ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রগতিশীল আন্দোলনের বাতিঘর

রোকেয়া ডেস্ক
🕐 ৬:৪৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ০৬, ২০২১

প্রগতিশীল আন্দোলনের বাতিঘর

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আয়শা খানম। ছাত্রনেতা থেকে নারীনেত্রী হয়ে ওঠেন তিনি। পাকিস্তান আমলে হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবিতে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন। এরপর ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে সামনের সারিতে ছিলেন আয়শা খানম। প্রগতিশীল আন্দোলনের এই নেত্রীকে নিয়ে লিখেছেন সালাহ উদ্দিন খান রুবেল। সম্পাদনা করেছেন সাইফ-উদ-দৌলা রুমী

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ

নব্বইয়ের দশকে আয়শা খানম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। পার্টির ভাঙন দেখা দিলে তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হোন। তিনি চিন্তা-চেতনায় বা ভাবধারায় কখনো প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যাননি। মহিলা পরিষদের মাধ্যমে প্রগতিশীল আন্দোলনের ধারাকে বহন করে চলেন। তিনি জীবনভর মানব মুক্তির গান গেয়ে গেছেন। প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের কাছে আয়শা খানম ছিলেন পথপ্রদর্শক। নেত্রকোণা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় সমাজ সচেতন ছিলেন। তিনি মেয়েদের বাইরে নিয়ে আসার সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন। মহিলা পরিষদের মাধ্যমে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবনভর আন্দোলন করেছেন। তিনি বাঙালি সমাজের আইকন হয়ে থাকবেন। তিনি ছোট থেকেই মেধাবী ছিলেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন একদিন তার সহপাঠীদের সঙ্গে বাজি ধরে জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি অনেক বড় কবিতা অল্প সময়ের মধ্যেই মুখস্থ করে সহপাঠীদের অবাক করে দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি সারাজীবন অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের জয়গান গেয়ে গেছেন।

ডামি রাইফেল হাতে ঢাকায় নারী শিক্ষার্থীদের মিছিলে যে ছবি আলোচিত হয় তাতে মুক্তিযোদ্ধা আয়শা খানমও ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন মহীয়সী নারীনেত্রী আয়শা খানম। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের শিকার নারীদের পুনর্বাসন এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় কাজও করেন তিনি। ১৯৭১ সালে এপ্রিলের শেষ দিকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় যান তিনি। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ক্রাফটস হোস্টেলে ওঠেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যারা ভারতে আসতেন, তাদের এক অংশের সাময়িক আবাসস্থল ছিল ক্রাফটস হোস্টেল। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থী শিবিরগুলোতে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা, প্রণোদনা দান এবং শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে কাজ করেন তিনি।

আগরতলায় কাজের কথা বলতে গিয়ে আয়শা খানম নিজেই জানিয়েছিলেন, ‘আগরতলায় আমি প্রাথমিক একটা প্রশিক্ষণ নিই চিকিৎসাসেবার ওপর। এরপর আগরতলার প্রতিটি ক্যাম্পে গিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে আত্মনিয়োগ করি।

এছাড়া বিভিন্ন অভিযানে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানোর আগে তাদের জন্য সংক্ষিপ্ত ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করা হতো। সেখানে তাদের ওরিয়েন্টেশন দেওয়ার কাজ করতাম। আমি যেহেতু আগে থেকেই সচেতনতা সৃষ্টির কাজে এবং বক্তব্য ও কথা বলার ক্ষেত্রে জড়িত ছিলাম সেজন্যই বোধ হয় সেখানেও আমাকে এ ধরনের কাজেই বেশি করে জড়িত রাখা হয়েছিল। এছাড়া ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন আয়শা খানম।

জন্ম ও শিক্ষা জীবন
আয়েশা খানম ১৯৪৭ সালের ১৮ অক্টোবর নেত্রকোণা সদর উপজেলার কালিয়ারা গাবরাগাতী গ্রামে ঐতিহ্যবাহী খান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গোলাম আলী খান, মা জামাতুন্নেসা খানম। ছয় বোন লুৎফা খানম, কাওসার খানম, সাবেক যুব ও তমজিদা খানম, তাওহীদ খানম, সানজিদা খানম। তার নানার বাড়ি কেন্দুয়া উপজেলার জল্লীগ্রামে। তিনি কালিয়ারা গাবরাগাতী এলাকার স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক, নেত্রকোণা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ম্যাট্রিক ও ময়মনসিংহের মমিনুন্নেছা কলেজে এইচএসসি পাস করে ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন।

রাজনৈতিক জীবন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়শা খানম একাত্তরের দিনগুলোতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের যেসব ছাত্রনেতাগণ মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাদেরই একজন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আয়শা খানম। আগরতলায় গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবাও দিয়েছেন আয়শা খানম। আয়শা খানম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছাত্রজীবন শেষে বঞ্চিত নারীদের অধিকার আদায়ে আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আয়শা খানম। ছাত্রনেতা থেকে নারীনেত্রী হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আয়শা খানম। তিনি সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান আমলে হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবিতে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন। এরপর ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে সামনের সারিতে ছিলেন।

শেষ জীবন
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও নিজেকে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, সমান অধিকার ভিত্তিক সমাজ গড়ার কাজে জড়িয়ে রেখেছেন নারীনেত্রী আয়শা খানম। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে যান তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের শিকার নারীদের পুনর্বাসন এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় কাজ করেন তিনি। শুরু থেকেই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। প্রথমে ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সহ-সাধারণ সম্পাদক এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আয়শা খানম। তিনি ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি ঢাকাস্থ নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। ব্যবসা, চাকরি, শিক্ষাসহ যেকোনো খাতে সুবিধা বা সফলতা পেতে পুরুষের তুলনায় নারীকে বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে। নারীর চলার পথ মসৃণ করতে যে কয়জন নারী উদ্যোগী হয়ে মাঠে নেমেছেন তাদের মধ্যে আয়শা খানমের নাম ভাস্কর থাকবে।

 

 
Electronic Paper