মশালকন্যা সুফিয়া কামাল
শিমুল জাবালী
🕐 ৫:০৫ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২১, ২০১৮
২০ নভেম্বর ছিল সুফিয়া কামালের ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। বিংশ শতকের সর্বশেষ বছরে ইহধাম ত্যাগ করেন এই মহীয়সী। একাধারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম স্নেহধন্য এই নারী যুক্ত ছিলেন ৫০ থেকে ৭০ দশকের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে-
সাহিত্য ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ নজরুলের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ ও তাদের প্রশংসায় ধন্য, নারীমুক্তি আন্দোলনে বেগম রোকেয়ার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা, বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাসহ দেশবাসীর মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে যিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়েছেন তিনি হলেন কবি সুফিয়া কামাল। নামটির সঙ্গে মিশে আছে অসংখ্য আবেগ, অনুভূতি, ভালোলাগা, ভালোবাসা ও নারীর আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করার মনোবল। শুধু কবিই নন, তিনি একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, সমাজসেবক, শিক্ষক ও সংগ্রামী নেতৃত্ব। তার কবিতায় মিশে আছে প্রেম, প্রকৃতি, ব্যক্তিগত অনুভূতি, বেদনাময় স্মৃতি, স্বদেশের প্রতি মমতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
মূলত তিনি কবি। তার লেখার ঝুলিতে কবিতা ছাড়াও আরও আছে ভ্রমণ কাহিনী, ডায়েরি, ছোটগল্প, উপন্যাস ও শিশুতোষ গ্রন্থ। সব মিলিয়ে প্রকাশিত প্রন্থের সংখ্যা ২০টিরও বেশি। সেসবের মধ্যে কেয়ার কাঁটা, মায়া কাজল, মন ও জীবন, উদাত্ত পৃথিবী, অভিযাত্রিক, ভ্রমণ কাহিনী সোভিয়েত দিনগুলি, স্মৃতিকথা, একাত্তরের ডায়েরি ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে শায়েস্তাবাদে জন্ম এই মহীয়সী নারীর। পিতা সৈয়দ আবদুল বারী ছিলেন সেই সময়কার নামকরা উকিল। কিন্তু পিতার স্নেহ বেশি দিন দীর্ঘায়িত হয়নি সুফিয়া কামালের জন্য। সাত বছর বয়সেই বাবা গৃহত্যাগী হন। ফলে পিতার অনুপস্থিতিতে মা সৈয়দা সাবেরা খাতুন অসম্ভব স্নেহ-ভালোবাসায় লালন-পালন করতে থাকেন শিশু সুফিয়াকে।
নারীরা তখন পশ্চাদপদ। বাইরে তো দূরের কথা, ঘরেও মেয়েদের পড়ালেখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। সে সময় মায়ের হাত থেকেই প্রথম বই পাওয়ার আনন্দ পান সুফিয়া কামাল। বাড়িতে উর্দুর চল থাকলেও নিজের চেষ্টায় বাংলায় লিখতে পড়তে শেখেন তিনি। সুফিয়া কামালের জীবনের দিক পরিবর্তনের সূচনা হয় আরেক মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে। ১৯১৮ সালে মায়ের সঙ্গে যখন প্রথম কলকাতায় যান তিনি, তখন তার পরিচয় হয় বেগম রোকেয়ার সাঙ্গে। বেগম রোকেয়ার দর্শন, নারী জাগরণের মনোভাব এবং সাহিত্যানুরাগ ভীষণভাবে নাড়া দেয় শৈশবের সুফিয়াকে। রক্ষণশীল পরিবারের নিয়মানুযায়ী, মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিয়ে হয়।
স্বামী নেহাল হোসেন যেন সুফিয়ার জীবনে এক অপ্রত্যাশিত আশীর্বাদ হয়ে এলেন। নেহাল হোসেন নিজেও ছিলেন লেখক, সাহিত্যিক ও সমাজসেবী। স্ত্রীর এসব বিষয়ে আগ্রহ দেখে নেহাল হোসেন বিভিন্নভাবে সুফিয়াকে উৎসাহ দিতে লাগলেন। সাধারণ এক গৃহিণী থেকে সাহিত্যের আলোয় নিজেকে মেলে ধরার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১৯২৩ সালে তিনি রচনা করেন তার প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’, যা বরিশালের সে সময়কার জনপ্রিয় ‘তরুণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। স্বামীর প্রেরণায় সুফিয়া কামাল ধীরে ধীরে কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করেন। এ সময় কলকাতায় আরেকজন ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় ঘটে সুফিয়া কামালের, তিনি হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সুফিয়া কামালের কবিতা পড়ে বিশেষভাবে মুগ্ধ হন।
১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধী যখন বরিশাল আসেন তখন সুফিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। মহাত্মা গান্ধীর জীবনদর্শন এবং অহিংসা আন্দোলন অল্প বয়সী সুফিয়াকে এতটাই নাড়া দিয়ে যায়, তিনি কিছুদিন চরকায় সুতা কাটতে শুরু করেন। এর পাশাপাশি তিনি নারী কল্যাণমূলক সংগঠন ‘মাতৃমঙ্গল’-এ যোগ দেন। ১৯২৯ সালে বেগম রোকেয়া কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম’-এ যোগদান করেন। এসব কাজের ফাঁকে চলতে থাকে কবিতা চর্চা। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’, যার প্রস্তাবনা লেখেন কবি নজরুল। বইটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুফিয়া কামালের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এর পর থেকেই মূলত, সুফিয়া কামালের কবি হিসেবে সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাটি কবির জীবনে আসে ১৯৩২ সালে, স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি অকুল পাথারে পড়ে যান। কোনো কুলকিনার না পেয়ে শিক্ষকতা পেশা বেছে নেন। এই পেশাতে থাকা অবস্থায় সুফিয়া কামালের সঙ্গে পরিচয় হয় খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির এবং পল্লীকবি জসীমউদদীনের। ১৯৩৯ সালের দিকে কবি চট্টগ্রামের লেখক ও অনুবাদক কামালউদ্দীন আহমদকে বিয়ে করেন। সেই থেকে তিনি ‘সুফিয়া কামাল’ নামে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন। কবির সংগ্রামী জীবনের পথে সৌভাগ্যবশত স্বামী কামালউদ্দীনকেও তিনি ভালো ঢাল হিসেবে পেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল বেগম সুফিয়া কামালের অতুলনীয় স্নেহ-মমতা। তিনি যেমন বঙ্গবন্ধুকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখতেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুও তাকে বড় বোনের মতো শ্রদ্ধা করতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা- তাকে আবার প্রতিবাদী করে তোলে। সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে সব ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে তিনি এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’-এর সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় আশি বছর বয়সে মিছিলে নেতৃত্বদান ছিল তার সংগ্রামী জীবনের আরেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা সে সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সংগ্রামরত দেশবাসীকে উজ্জীবিত করেছিল।
১৯৫২ সালের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে কবি সুফিয়া কামাল এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন’ নামে একটি আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯৬৯ সালে ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ যা বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নামে পরিচিত, তার হাত ধরেই গঠিত হয়। এ ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটি এবং দুস্থ পুনর্বাসন সংস্থা, ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন এবং নারী কল্যাণ সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচি-কাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবিও তোলেন কবি সুফিয়া কামাল। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় কবিতা পুরস্কার ও স্বাধীনতা দিবস পদকসহ ৫০টি পুরস্কার পান। সুফিয়া কামালের কবিতা চীনা, ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান, পোলিশ, রুশ, ভিয়েতনামিজ, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়েছে।