ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

একাত্তরের দুই অগ্নিকন্যা

‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’ ও ডা. সিতারা বেগম

আফনান আহমেদ
🕐 ১২:৫০ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৭, ২০১৯

মার্চ মাস ১৯৭১। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ঈদের ছুটিতে বাসায় ফেরেন মেজর এটিএম হায়দার। সঙ্গে ছোট বোন ডা. সিতারা। বছরখানেক হলো সিতারা ঢাকা মেডিকেল থেকে ইন্টার্নশিপ শেষ করেছে। এখন কাজ করছে সেনা মেডিকেলে, পোস্টিং ওই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টেই, লেফটেন্যান্ট হিসেবে।

ঈদের ছুটি শেষ হতে না হতেই চলে আসে একাত্তরের উত্তাল মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশব্যাপী শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বড় ভাই এটিএম হায়দার ক্যান্টনমেন্টে ফিরে গেছেন যুদ্ধ শুরুর আগেই, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না খুব বেশি। যুদ্ধের প্রথম কয়েক মাস ডা. সিতারা পরিবারসহ পালিয়ে বেড়ান বিভিন্ন স্থানে।

জুলাইয়ের শেষাশেষি দুজন মুক্তিযোদ্ধা আসেন সিতারা বেগমের কাছে। হাতে তুলে দেন একটা চিঠি, আর ছোট একটা রিভলভার। চিঠিতে বড় ভাইয়ের নির্দেশ ছিল ভারতে চলে যাওয়ার। আর রিভলভারটা পাঠানোর কারণ যাত্রাপথে পাক সেনাদের কাছে ধরা পড়লে যেন আত্মহত্যা করতে পারে সিতারা।

সিতারা বেগম চলে আসেন মেঘালয়ে। বড় ভাই এটিএম হায়দার তখন মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরের সহ-অধিনায়ক। যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতে এই সেক্টরের অধীনেই একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। গর্ব করে যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বাংলাদেশ হসপিটাল’। নিজের ডাক্তারি বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে সিতারা বেগম এই হাসপাতালের কাজে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের দুঃসময়ে আহত মুক্তিযোদ্ধা, সৈনিক এবং সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবায় হাসপাতালটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত সম্পূর্ণ বাঁশ দিয়ে তৈরি ৪০০ শয্যার বাংলাদেশ হাসপাতালটি আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে। দায়িত্ব পালনের কিছুদিনের মধ্যেই ডা. সিতারা বেগম হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসার (সিও) হিসেবে নিয়োজিত হন। হাসপাতালটিতে মেডিকেলের শেষ বর্ষের ৪-৫ জন ছাত্র কর্মরত ছিলেন। লন্ডন থেকে ডা. মবিন, ডা. জাফরুল্লাহ, ডা. কিরণ সরকার দেবনাথ, ডা. ফারুক মাহমুদ, ডা. নাজিমুদ্দিন, ডা. আকতার, ডা. মুর্শেদ প্রমুখ এ হাসপাতালে কাজ করেছেন।

শুধু আহত মুক্তিযোদ্ধাই নয়, চিকিৎসার জন্য আসতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। ডা. ক্যাপ্টেন সিতারা তার মেধা, শ্রম-ঘাম, সেবা দিয়ে শুধু চিকিৎসাই করেননি মুক্তিপাগল বাঙালির সাহসও জুগিয়েছেন।

বীরপ্রতীক সিতারা বেগমের জন্ম ১৯৪৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার তালতলায়। মো. ইছরাইল মিয়া ও হাকিমুন্নেছার দুই ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে সিতারা তৃতীয়। ১৯৬১ সালে সিতারা বেগম কিশোরগঞ্জ এসভি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, ঢাকা হলিক্রস কলেজ থেকে বিজ্ঞানে প্রি-মেডিকেল ও ১৯৬৩-৬৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে লেফটেন্যান্ট হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। ’৭০-এর আগুনঝরা দিনগুলোতে সিতারা বেগম কুমিল্লা সেনানিবাসে ছিলেন।

১৬ ডিসেম্বর রাতে বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ হাসপাতালে রেডিওর মাধ্যমে ডা. সিতারা বেগম ও তার সহকর্মীরা ঢাকা মুক্ত হওয়ার সংবাদ পান। ডিসেম্বরের শেষের দিকে তিনি কলকাতায় বদলি হন। এক সপ্তাহ পর ঢাকায় চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে এ মহিয়সী নারীর সাহসী আবদানের জন্য তাকে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম ১৯৭২-এর অক্টোবরে ক্যাপ্টেন আবেদুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ক্যাপ্টেন আবেদ একজন চিকিৎসক এবং মুক্তিযোদ্ধা। তিনি জেনারেল শফিউল্লাহর অধীনে ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। স্বামী ১৯৭৩-এ উচ্চ শিক্ষার্থে দেশের বাইরে গেলেন। তাকেও সঙ্গে যেতে হলো। যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলেন।

বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, তোমরা যারা যুদ্ধ করলে তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছো? ডা. সিতারা বেগম দুই মেয়ে ও এক ছেলের জননী। বর্তমানে স্বামীসহ আমেরিকায় বসবাস করছেন।

 
Electronic Paper