ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নারী জাগরণের বিস্ময় রোকেয়া

রাশেদ রহমান
🕐 ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৮

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। গত শতাব্দী থেকে এই নাম নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব শিক্ষিত মানুষের কাছে পরিচিত ও গ্রহণযোগ্য। খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে তিনি অনন্য নারী ব্যক্তিত্ব। বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত তিনি। লেখা, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, নারী উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা ইত্যাদি কর্মের মাধ্যমে তিনি নিজেই একজন প্রতিষ্ঠান-ঊনবিংশ শতকের বিস্ময়!

ড. আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন, ‘চিন্তায়, চেতনায়, কর্মে নারী জাগরণে তথা বাংলার নবজাগরণে তার ভূমিকা দ্বিতীয় রহিত। আধ্যাত্মিকতার স্থলে ঐচ্ছিকতা, গড্ডলের স্থলে ব্যক্তিকতা, ভাবালুতার স্থলে ভাবুকতা, আবেগের স্থলে যুক্তিশীলতা, প্রশ্নহীন সমর্থনের স্থলে জিজ্ঞাসু বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা, বিমূর্ত কল্পনার স্থলে যুক্তিশীলতা, প্রশ্নহীন সমর্থনের স্থলে মনস্বিতা ও তার সকর্মক প্রয়োগ-বেগম রোকেয়া রেনেসাঁসের এসব চরিত্র লক্ষণ অসম্ভব উজ্জীবিত।’

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ড. সৈয়দ তানভীর নাসরিন লিখেছেন, ‘রোকেয়ার বহুমুখী প্রতিভার বিকাশ ও স্ফুরণ ঘটেছে তার যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে কেন্দ্র করে। সেই চিন্তন তার লেখায় পরিস্ফুট হয়েছে, তেমনই তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপকেও পরিচালিত করেছে।’

রোকেয়া শৈশবে বড় দুই ভাই এবং বড় বোনের কাছে লেখাপড়া শেখার সুযোগ পান। বাবা-মা দুজনেই ছিলেন শিক্ষাবিরোধী, সংস্কারাচ্ছন্ন ও অবরোধ সমর্থক। বাবার অপব্যয় বিলাসী জীবনযাপনে জমিদারি অবস্থাও খারাপ হয়ে পড়ে। বাড়িতে রোকেয়ার একাকী নিঃসঙ্গ জীবনে মায়ের কাছে ধর্ম ও গার্হস্থ্য শিক্ষার সুযোগ ঘটে। তাদের ঘরে আরবি ও উর্দু শেখানো হয়। তবে রোকেয়ার আধুনিক মনস্ক বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের রোকেয়া ও করিমুন্নেসাকে ঘরেই গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শেখান। রোকেয়ার জ্ঞানপিপাসা ছিল অসীম। তারা রোকেয়ার শিক্ষা-দীক্ষার কাজটি খুব গোপনে, বাবা-মার অগোচরে সমাধা করতে সমর্থ হন। গভীর রাতে সবাই ঘুমালে চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে মোমবাতির আলোতে বড় ভাইয়ের কাছে ইংরেজি ও বাংলা শিখতেন রোকেয়া।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। বিয়ের পর তিনি ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’ নামে পরিচিত হন। তার স্বামী মুক্তমনা মানুষ ছিলেন। রোকেয়াকে তিনি লেখালেখি করতে উৎসাহ দেন এবং একটি স্কুল তৈরির জন্য অর্থ আলাদা করে রাখেন। রোকেয়া সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্য জগতে পদার্পণ করেন। বেগম রোকেয়া নারী উন্নয়নে সমাজ সংস্কারে ও গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে শুধু বক্তৃতা বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তার উদ্দেশ্য লক্ষ্যের স্থায়ী ও সুদূরপ্রসারী বাস্তবায়নের জন্য অসীর মতো মসির ব্যবহার করেছেন।

স্কুল প্রতিষ্ঠা ছিল রোকেয়ার একটি আন্দোলন। কেননা শিক্ষাকে তিনি নারীর শারীরিক ও মানসিক শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ শক্তি অর্জন করলে নারীর বিকাশ ঘটবে। পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে তার ক্ষমতায়ন ঘটবে। তাই স্কুলটি গড়ে তোলা, অর্থ সংগ্রহ ও ছাত্রী সংগ্রহের জন্য তিনি তার জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। স্কুলটি ভালো করবার জন্য তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। মানুষের নিন্দা সহ্য করেছেন, কটূকথাও শুনেছেন শিক্ষিত মামুষের মুখে। তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না বলে তিনি প্রধান শিক্ষিকা বা প্রশাসনিক পদে থাকতে চাননি সত্য, কিন্তু স্কুলের প্রতিটি কাজ তার নির্দেশ ও পরামর্শে পরিচালিত হতো। তিনি প্রেসে গিয়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিজে প্রুফ দেখে ছাপিয়ে এনেছেন, সরকারি অফিসে গিয়েছেন স্কুলের কাগজপত্র নিয়ে। এসব কাজ কারুর হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকেননি। তিনি ছিলেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। সুতরাং সর্বত্র তার যাতায়াতে কোনো বাধা ছিল না। তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। পরে ব্যস্ততা ও অসুস্থতায় তা হয়ে ওঠেনি। তাই তিনি পরিহাস করে বলতেন, ‘কেয়ামতের পর আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া হবে।’

নিজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, হয়েছিল বাল্যবিয়ের শিকার-এসব নিয়ে তিনি আজীবন মনে মনে পোষণ করছেন ক্ষোভ। তিনি লিখেছেন-‘শৈশবে বাপের আদর পাইনি, বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর রোগের সেবা করেছি। প্রত্যহ ইউরিন পরীক্ষা করেছি, পথ্য রেঁধেছি, ডাক্তারকে চিঠি লিখেছি। দু’বার মা হয়েছিলুম-তাদেরও প্রাণভরে কোলে নিতে পারিনি। একজন ৫ মাস বয়সে, অপরটি ৪ মাস বয়সে চলে গেছে। আর এই ২২ বৎসর যাবৎ বৈধব্যের আগুনে পুড়ছি।’ কিন্তু গড়পড়তা মানুষ আর তার মধ্যে ফারাকটা তো ওই খানেই। জীবনের এ বিরুদ্ধবাদী আচরণে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আর সেই ক্ষোভের আগুন দেশের, নারীদের উন্নয়নে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। কষ্ট তাকে করে তুলেছিল পরিশুদ্ধ সোনায়। তিনি চেয়েছেন নিজে যে বঞ্চনা জীবন সয়েছেন, এ দেশের যেন আর একজন মানুষকে, আর একজন নারীকে এই কষ্ট সইতে না হয়।

 

 
Electronic Paper