ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জীবন সগ্রামে জয়ী নারী

রোকেয়া ডেস্ক
🕐 ১২:৫৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩০, ২০২০

জীবন সগ্রামে জয়ী নারী

স্বাবলম্বী জরিনা
জরিনা বেগম আদিতমারী উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের তালুক পলাশী গ্রামের হবিবুর রহমানের স্ত্রী। ১১ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। ১৯৭৫ সালে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় তার বাল্যবিয়ে হয়। তখন তার স্বামী ক্ষুদ্র ব্যবসা করে অতিকষ্টে ছয় ছেলে-মেয়ে এবং বাবা-মা, ভাই-বোন নিয়ে কোনো রকম সংসার চালাত। তখন তাকে সংসারে অনেক কষ্ট সইতে হতো। এতো কষ্টের পরও তিনি পাঁচ ছেলেকে সুশিক্ষিত করেন।

 

তিনি প্রথমে একটি ছোট পুকুর খনন করে মাছ চাষ শুরু করেন এবং আস্তে আস্তে সেটি বড় করে এখন সেখান থেকে মাছের পোনা এবং মাছ বিক্রি করে বছরে পাঁচ লাখ টাকা আয় করেন। বর্তমানে তিনি ১০ বিঘা জমি বন্ধক নিয়েছেন। এখন তার মাসিক আয় ৬০ হাজার টাকা।
বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে মহিলা বিষয়ক অধিদফতর, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জয়িতা অন্বেষণ কার্যক্রমের আওতায় অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে জরিনা বেগমকে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত করা হয়।

সচ্ছল কৃষ্ণা রানী
অর্থনৈতিক সফলতায় অচল সংসার সচল করেছেন কৃষ্ণা রানী বিশ্বাস। তার তিন সন্তান লেখাপড়া করছে। কেটে গেছে সংসারের আর্থিক দৈন্যতা। প্রায় ১৫ বছর আগে তার বিয়ে হয়। কয়েক বছরের ব্যবধানে দুই মেয়ে ও এক ছেলের জননী হন তিনি। ছেলে-মেয়েরা যখন স্কুলে পড়ালেখা শুরু করে তখন সংসারে আর্থিক দৈন্যতা মারাত্মক রূপ নেয়। স্বামীর ছোট একটা মুদি দোকানের আয়ে সন্তানদের ও সংসারের চাহিদা অপূরণ থাকে।

সব যেন অচল হয়ে পড়ে। এমন সময় মহিলাবিষয়ক অধিদফতর থেকে ব্লক-বুটিক প্রশিক্ষণ এবং ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন। সিট কাপড় কিনে ছোটদের পোশাক তৈরি করেন। তা গ্রামে ও বাজারে বিক্রি করে কিছু টাকা লাভ হয়। এর কয়েক মাস পর যশোর ও কুষ্টিয়া থেকে থ্রি-পিস, ওড়না, বেডশিট, প্রিন্ট শাড়ি আনতে শুরু করেন। তার ব্যবসায় বর্তমান মাসিক আয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে তার ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ দিয়ে আরও পরিবারকে সহযোগিতা করছেন। কৃষ্ণা রানী বিশ্বাস বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার পুরাতন কালশিরা গ্রামের স্বপন কুমার বিশ্বাসের স্ত্রী।

জয়িতা মঞ্জুশ্রী সিনহা
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের সফল জননী মঞ্জুশ্রী সিনহা। এক মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তান তার। মণিপুরী গরিব কৃষক পরিবারের বাবা সূর্যমণি সিংহ ও মাতা কুঞ্জ রাণী সিনহার ঘর আলোকিত করে ১৯৬১ সালের ৫ মে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। একজন মা হিসেবে সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি যে অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ত্যাগ শিকার করেছেন তার স্বীকৃতি হিসেবে কমলগঞ্জ উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় তাকে ২০২০ সালে সফল জননী নারী ক্যাটাগরিতে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা প্রদান করে। একমাত্র তার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অদম্য প্রচেষ্টায় বড় ছেলে বিসিএস পাস করে সহকারী কাস্টমস কমিশনার পদে এবং ছোট ছেলেও বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে কর্মরত আছেন। অভাব অনটনের মধ্যে নিজেকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মনস্থির করে মঞ্জুশ্রী সিনহা বর্ণনাতীত বাধা বিপত্তিতে পড়লেও স্বপ্ন বাস্তবায়নে পিছপা না হওয়ায় মামার বাড়িতে স্থানান্তর হতে বাধ্য হন। সেখানে থেকেই ১৯৭৮ সালে তিনি এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান শাখা থেকে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন।

তারপর নার্সিংয়ে ভর্তি হলেও নানা সমস্যার কারণে অসমাপ্ত রেখে বাবার বাড়িতে ফিরে আসলে কিছুদিন পর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের পাথারীগাঁও গ্রামের স্কুল শিক্ষক প্রফুল্ল কুমার সিংহের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর তিনি ১৯৭৯-১৯৮০ ট্রেনিং বর্ষে পিটিআই ট্রেনিং সফলতার সঙ্গে সমাপ্ত করেন। তারপর ১৯৮২ সালের ১৬ আগস্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিক পদে যোগদান করেন।

সন্তানদের জন্ম হওয়ার পর তার স্বপ্নগুলো অন্য ধারায় প্রবাহিত হয়। স্বামী-স্ত্রীর অল্প আয়ে সংসার সামাল দেওয়া যেখানে কষ্টকর হয়ে পড়ে, সেখানে তিনি সন্তানদের সুশিক্ষিত এবং উচ্চ শিক্ষা প্রদানের মনস্থির করে বিভিন্ন সময় ধার কর্জ করেছেন, নিজের সোনার গহনা বন্ধক দিয়েছেন, এমনকি নিজের নামীয় সম্পত্তি বিক্রি করতেও বাধ্য হয়েছেন।

তৎকালীন সময়ে গ্রামাঞ্চলে মহিলাদের চাকরি এবং সন্তানদের নিয়ে এমন উচ্চাকাক্সক্ষাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখা হতো বলে তার প্রতি বিভিন্ন কটূক্তি করা হলেও তিনি লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যান।

সমাজকর্মী কনা পোদ্দার
দিনমজুর বাবার চার মেয়ের প্রথম সন্তান কনা পোদ্দার। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় ১৯৯৪ সালে তার বিয়ে হয়। ২০০০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। স্বামীর চাহিদার সম্পদ দিতে না পারায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে হয়। ২০১২ সালে এসএস সংস্থায় কাজ শুরু করেন। ২০১৩ সালে সূর্যের হাসি ক্লিনিকের সিএসপি পদে চাকরি করেন। ২০১৪ সালে সফল প্রকল্পে কাজ করেন। ২০১৬ সালে এমডিএফ সংস্থার ১৫৬ সদস্যের মধ্যে নির্বাচিত সভানেত্রী হন। তিনি মহিলা, শিশু এবং কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য পরামর্শক ও পরিবার পরিকল্পনার পণ্য সেবার সহায়ক। এছাড়া বাল্য বিয়ে ও যৌতুক প্রতিরোধ করেন।

সফল জননী করুণা রায়
করুণা রায়ের বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সে। স্বামী পল্লী চিকিৎসক। তাদের চার মেয়ে ও দুই ছেলে। স্বামী ও সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে তিনি মাসে অন্তত ১৫ দিন না খেয়ে থাকতেন। তিনি নিজে লেখাপড়া জানেন না। তাই ইচ্ছে ছিল ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাবেন। এজন্য শেষ সম্বল দুই বিঘা জমি বিক্রি করতে হয়েছে তাকে। অবশেষে তার স্বপ্ন সফল হয়। এখন তার বড় মেয়ে সুচন্দা রায় ডিপ্লোমা ম্যাটস শেষে হাসপাতালে চাকরি করেন। দ্বিতীয় মেয়ে লিলি রায় এমএ পাসের পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

তৃতীয় মেয়ে শিলা রায় এমএ পাসের পর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। চতুর্থ মেয়ে সীমা রায় ডিপ্লোমা পাস করে হাসপাতালে চাকরি করেন। প্রথম ছেলে মানস রায় এমএ পাসের পর কলেজের শিক্ষক। সবার ছোট ছেলে বিধান রায় প্রকৌশলী। অভাবের সংসারেও সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালনা করেছেন তিনি। বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার সন্তোষপুর ইউনিয়নের পিঁপড়ারডাঙ্গা গ্রামের মনিন্দ্রনাথ রায়ের মেয়ে করুণা রায়।

 
Electronic Paper