ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শহীদমাতার আত্মকথা

রাশেদ রহমান
🕐 ১২:৫৮ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৮

চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় রাস্তায় খালি পায়ে হেঁটে নিজের লেখা বই ফেরি করতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন বীরাঙ্গনা তিনি। সারা দিনের আহার সংগ্রহের জন্য নিজের লেখা বই বিক্রি করতে পারলে তবেই আহার জোটে, আর বই বিক্রি না হলে উপোস। তিনি ‘একাত্তরের জননী’ লেখক রমা চৌধুরী। চট্টগ্রামের রমা চৌধুরীকে আমরা একাত্তরের জননী হিসেবেই জানি। ২০১৩ সালের ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন গণভবনে। ৪০ মিনিটের সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রাখায় তাকে আর্থিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিলেন, তিনি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করলেন!

১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করা রমা চৌধুরী পেশায় ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়ায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একাত্তরের ১৩ মে তিন শিশুসন্তান নিয়ে পোপাদিয়ায় গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন রমা চৌধুরী। আর স্বামী ছিলেন তখন ভারতে। ওইদিন সেই এলাকার পাকিস্তানি দালালদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীর লোকজন রমা চৌধুরীদের বাড়িতে হানা দেয়। নিজের মা, পাঁচ বছর ৯ মাস বয়সী ছেলে সাগর ও তিন বছর বয়সী ছেলে টগরের সামনেই তাকে ধর্ষণ করে এক পাকিস্তানি হানাদার। তারা রমা চৌধুরীকে শুধু ধর্ষণেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের বাড়িও পুড়িয়ে দেয়। তখন হানাদারদের হাত থেকে কোনো রকমে বেঁচে যান রমা চৌধুরী। পুকুরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন পুনরায় ধর্ষণের ভয়ে। চোখের সামনে গানপাউডার দিয়ে তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় হানাদাররা। ঘরের মূল্যবান মালামাল, নিজের লেখা সাহিত্যকর্ম চোখের পলকেই পুড়ে যেতে দেখলেন তিনি। কিন্তু হানাদারদের ভয়ে কেউ আগুন নেভাতে সেদিন এগিয়ে যায়নি। এক পর্যায়ে রমা চৌধুরী নিজেই ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করেন ধ্বংসযজ্ঞ রোধ করতে। কিন্তু তার একার চেষ্টায় কিবা তিনি করতে পারেন। চোখের সামনে সব জ্বলে ছারখার হয়ে যায়।
তারপর শুরু হয় লাঞ্ছনার আরেক অধ্যায়। সমাজের চোখে সে একজন ধর্ষিতা নারী। নিকটজনসহ সমাজের কাছে শুরু হলো তার দ্বিতীয় দফা লাঞ্ছিত হওয়ার পালা। পাক-হানাদারদের কাছে নির্যাতিত হওয়ার পর সমাজের লাঞ্ছনায় এবং ঘরবাড়ি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়লেন রমা চৌধুরী। পোড়া দরজা-জানালাবিহীন ঘরে শীতের রাতে বস্ত্রহীন থাকতে হয়েছে মাটিতে। গরম বিছানাপত্র নেই। সব পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভাত জুটে না। অনাহারে-অর্ধাহারে কষ্টে সন্তানদের অসুখ করল।
সাগর আর টগর শীতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ছেলেকে সুস্থ করতে তখন পাগলপ্রায় রমা চৌধুরীর। ঠিক বিজয়ের আগের রাতে ১৫ ডিসেম্বর থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় সাগরের। গ্রামের এক সাধারণ ডাক্তারের চেষ্টায় কি আর হয়। সেই চেষ্টায় কোনো কাজ হলো না। ২০ ডিসেম্বর রাতে সাগর মারা গেল। প্রথম সন্তানকে হারিয়ে রমা চৌধুরী উন্মাদ হয়ে গেলেন। একই অসুখে আক্রান্ত হলো দ্বিতীয় সন্তান টগরও। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্ধউন্মাদিনী রমা চৌধুরী নিজের ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গেলেন। নিজের অসাবধানতায় কখন যে ছেলে টগরের শ্বাসরোধ হয়ে গেল, টের পেল না। এভাবে টগরও মারা গেল।
রমা চৌধুরীর পরের ইতিহাস আরও বিপর্যয়ের, আরও করুণ। মুক্তিযুদ্ধে নিজের সম্ভ্রম হারানোর পর দুই সন্তান হারানো রমা চৌধুরী তখন অর্ধপাগল। তার মধ্যে সমাজের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অভাব, জীবন সংগ্রাম ইত্যাদি সব মিলিয়ে এক সময় রমা চৌধুরীর প্রথম সংসারেরও পরিসমাপ্তি ঘটল। পরে দ্বিতীয় সংসার বাঁধতে গিয়ে হলেন প্রতারণার শিকার। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল।
রমা চৌধুরী জীবনে আর জুতা পরেননি। হিন্দু ধর্মীয় রীতিতে শবদেহ পোড়ানোতে বিশ্বাস করেন না রমা চৌধুরী। তাই তিন সন্তানকেই দেওয়া হয়েছে মাটিচাপা। প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতা পরেননি রমা চৌধুরী। এরপর নিকটজনের পীড়াপিড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতা পরা শুরু করলেও তৃতীয় সন্তান মারা যাওয়ার পর আবার ছেড়ে দিয়েছেন পায়ে জুতা পরা। তারপর টানা ১৫ বছর জুতা ছাড়া খালি পায়েই পথ চলেছেন রমা চৌধুরী।
শিক্ষকতা থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি নিজের বই চট্টগ্রামের পথে পথে খালি পায়ে ফেরি করে প্রাপ্ত অর্থ নিজে জীবনধারণের পাশাপাশি তিনি তার অকালপ্রয়াত ছেলের নামে ‘দীপংকর স্মৃতি অনাথআলয়’ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্ব হারা একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী সারা জীবন এ দেশের মানুষের কল্যাণে কাটিয়ে দিয়েছেন।

 
Electronic Paper