ ছিল বলে তিনি বৃত্তি পেলেন না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বন্ধের সময়ে তিনি নাটক লিখেন এবং মেয়েরা সবাই মিলে সে নাটক চৌকি দিয়ে তৈরি মঞ্চে পরিবেশন করেন।
পরীক্ষার ফলাফল দেওয়ার সময়টাতে তার বাড়িতে এক বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু প্রীতিলতার প্রবল আপত্তির কারণে বিয়ে স্থগিত হয়। আইএ পড়ার জন্য তিনি ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে আইএ পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করে। এ ফলাফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পান এবং কলকাতার বেথুন কলেজে বিএ পড়তে যান। প্রীতিলতার বিএ-তে অন্যতম বিষয় ছিল দর্শন। দর্শনের পরীক্ষায় তিনি ক্লাসে সবার চাইতে ভালো ফলাফল লাভ করতেন। এ বিষয়ে তিনি অনার্স করতে চেয়ে ছিলেন কিন্তু বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত হবার তীব্র আকাক্সক্ষার কারণে অনার্স পরীক্ষা আর দেওয়া হলো না। ১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বিএ পাস করেন।
কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক পাস করলেও তিনি এবং তার সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়। অবশ্য তাদের ২২ মার্চ, ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে।

ডায়েরি থেকে
খেতে বসতে যাব, তখনই মাস্টারদা বললেন, পুলিশ পুলিশ! মাস্টারদাকে বললাম, আমি আপনাদের সঙ্গেই থাকব। তিনি চোখ বড় বড় করে বললেন, নিচে মেয়েদের মধ্যে চলে যাও, তাদেরই আত্মীয় বলে পরিচয় দিও। উপরে রইলেন মাস্টারদা, নির্মলদা আর ভোলা। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন তখন সিঁড়ি বেয়ে রিভলবার হাতে উপরে উঠছে। নির্মলদা দাঁড়িয়ে তাকে গুলি করলেন। সাহেব ক্যাপ্টেন ক্যামেরন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিচে পড়ে গেল। তারপর দু’দিক থেকে কিছুক্ষণ গুলি চলল।
এমন সময় মাস্টারদা ভোলাকে নিয়ে নিচে নেমে এলেন। মাস্টারদার পাশে তখন ভোলা দাঁড়িয়ে। এত বিপর্যয়েও তার চোখে-মুখে কোনো চাঞ্চল্য নেই, দেখে কি চমৎকার লেগেছিল। রিভলবারের ট্রিগারে হাত রেখে মাস্টারদার আদেশের অপেক্ষায় আছে। মাস্টারদা বললেন, চল। আমরা তিনজন রওনা হলাম। পেছন দিক দিয়ে বেরুবার সময় শুকনো পাতার উপর ‘খস খস’ শব্দ হতেই অন্ধকারের বুক চিরে এক গুলি এসে অপূর্বের বক্ষভেদ করল। আমি আর মাস্টারদা অন্ধকারে নিরুদ্দেশ যাত্রা করলাম।

 
Electronic Paper