রাবেয়া খাতুনের দিকে
শফিক হাসান
🕐 ১২:০৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৩, ২০২১
রাবেয়া খাতুনের দিকে, তার বিপুল সাহিত্য-বৈভবের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় না হয়ে উপায় নেই। তিনি যেন ‘মহিলা রবীন্দ্রনাথ!’ অবশ্য ব্যক্তি যেমনই হন না কেন, তার সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। প্রত্যেকেই স্ব স্ব অবস্থানে স্বতন্ত্র ও অনন্য। তবুও বাঙালির মাথার মুকুট রবীন্দ্রনাথ চলে আসেন যাপিত জীবনের নানা ক্ষেত্রে। এক জীবনে তিনি যা লিখে গেছেন, একজন নিবিষ্ট পাঠকের সেসব পড়তে ব্যয় করতে হবে কতটি জীবন! সঙ্গত কারণেই রবীন্দ্রনাথ থেকে যান অতলের কুশীলব হিসেবে। রাবেয়া খাতুনকেও আমার তেমনই মনে হয়। ঘর সামলে, সংসারে সময় দিয়ে, সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করেছেন। গুরুদায়িত্ব পালনের পরও গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন সাহিত্য-সাম্রাজ্য। লেখার প্রতি তার যে নিবিষ্টতা, প্রেম, পাঠককে পাঠক করে তোলার যে শৈলী তা নজর না কেড়ে উপায় নেই। তার রচনার শিল্পগুণ কিংবা বলার কুশলী ভঙ্গিতে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে যেতে বাধ্য যে কোনো বয়সী শিল্পরসিক।
ঘরকুনো বলে বদনাম রয়েছে বাঙালির। কথাটার সত্যাসত্য নিয়ে বিতর্ক হতে পারে কিন্তু খারিজ করে দেওয়ার সুযোগ নেই। এই ‘বদনামের’ ভার কিছুটা হলেও লাঘব করেছেন রাবেয়া খাতুন। তার রচিত ভ্রমণসাহিত্যের দিকে তাকালেও মাথা নোয়াতে হয়। সম্ভ্রম এবং শ্রদ্ধায়। ভ্রমণ অনেকেই করেন কিন্তু দেখার চোখ থাকে না সবার। আবার যার দেখার চোখ আছে, তার নেই লেখার হাত! সব মিলিয়ে বরাবরই ভ্রমণসাহিত্যে এক ধরনের বন্ধ্যাবস্থা বিরাজ করছিল। সেই শুষ্ক মরুতেও রাবেয়া খাতুন ফুটিয়েছেন আলোর ফুল। ছড়িয়েছেন জোছনাধারা। তার দেখার চোখ আছে, লেখার হাত আছে- সর্বোপরি আছে দেখানোর বাসনা। সব মানুষের পক্ষে দেশে-বিদেশে ভ্রমণ সহজ নয়। এদের জন্য রয়েছে মানসভ্রমণ। লেখকের পিছু নিয়ে মনশ্চক্ষুকে জাগ্রত করে সহজেই ঘুরে আসতে পারেন পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। ঘোচাতে পারেন দূরত্বের সীমারেখা।
ছোটগল্প, উপন্যাস, স্মৃতিচারণ কিংবা ভ্রমণই নয়- গুণবতী এ লেখক রকমারি লেখায় সিদ্ধহস্ত। লিখেছেন ছোটদের জন্যও। স্মৃতিচারণমূলক লেখায়ও পিছিয়ে ছিলেন না। মহান মুক্তিযুদ্ধের শ্বাসরুদ্ধকর দিনগুলোর কথা লিখেছেন ‘একাত্তরের নয় মাস’ বইয়ে। এটা শুধু একটি বই-ই নয়, কালের সাক্ষ্য তথা জাতির জন্য বড় দলিল। তার লেখা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে একাধিক চলচ্চিত্র- ‘মেঘের পর মেঘ’, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ও ‘ধ্রুবতারা’।
টেলিভিশনের জন্য অনেক নাটকও নির্মিত হয়েছে রাবেয়া খাতুনের অনুপম লেখায়। নিরবচ্ছিন্নভাবে যেমন কাজ করে গেছেন তেমনি পেয়েছেন প্রতিভার স্বীকৃতিও। গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব পুরস্কার জমা হয়েছে তার ঝুলিতে। কোনো বাগাড়ম্বর, বেহুদা হাঁকডাক ছাড়াই, অনেকটা নিভৃতে থেকে কাজ করে গেছেন রাবেয়া খাতুন। এই দেশের শিল্প-সংস্কৃতি ও সাধারণ মানুষের মানস ভূগোল সমৃদ্ধ করে গেছেন তিনি প্রায় অর্ধ শতাব্দীব্যাপী।
চলমান বৈশ্বিক মহামারী করোনা কেড়ে নিয়েছে অনেকের প্রাণ। চলে গেছেন অনেক গুণিজনও। রাবেয়া খাতুনের বিদায় করোনায় নয়, প্রাকৃতিক বিধানেই। যেভাবে হোক, এই চলে যাওয়া বড় বেদনা হয়ে বাজছে আকাশে বাতাসে। শোক ছড়িয়ে ইথারে ইথারে। রাবেয়া খাতুন সৃষ্টি করে গেছেন যে শূন্যতা সেটা কখনো পূরণ হবে কি? সব বাস্তবতা মেনে নিয়েও তিনি অমর। এমন বিরলপ্রজ লেখক আবার কবে জন্মাবে! আমরা পেয়েছি অমূল্য পরশপাথরের স্পর্শ- আপাতত এটুকুই হোক সান্তনা।