ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সীমার বিস্ময়কর গল্প

রাশেদ রহমান
🕐 ১০:০০ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৮, ২০১৮

মা! শব্দটি কত কোটি ঝরনার উৎসবিন্দু তা কেউ বলতে পারে না। মায়েরা কী পরিমাণ ভালোবাসা নিয়ে সন্তানের পাশে দাঁড়াতে পারেন সেটাও আজ পর্যন্ত অনুনমেয়। আমাদের মাঝে এমন মা আছেন, যার ছেলের বয়স ১৮, কিন্তু তাকে কোলেপিঠে নেওয়ার পার্ট আজও চুকোয়নি। আজকে আমরা তেমনই এক মায়ের কথা বলব। হৃদয়ের মা সীমা সরকার।

মায়ের কোলে চড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা হৃদয় সরকারের ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব দ্রুত ভাইরাল হয়েছিল। ভর্তি পরীক্ষায় ১২০ দশমিক ৯৬ নম্বর পেয়ে ৩ হাজার ৭৪০তম হন। প্রতিবন্ধী কোটায় আবেদন করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবন্ধী কোটার বিধিমালা অনুযায়ী, কোটা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোটার বিধিমালায় পরিবর্তন আনা হয়, ভর্তির সুযোগ তৈরি হয় হৃদয়ের। সব শেষে হৃদয় সরকার এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আর হৃদয়ের মা হয়েছেন ‘ফুলটাইম মাদার’।

সীমা সরকারের এই উপাধি এসেছে বিবিসির কাছ থেকে। বিবিসির ১০০ নারীর এই তালিকায় সীমা ছাড়াও রয়েছেন- যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মেয়ে চেলসি ক্লিনটন, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড ও পাকিস্তানের প্রথম হিন্দু নারী সিনেটর কৃষ্ণকুমারীর মতো নারীরা। বিশ্বের ৬০টি দেশের ১৫ থেকে ৯৪ বছর বয়সী বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীদের নিয়ে এ তালিকা তৈরি করেছে বিবিসি। তালিকায় ৮১তম অবস্থানে রয়েছেন হৃদয়ের মা সীমা সরকার।

কিন্তু এ পর্যন্ত আমার জন্য হৃদয়ের মাকে কোনো অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তা পাঠক ভাবতেও পারবেন না! ছোটবেলা থেকেই হাঁটতে পারেন না হৃদয়। ১৮ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী ছেলে হৃদয়কে কোলে করে মা সীমা সরকার স্কুল পার করিয়েছেন, কলেজ পার করিয়েছেন এবং বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রেও পঙ্গু ছেলেকে কোলে করেই নিয়ে আসেন মা। তিন-চারতলা সিঁড়ি মাড়িয়ে ছেলেকে পরীক্ষার আসনে বসান। এই ছবিই সাড়া জাগায় সামাজিক যোগাগোগমাধ্যমে।

‘ফুলটাইম মাদার’ সীমা যেন ফুলটাইম সংগ্রামী। এসএসসি পাস করার আগেই বিয়ে হয়ে যায় তার। স্বামী সমীরণ সরকার ইটের ভাটায় কাজ করেন। বিয়ের বছর দুয়েকের মাথায় হৃদয়ের জন্ম। এখন তাদের দুই সন্তান-হৃদয় ও অন্তর। অন্তর পড়ে ক্লাস সেভেনে। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভাঙে সীমার। ঘরদোর পরিষ্কার করে সকালের নাশতা রেডি করেন। এরপর হৃদয়কে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। বাথরুমে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসেন। তারপর এনে পড়ার টেবিলে বসান। ৮টা নাগাদ সবাই মিলে নাশতা খেতে বসেন। এর মধ্যে অন্তরের স্কুলের সময় হয়ে যায়। হৃদয়কে বিছানায়, নয়তো বারান্দায় বসিয়ে দুপুরের রান্নার আয়োজন করেন। এক ফাঁকে হৃদয়কে স্নান করান। দুপুরে খাওয়ার পর তাকে আবার বিছানায় দিয়ে আসেন। বিকালে আবার পড়তে বসে হৃদয়। পড়াশোনা শেষে রাতে কিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখে। রাতের খাবার শেষে বিছানায় নিয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আসেন মা।

কিন্তু প্রতিবন্ধী ছেলেকে পড়াশোনা করানোয় মায়ের এই শারীরিক কষ্ট স্বীকারের পরও পারিবারিক, সামাজিক কম নিগ্রহের শিকার হতে হয়নি! স্বল্প আয়ের পরিবারে প্রতিবন্ধী শিশুকে পড়াতে গিয়ে আর্থিক অনটনেও পড়তে হয়েছে। তবু দমেননি মা। সব প্রতিবন্ধকতা উড়িয়ে দিয়ে ছেলেকে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে দিনরাত শ্রম দিয়েছেন। সেসব শ্রমের ঘামের যথাযোগ্য ফলও তিনি পেয়েছেন আজ। ছেলে আজ ঢাবির কলা অনুষদের ছাত্র। আর মা সীমা সরকার পেয়েছেন বিবিসির ‘ফুলটাইম মাদার’ খেতাব।

 
Electronic Paper