ভাষা আন্দোলনে নারী
শাহীন চৌধুরী ডলি
🕐 ২:৫১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২১
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘কোনোকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারী, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়লক্ষ্মী নারী।’ বিশ্বজুড়ে সকল মহৎ কাজে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান আছে। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ অবধি আছে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের সমৃদ্ধ ইতিহাস। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবির আন্দোলনে সহযোদ্ধা হয়ে পুরুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নারীরা। পাকিস্তান আর্মি ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে ভাষার দাবির মিছিলগুলোতে সামনের কাতারে ছিলেন নারীরা। তেমন কয়েকজন ভাষাসৈনিক নারীর অবদানের কথা তুলে ধরেছেন শাহীন চৌধুরী ডলি-
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৪৭ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি ঘোষণাপত্রে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। প্রচার মাধ্যম ও বিশ^বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র উর্দু ভাষা ব্যবহার করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এতে পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সেদিন তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ ও বিরোধিতা আসে। তখন থেকে ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক জনসভায়। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন কঠিন রূপ ধারণ করে। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার ক্ষেত্রে বিতর্ক উঠলে ছাত্রীরা পক্ষে মত দিয়েছে। সেদিন সকাল থেকেই মেয়েরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আমতলার সভায় যোগ দিতে আসেন। কিন্তু পুলিশি হামলার আশঙ্কায় ছাত্রীদের মিছিল না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবির আন্দোলনে ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিল ছাত্রীরা। মাতৃভাষা রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত, শফিকসহ আরও অনেকেই।
পাকিস্তান আর্মি ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে ভাষার দাবিতে মিছিলের সামনের কাতারে ছিলেন নারীরা। ২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাজা, শোক মিছিল এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি হরতালসহ প্রতিটি কর্মসূচিতে নারীরা অংশগ্রহণ করে একাত্ম ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রাতে লুকিয়ে ভাষার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান লিখে পোস্টার এঁকেছেন। ১৯৫২ সালে নারীরাই ধাক্কাধাক্কি করে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙে। আহতদের চিকিৎসায় বিশেষ ভূমিকা রাখে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রীরা। আহতদের চিকিৎসায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলে আনে ছাত্রীরা। পুলিশের তাড়া খাওয়া ছাত্রদের নিজেদের কাছে তারা লুকিয়ে রাখে। আন্দোলনের খরচ চালাতে অনেক গৃহিণী নিজেদের অলংকার খুলে দেন। ভাষা আন্দোলনে জড়িত হওয়ায় অনেক নারীকে সংসার হারাতে হয়েছে, অনেক নারীকে জেল খাটতে হয়েছে। কোনো কোনো নারীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ঢাকা ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগীয় এবং জেলা শহরে নারীদের অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের পাশাপাশি স্কুলের ছাত্রীরা মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শামিল ছিলেন।
বর্তমানের মতন তখন মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ ছিল না। অনেক বাধা বিপত্তিতে তাদের দিনযাপন করতে হতো। রক্ষণশীল পরিবারের মুসলিম মেয়েদের উর্দু ফারসি, আরবি ছাড়া সাধারণ লেখাপড়ার চর্চা তেমন ছিল না। নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই সমগ্র দেশজুড়ে মুসলমান মেয়েদের জাগরণের সাড়া পড়ে। অভিভাবকরাও মেয়েদের উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে গণআন্দোলনে যোগ দেওয়া মেয়েদের জন্য সহজ ব্যাপার ছিল না। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে পড়লেও ছিল নিয়মের কড়াকড়ি। মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে কথা বললেও জরিমানা হতো। মেয়েদেরকে তাদের জন্য নির্ধারিত কমন রুমে বসে থাকতে হতো। শিক্ষক ক্লাসে ঢোকার আগে মেয়েদের ডেকে সঙ্গে নিয়ে রুমে ঢুকতেন। ক্লাসে সামনের দিকের বেঞ্চে বসতে হতো মেয়েদের। ক্লাস শেষে শিক্ষকের পিছু পিছু গিয়ে আবার নির্দিষ্ট কমনরুমে বসে থাকতেন।
১৯৪৭-১৯৫১ মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা ৮০-৮৫ জন। ভাষার জন্য ছেলে-মেয়ে সব একাট্টা হয়েই আন্দোলনে নামেন। এই ছাত্রীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ভাষা আন্দোলনে গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন। নারীরা কখনো আন্দোলনের সামনে থেকে প্রতিবাদী হয়েছেন। কখনো নীরবে আন্দোলনের সপক্ষে নিজেদের কাজ করে গেছেন। ড. শাফিয়া খাতুন ছিলেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি পারিবারিক বাধা ডিঙিয়ে ছেলেদের সঙ্গে জোর কদমে এগিয়ে গেছেন ভাষা আন্দোলন আরও গতিময় করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ওমেন হলের ছাত্রীরা ভাষা আন্দোলনে দুঃসাহসিক অবদান রেখেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘১১ মার্চ ভোর বেলা থেকে শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল।... সকাল আটটায় পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের ওপর ভীষণ লাঠিচার্জ হলো।... কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল।.... তখন পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার অধিবেশন চলছিল।.... আনোয়ারা খাতুন ও অনেকে মুসলিম লীগ পার্টির বিরুদ্ধে (অধিবেশনে) ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলেন।’
আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘যে পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম, সকাল ১০টায় স্কুলের মেয়েরা (মুসলিম গার্লস স্কুল) ছাদে উঠে স্লোগান করতে শুরু করত। ছোট ছোট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হতো না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই, পুলিশি জুলুম চলবে না- এমন নানা ধরনের স্লোগান।’
ড. শাফিয়া খাতুন
১৯৫১-৫২ সালে ড. শাফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন্স স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ভিপি ছিলেন। ১৯৫২ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করলে ছাত্র-জনতার মধ্যে তাৎক্ষণিকআবে যে প্রতিক্রিয়া হয় শাফিয়া খাতুন তাতে আন্দোলিত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের হোস্টেল, চামেলি হাউজের ছাত্রীদের নিয়ে বৈঠক করেন। ভাষা আন্দোলনে ছাত্রীদের নিয়ে এক দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার আহ্বান জানিয়ে সামনে এগিয়ে যান। ধর্মঘট চলাকালীন ছাত্রীদের একটি মিছিলে শাফিয়া খাতুন নেতৃত্ব দেন। তিনি ঢাকা শহরের বিভিন্ন মহিলা কলেজে ও গার্লস স্কুলে ছাত্রীদের সুসংগঠিত করে আন্দোলনমুখী করার কাজে নানা কৌশল অবলম্বন করেন। একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রজনতার সমাবেশকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য ছাত্রীদের পরিচালনার নেতৃত্বে ছিলেন শাফিয়া খাতুন।
লায়লা নূর
১৯৫২ সালে কারাবাস করে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যাপিকা লায়লা নূরকে। তখন তিনি ছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী। তিনি মাতৃভাষা আন্দোলনে যোগদানকারী এক বিপ্লবী নারী। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ এর সকল আন্দোলনেই তার ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। লায়লা নূর ১৯৩৪ সালের ৫ অক্টোবর কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার গাজিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবু নাসের মো. নূর উল্লাহ এবং মায়ের নাম শামসুন্নাহার মেহেদী। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। আবু নাসের ছিলেন ভারতের বিহার রাজ্যের জামশেদপুরে অবস্থিত টাটা স্টিল কোম্পানির প্রকৌশলী। সেখানেই লায়লা বেড়ে ওঠেন। কুমিল্লায় এসে তিনি ১৯৪৮ সালে মাধ্যমিক, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক ও ১৯৫৪ সালে বিএ এবং ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। লায়লা নূর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম নারী শিক্ষক। সেখানে তিনি একটানা ৩০ বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তিনিসহ ২০ নারী পাকিস্তান পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য তিনি ২১ দিন কারাভোগ করেন। লায়লা নূর ২০১৯ সালের ৩১ মে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
ড. সুফিয়া আহম্মদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী ছিলেন জাতীয় অধ্যাপিকা সুফিয়া আহম্মদ। ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রথম সারির নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস ও লাঠির আঘাতে তিনি আহত হন। ১৯৫২ সালে তিনি তুরস্কে পাকিস্তান সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন।
সুফিয়া আহমেদ ১৯৩২ সালের ২০ নভেম্বর ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মুহম্মদ ইবরাহিম ছিলেন একজন বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং মা লুৎফুন্নেসা ইবরাহিম। ১৯৪৮ সালে প্রাইভেটে মেট্রিকুলেশন পাস করেন এবং পরে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৫০ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৪৩-৪৪ সালে তার বাবা মুহম্মদ ইবরাহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পাঠদান করতেন। তখন থেকে তার মাঝে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন লালিত ছিল। ১৯৬১ সালে লন্ডন থেকে পিএইচডি করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে তার নিজের বিভাগ ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে অধ্যাপক হন। সুফিয়া আহমেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টরের সদস্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সুফিয়া আহমেদ ১৯৫৫ সালের জুনে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ইশতিয়াক আহমেদ ছিলেন একজন বিচারক ও আইনজীবী। তাদের দুই সন্তান। ছেলে সৈয়দ রিফাত আহমেদ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারক এবং মেয়ে রাইনা আহমেদ একজন চিকিৎসক। ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
চেমন আরা
চেমন আরা ১৯৩৫ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের চান্দগাঁও উপজেলার মৌলবী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা এ. এস. এম মোফাখখার কলকাতা হাইকোর্টে মুসলমান অ্যাডভোকেটদের মধ্যে একজন ও মুসলিম লীগের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে কথাশিল্পী ও ভাষাসৈনিক শাহেদ আলীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তার অনুপ্রেরণায় ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন।
১৯৫১ সালে ঢাকার কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৩ সালে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৬ সালে বিএ অনার্স ও ১৯৫৭ সালে এমএ পাস করেন।
৩৬ বছরের কর্মজীবনে একাধিক প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে শিক্ষার আলো বিস্তার করে গেছেন তিনি। ১৯৫৯ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। সে বছরই বাদশা মিয়া চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের প্রথম মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগঠক তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন চেমন আরা। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী চেমন আরা বিভিন্ন সভা মিছিল ও সাংগঠনিক কাজে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদ বরকতের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে বের হওয়া মিছিলে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।
হামিদা রহমান
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হামিদা রহমান ১৯২৭ সালের ২৯ জুলাই যশোরের পুরাতন কসবায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যশোরের একমাত্র নারী ভাষাসৈনিক ও বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ছিলেন।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের একাধিক পত্রিকায় ভাষা আন্দোলন ও নারী অধিকার নিয়ে তার লেখা প্রকাশ হয়। হামিদা রহমানের বাবা শেখ বজলুর রহমান এবং মায়ের নাম বেগম লুৎফুন্নেছা। ১৯৪২ সালে নোয়াখালী নিবাসী সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে হামিদা রহমানের দুই ভাই শহীদ হন।
হামিদা রহমান ১৯৪২ সালে যশোর মধুসূদন তারাপ্রসন্ন বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৪৭ সালে সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে আইএ, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং ১৯৫৮ সালে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে নতুন রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হবে উর্দু এমন যুক্তিতে কোলকাতার আজাদ পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর প্রতিবাদ জানিয়ে এম এম কলেজের ছাত্রী হামিদা রহমান ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি ১০ জুলাই ১৯৪৭-এর সংখ্যায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। সেই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হবে বাংলা।
১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পাশাপাশি যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজের শিক্ষার্থীরাও গঠন করে ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ। সেই পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন আলমগীর সিদ্দিকী। আর একমাত্র নারী যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন যশোরের অগ্নিকন্যা হামিদা রহমান। আন্দোলন চলাকালীন সময় তার ভূমিকায় শাসকগোষ্ঠী এতটাই খ্যাপা ছিলেন যে, তার পুরাতন কসবার বাড়িতে একাধিকবার অভিযান চালায় পুলিশ। পরবর্তীতে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যশোর জেলার যুগ্ম-আহ্বায়কের দায়িত্ব নিয়ে পুরো দেশে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে দেন।
মুসলিম গার্লস স্কুল ও বাংলাবাজার গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের আমতলায় নিয়ে আসার দায়িত্ব ছিল হালিমা খাতুনের ওপর। ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তব্য দেওয়ার পর পরই স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয় আমতলা। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হামিদা রহমানের নেতৃত্বে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনিতে মুখরিত মিছিলটি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরকে প্রকম্পিত করেছিল।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভেঙে প্রথম বের হয় চারজনের মেয়েদের দল। জুলেখা, নূরী, সেতারার সঙ্গে হালিমা খাতুনও ছিলেন। পরবর্তীতে ভাষাসৈনিক হামিদা রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তিনি পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে ছেলেদের পোশাক পরিধান করে যশোর কলেজের বৈঠকের সভায় যোগ দেন।
হামিদা রহমান দীর্ঘদিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। পরবর্তীতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত কারণে ২০০৫ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকায় নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
সুফিয়া কামাল
সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সৈয়দ আব্দুল বারী এবং মায়ের নাম সৈয়দা সাবেরা খাতুন। ১৯২৪ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিয়ে হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এতে অংশ নেওয়ার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর দমন-নীতির অঙ্গ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। ভাষা আন্দোলনের অনেক কর্মীর সঙ্গে তার ছিল নিবিড় যোগাযোগ। ভাষা আন্দোলনে ভাষাকন্যা নাদেরা বেগম পুলিশের হুলিয়া মাথায় নিয়ে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপন করে কবি সুফিয়া কামালের বাসায় ছিলেন। কিছুদিন সুফিয়া কামালের বাসায় থাকার পর লোকের আনাগোনায় কেউ তাকে চিনে ফেলে। তিনি ঠিকানা বদল করেন। পরে পুলিশ নাদিরা খাতুনকে গ্রেফতার করে এবং বন্দি করে। কারাগারে অন্যান্য রাজবন্দিদের সঙ্গে নাদিয়া খাতুন কঠিন নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়াও ময়মনসিংহে ছাত্রী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ায় ১৫ দিনের জন্য নজরবন্দি হন তাহমিনা সাইদা। সিলেটের ছাত্রী সালেহাকে কালো পতাকা উত্তোলনের জন্য স্কুল থেকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এ কারণে তার আর পড়াশোনা হয়নি। ভাষা আন্দোলনে সংগ্রামমুখর দিনগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা নারীদের মধ্যে আরও আছেন সনজীদা খাতুন, রাণী ভট্টাচার্য, নূরজাহান বেগম, রাবেয়া খাতুন, মিসেস কাজী মোতাহার হোসেন, সৈয়দা শাহরে বানু চৌধুরী, সারা তৈফুর, বোরখা শামসুন, সুফিয়া ইব্রাহিম, সুরাইয়া ডলি, সুরাইয়া হাকিম, ফরিদা বারি, জহরত আরা, কামরুন নাহার বেইলি, হোসনে আরা, ফরিদা আনোয়ার, তালেয়া রহমানসহ আরও অনেকে।
ড. হালিমা খাতুন
অধ্যাপক হালিমা খাতুন ১৯৩৩ সালের ২৫ আগস্ট বাগেরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মাওলানা আব্দুর রহমান ও মায়ের নাম দৌলতুন্নেসা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তিনি ভাষা আন্দোলনে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৯ সালে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ভাষা আন্দোলনে সাহসী ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক ভাষাসৈনিক সম্মাননা এবং সাহিত্যক্ষেত্রে তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও লেখিকা সংঘ পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৮ সালের ৩ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
রওশন আরা বাচ্চু
১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় রওশন আরা বাচ্চু ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। নারী ভাষা সংগ্রামী রওশন আরা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। তিনি জনমত সমর্থনের জন্য ব্যাপক চেষ্টা করেন। তার অনুপ্রেরণায় ইডেন মহিলা কলেজ এবং বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সংগঠিত করে আমতলার সমাবেশের স্থানে নিয়ে আসেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলায় পুলিশ কর্তৃক লাঠিচার্জের শিকার হন। এ ঘটনায় অনেক নিহত ও আহতদের তালিকায় তিনিও আহতদের একজন ছিলেন।
শরিফা খাতুন
ফেনী মহকুমার শশ্মদি ইউনিয়নের জাহানপুর গ্রামে নারী ভাষাসৈনিক শরিফা খাতুনের জন্ম। ফেনীর একটি স্কুলের ছাত্রী থাকাকালীন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের দুই একটি মিছিলেও তিনি অংশ নেন। তখনো ভাষা আন্দোলন শুরু হয়নি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গটি প্রকাশ্যে আসে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের শাসক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দিলে আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। স্কুলের ছাত্রীদের সঙ্গে সে মিছিলে অংশ নেন শরিফা খাতুন।