প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং মাতৃত্ব
সিদ্দিকুর রহমান
🕐 ৭:১১ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৮
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার স্বাদ এবং একজন নারীর সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষিত ‘মাতৃত্বে’র স্বাদ একই সঙ্গে আস্বাদন করেছেন দুজন মাত্র নারী। পৃথিবীর হাজার হাজার রেকর্ডের ভিড়ে এটি নিশ্চয়ই আলাদা তাৎপর্য বহন করে। এই দুই নারী প্রমাণ করেছেন, একজন নারী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অবস্থানে থেকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার পরও সন্তানের জন্ম যেমন দিতে পারেন তেমনি নিজের কাজেরও আঞ্জাম দিতে পারেন সুচারুরূপে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সন্তানের জন্ম দিয়ে বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা অ্যার্ডার্ন। সন্তান জন্মদানের খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান অ্যার্ডার্ন নিজেই। তিনি অকল্যান্ডের হাসপাতালের কর্মচারীদের ধন্যবাদ জানান। বিবৃতিতে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ক্লার্ক ও আমি খুবই উচ্ছ্বসিত। আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা দুই থেকে তিনে দাঁড়িয়েছে। আমি নিশ্চিত নতুন বাবা-মায়েদের যে রকম আবেগ ছুঁয়ে যায়, আমাদেরও সে রকমই লাগছে। বহু মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, সে জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’
জাসিন্ডা অ্যার্ডার্ন হচ্ছেন দ্বিতীয় সরকারপ্রধান যিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সন্তানের মা হলেন। এ ঘটনার সঙ্গে-সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় আসছেন পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর নাম, যিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। এখানে কিছু কাকতালীয় বিষয় রয়েছে। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা অ্যার্ডার্ন যে দিন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, অর্থাৎ ২১ জুন তারিখ পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোরও জন্মদিন। ৬৫ বছর আগে এ দিনটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বেনজির ভুট্টো।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ৩৭ বছর বয়সে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। বেনজির ভুট্টোও ৩৭ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯৯০ সালে তার কন্যা বখতাওয়ার ভুট্টো জারদারিকে জন্ম দিয়েছিলেন। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর মা হওয়ার খবরে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বর্তমানে ২৮ বছর বয়সী সেই কন্যা বখতাওয়ার ভুট্টো। বখতাওয়ার ভুট্টো জারদারি তার টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘বেনজির ভুট্টো দেখিয়েছিলেন যে আপনি একই সঙ্গে মা হতে পারেন এবং প্রধানমন্ত্রীও থাকতে পারেন।’ বেনজির ভুট্টো যখন তার কন্যা বখতাওয়ার ভুট্টোর জন্ম দিয়েছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এক বছরের চেয়ে কিছুটা বেশি সময় অতিবাহিত করেছিলেন। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা অ্যার্ডার্ন ক্ষমতায় আসার এক বছর এখনো পূর্ণ হয়নি।
মিস অ্যার্ডার্নের সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার ছয় মাস আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি সন্তানসম্ভাবনা। তিনি ছয় সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছিলেন এবং তার সহকারীর কাছে সাময়িক সময়ের জন্য দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন। কিন্তু বেনজির ভুট্টো তার গর্ভবতী হওয়ার বিষয়টিকে গোপন রেখেছিলেন এবং ডাক্তারের পরামর্শে দ্রুত কাজে ফিরে আসেন। মিস ভুট্টোর সন্তানসম্ভাবনা হওয়ার বিষয়টি শুধু যে দেশবাসীর কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা নয়, এমনকি তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরাও এ বিষয়ে কিছু জানতেন না। বেনজির ভুট্টোর মন্ত্রিপরিষদের এক সদস্য জাবেদ জব্বার পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমাদের মন্ত্রিপরিষদের কোনো সদস্যই জানতেন না যে প্রধানমন্ত্রী সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছেন। এবং আকস্মিকভাবে আমরা জানতে পারলাম যে তিনি শুধু গণতন্ত্রের জন্ম দেননি, একই সঙ্গে তিনি সন্তানেরও জন্ম দিয়েছেন।’ বেনজির ভুট্টো সে সময় উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভেতরে ছিলেন। যখন বখতাওয়ারের জন্ম হয় সে সময় সেনা-সমর্থিত একটি ডানপন্থী রাজনৈতিক জোট সরকারকে ঘিরে ধরেছিল। তিনি তখন একটি অনাস্থা ভোটে টিকে গিয়েছিলেন। এ অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে মিস ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সে সময় পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বা আইএসআই তার দল থেকে অর্থের বিনিময়ে সংসদ সদস্যদের ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
পাকিস্তানে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য প্রেসিডেন্টের যে একক কর্তৃত্ব ছিল সেটিকে বাতিল করার জন্য সংগ্রাম করছিলেন বেনজির ভুট্টো। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত সফল হননি। সেজন্য মিস ভুট্টো যখন সন্তানসম্ভাবনা হয়েছিলেন তখন তিনি বিষয়টি জনসমক্ষে প্রকাশ করেননি এবং মাতৃত্বকালীন কোনো ছুটিও নেননি। ভুট্টোর ব্যক্তিগত গাইনোকলজিস্ট তার অপারেশন করেছিল এবং সন্তান জন্মের পর ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তিনি দ্রুত কাজে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে মিস ভুট্টো সে সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘পরের দিন আমি কাজে ফিরেছিলাম। সরকারি কাগজপত্র পড়েছি এবং সরকারি ফাইলে স্বাক্ষর দিয়েছি, পরে আমি জানতে পারলাম যে ইতিহাসে আমিই হচ্ছি একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সন্তানের জন্ম দিয়েছে।’
বেনজির ভুট্টো বলেছিলেন যে তার সন্তান জন্মদানের বিষয়টি তখন নারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। কারণ এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে একজন নারী নেতৃত্বের সর্বোচ্চ অবস্থানে থেকে এবং নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সে সন্তানের জন্ম যেমন দিতে পারে তেমনি কাজও করতে পারে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে যত অনিশ্চয়তা এবং বিপদ আছে সেটি অবশ্য নিউজিল্যান্ডের রাজনীতিতে নেই। বখতাওয়ারকে জন্মদানের কয়েক মাস পরে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট গুলাম ইসহাক খান বেনজির ভুট্টোর সরকারকে বরখাস্ত করেছিল। এরপর একটি কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে বেনজির ভুট্টোর প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে।
তৎকালীন বিরোধী নেতা সৈয়দা আবিদা হুসাইন মিস ভুট্টোকে ‘লোভী’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, মিস ভুট্টো দেশের সেবা না করে বরং ‘মাতৃত্ব, পরিবার এবং গ্ল্যামারের’ দিকে বেশি মনোযোগী ছিলেন। মিস ভুট্টোর অপর দুই সন্তানের জন্মও একইভাবে গোপনীয়তার ভেতর দিয়ে হয়েছিল।
১৯৮৮ সালে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং সে বছর নভেম্বর মাসে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। বেনজির ভুট্টো তখন সন্তানসম্ভাবনা ছিলেন এবং তার গর্ভে তখন ছিল বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। একটা কথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে যে গোয়েন্দা রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে জেনারেল জিয়া নভেম্বর মাসের শেষদিকে নির্বাচন ঘোষণা করেছিলেন। কারণ গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে নভেম্বর মাসে মিস ভুট্টোর সন্তান জন্মদানের সময় ঘনিয়ে আসবে এবং সে জন্য তিনি ভালোমতো নির্বাচনী প্রচারণা করতে পারবেন না। কিন্তু বিলাওয়ালের জন্মের খবর আসে সেপ্টেম্বর মাসে এবং নির্বাচনী প্রচারণায় তখন সেটি গতির সঞ্চার করে। বলা হয়ে থাকে, বেনজির ভুট্টো ইচ্ছাকৃতভাবে সন্তানের জন্মদানের সময় সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রচার করেছিলেন।