ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ঢাকাই মসলিন

রোকেয়া ডেস্ক
🕐 ১২:১৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৯

বাংলাদেশের সুপ্রাচীন কালের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের গৌরবময় স্মারক মসলিন। প্রথম খ্রিস্টাব্দের প্রথম শতকেই রোম সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে অভিজাত রোমান নারীরা ঢাকার মসলিন পরে দেহসৌষ্ঠব প্রদর্শন করতে ভালোবাসতেন। একই শতকে রচিত ‘পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি’ শীর্ষক গ্রন্থে মসলিন সম্পর্কে বিশেষ ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। এতে মোটা ধরনের মসলিনকে মলোচিনা, প্রশস্ত ও মসৃণ মসলিনকে মোনাচি এবং সর্বোৎকৃষ্ট মসলিনকে গেনজেটিক বা গঙ্গাজলী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘গঙ্গাজলী’ বা ‘গঙ্গার জল’ শাড়ির কথা খ্রিস্টীয় বিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে প্রচলিত ‘সোনাই বিবির পালা’তে প্রত্যক্ষ করা যায়। এখানে প্রথম খ্রিস্টাব্দে ভিনদেশিদের বর্ণিত মসলিনের বিবরণের সঙ্গে বাংলাদেশের মৌখিকরীতিতে প্রচলিত কিচ্ছাপালার বর্ণনার অসাধারণ সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়। তার অর্থ মসলিনের দুই হাজার বছরের স্মৃতিসত্তা লোকায়ত বাংলাদেশের মানুষের চেতনায় সজীব রয়ে গেছে। পাশাপাশি মসলিনের ইতিহাস অন্বেষণে প্রাচীনকালের হেরোডোটাস, স্ট্র্যাবো হতে টলেমি, প্লিনি পর্যন্ত অনেক ইতিহাসবিদের রচনায় ঢাকাই মসলিনের উল্লেখ পাওয়া যায়।

ঢাকাই মসলিন প্রাচীন ব্যাবিলনে বিশেষ খ্যাতিলাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। গবেষেক উইলফোর্ড মন্তব্য করেছেন, একটি ব্যাবিলিয়ন বস্ত্র ফিরিস্তিতে ঢাকাই মসলিনের উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার বিলাস-ব্যসনেও ঢাকাই মসলিন ব্যবহৃত হতো। মিসরের প্রাচীন কবরে বাংলাদেশের নীলে রঞ্জিত ও মসলিনে জড়ানো মমির সন্ধান পাওয়া গেছে। ইয়েট বলেন-খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে ঢাকাই মসলিন গ্রিসে বিক্রি হতো।

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ডেনিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বাংলার তাঁতিরা কোনো ‘মেশিন’ ছাড়াই নিজেদের উদ্ভাবিত অতি সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে অত্যন্ত সুন্দর ও অতিসূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি করে। মসলিন হলো- বিশেষ এক প্রকার তুলার আঁশ থেকে প্রস্তুতকৃত সূতা দিয়ে বয়ন করা এক প্রকারের অতি সূক্ষ্ম কাপড়বিশেষ। ফুটি কার্পাস নামক তুলা থেকে প্রস্তুত অতি চিকন সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি করা হত। চরকা দিয়ে কাটা, হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হত যার ফলে মসলিন হত কাচের মত স্বচ্ছ।

গবেষকদের মতে, মসলিন তৈরির প্রাচীনতম কেন্দ্র ছিল অধুনা ভাওয়াল জঙ্গলে পরিবেষ্টিত কাপাসিয়া। মধ্যযুগে ঢাকাই মসলিন তৈরির প্রধান উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হয় সোনারগাঁও এবং আধুনিক যুগে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনাবেষ্টিত ১৯৬০ বর্গমাইল জুড়ে উৎকৃষ্ট মসলিন তৈরি হতো। এই অঞ্চলে ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে চার হাজার এক শত ষাটটি তাঁতে মসলিন তৈরি হতো। ঢাকা, সোনারগাঁও, ডেমরা, তিতবদ্ধী, বালিয়াপাড়া, নাপাড়া, মৈকুলি, বাছারক, চরপাড়া, বাশটেকি, নবীগঞ্জ, শাহপুর, ধামরাই, সিদ্ধিরগঞ্জ, কাচপুর প্রভৃতি জায়গাগুলো মসলিন তৈরির প্রধান কেন্দ্র ছিল।

বিভিন্ন গবেষণায় অন্তত ১৫ প্রকার মসলিনের নাম পাওয়া যায়,
যেমন- ১. মলবুস খাস, যা সাধারণত মোগল বাদশাহ ও পরিবারবর্গ ব্যবহার করতেন, অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে মোগল বাদশাহদের জন্য মসলিন পাঠানো বন্ধ হয়ে গেলে মলমল খাস নামে আরেক ধরনের উন্নতমানের মসলিন তৈরি শুরু হয়।
২. সরকার-ই-আলা (আলি), বাংলার নবাব সুবাদারদের জন্য এগুলো তৈরি হতো।
৩. আব-ই-রওয়ান, প্রবহমান পানির সঙ্গে মিশে যেতে পারত এ ধরনের মসলিন।
৪. ঝুনা, নবাব-বাদশাহ শুধু নয়, ধনী ও বিত্তশালী পরিবারের মেয়েরা ঝুনা ব্যবহার করতেন, তাছাড়া গায়িকা ও নর্তকীরাও ঝুনার তৈরি জামা ব্যবহার করতেন।
৫. শবনম, এত মিহি ছিল যে, ভোরবেলা শিশির ভেজা ঘাসে শুকোতে দিলে শিশির আর এই মসলিনের পার্থক্য বোঝা যেত না।
৬. নয়নসুখ বা তনসুখ, সাধারণত গলাবন্ধ রুমাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
৭. খাসা, অত্যন্ত মিহি, সূক্ষ্ম ও ঘন করে বোনার জন্য বিখ্যাত ছিল।
৮. আলাবালি বা আলিবালি।
৯. তনজেব, শরীর বা দেহের সৌন্দর্যবর্ধক হিসেবে এই মসলিনের সুনাম ছিল।
১০. তরন্দাম, অন্যান্য মসলিনের তুলনায় কিছুটা মোটা।
১১. সরবন্দ, ইউরোপের মেয়েরা সরবন্দ দিয়ে তৈরি জামা, রুমাল ও স্কার্ফ ব্যবহার করতেন এবং উচ্চপদস্থরা সরবন্দ মসলিনে তৈরি মাথার পাগড়ি পরতেন।

 
Electronic Paper