ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কর্জে হাসানা

প্রফেসর সৈয়দ ড. মাকসুদুর রহমান
🕐 ২:৩০ অপরাহ্ণ, জুন ১১, ২০২১

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কর্জে হাসানা

আর্থ-সামাজিক বলতে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ও সামাজিক জীবন এর মাঝে সম্পর্ককে বুঝায়। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে জিডিপি, জীবনমান, শিক্ষার হার এবং শ্রমিকের স্তরের উন্নতি (social development) আর কর্জে হাসানা তথা সুদবিহীন ঋণের আদান-প্রদানের ব্যাপারে ইসলামে সুনির্দিষ্ট কল্যাণকর নির্দেশনা বিদ্যমান আছে। সমাজ জীবনে যার চর্চা ও প্রয়োগ আবশ্যক। এ বিধানগুলো ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতা- উভয় শ্রেণির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশনা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন,
অর্থ :“এমন কে আছে যে, আল্লাহকে ঋণ প্রদান করবে? উত্তম ঋণ ; যাতে আল্লাহ তার জন্য তা দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিতে পারেন। আল্লাহই (জীবিকা) সংকুচিত করেন এবং তিনিই তা সম্প্রসারিত করেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা সবাই ফিরে যাবে।” (২:২৪৫)। যদি মানুষ আল্লাহ তাআলা এই নির্দেশনার আলোকে তাদের আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করে তাহলে সমাজের অনেক সমস্যা থাকবে না। রাসূলুল্লাহ্ [সা.] ইরশাদ করেন,

অর্থ : তিন ধরনের লোক জান্নাতী (১) যারা ন্যায় ও নীতিবান শাসক (২) যারা সত্যবাদী ও ক্ষমতা পেলে সৎকাজ করে এবং (৩) ওই সমস্ত ব্যক্তি যারা ক্ষমাশীল ও দয়াবান তাদের আত্মীয়-স্বজন, ধার্মিক মুসলিমের প্রতি এবং যে ধৈর্য সহকারে পরিবারের ভরণ-পোষণ করে। (সহীহ্ মুসলিম) সুতরাং কর্জে হাসানা হলো উপকারী ঋণ, উত্তম ঋণ, সহানুভূতির ঋণ, সুদমুক্ত ঋণ, সুন্দর ঋণ। সুতরাং সুদবিহীন এ ঋণ দারিদ্র বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যার কারণে সমাজের প্রতিটি নাগরিকের উন্নয়ন হয়।

ভূমিকা
ইসলামী অর্থনীতি ব্যবস্থায় কর্জে হাসানার গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামী সমাজের ধনীরা দরিদ্র মানুষের জন্য দান করবেন। এরপরেও যদি কারওর সমস্যা তৈরি হয় সে ক্ষেত্রে কর্জে হাসানা প্রদান করবেন। যদি তিনি পরিশোধ করতে পারে তবে অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করবেন। যদি তার পরিশোধ করার সামর্থ্য না থাকে তাহলে তাকে ক্ষমা করে দিলে দ্বিগুণ সাদকার সাওয়াব পাবেন। নিশ্চয়ই দানশীল যারা আল্লাহকে উত্তমরূপে ধার দেয়, তাদের দেওয়া হবে বহুগুণ সাওয়াব। তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।’ তবে এজন্য শর্ত হচ্ছে, প্রদানকৃত বস্তুটি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ঋণদাতা খাতকে তাগাদা না দেওয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
“ঋণী যদি অভাবগ্রস্ত হয়, তবে তার সচ্ছলতার জন্য অপেক্ষা কর, আর যদি ঋণ ফেরত দেওয়ার ক্ষমতাই না থাকে তাহলে তাদের ঋণ মাফ করে দেওয়াই উত্তম। যদি তোমরা তা জানতে।” (২:২৮০)
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
হ্যাঁ, যে ব্যক্তি পাপ অর্জন করেছে এবং সে পাপ তাকে পরিবেষ্টিত করে নিয়েছে, তারাই দোজখের অধিবাসী। তারা সেখানেই চিরকাল থাকবে। [ সুরা বাকারা- ২:৮১ ]
কর্জে হাসানার মাধ্যমে আমাদের সমাজে অনেক কল্যাণকর বিষয় পাওয়া গেছে। যদিও চোখে পড়ার মতো তেমন কোনো পরিবর্তন না দেখা গেলেও এর নেপথ্যে রয়েছে অনেক মানবিক অধিকার। যেমন, আর্থ-সামাজিক দৈন্য, পারিবারিক কলহসহ নানা অসংগতি দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আলোচ্য প্রবন্ধে কর্জে হাসানা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এর সুফল এবং ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবতা আলোচনা করা হয়েছে।

কর্জে হাসানা এর সংজ্ঞা
* শাব্দিক অর্থ
ঋণের আরবি শব্দ ‘কর্য’, যা প্রচলিত বাংলা ভাষায় কর্জ নামে পরিচিত। এর বাংলা সমার্থবোধক শব্দ হচ্ছে, দেনা, ধার, হাওলাদ ইত্যাদি। ঋণ শব্দটা বিশেষ্য পদ অর্থ কর্জ, ধার, দেনা এবং করদ বা করয’ অর্থ ঋণ, ধার বা করয; আর হাসানা অর্থ উত্তম। উভয়ে মিলে ‘উত্তম ঋণ’। আর হাসানা অর্থ ভালো বা ইহসান।
মূলকথা হলো কর্জে হাসানা দুটি আরবি শব্দের সন্বয়য়ে গঠিত। কর্জ শব্দটি কিরাদ শব্দমূলক থেকে উদ্ভব হয়েছে। যার অর্থ কর্তন। এটাকে এজন্য কর্জ বলা হয় যে এর মাধ্যমে সচ্ছল লোকদের আয় থেকে একটি অংশ ঋণ হিসেবে প্রেরিত যা আপাতদৃষ্টিতে সম্পদ কর্তিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। হাসানা শব্দটি ইহসান শব্দমূল থেকে উদ্ভব হয়েছে। ইহসান অর্থ অন্যের প্রতি দয়া। হাসান এমন একটি যা অন্য লোকের উপকারে আসে এবং কাজটি সম্পাদনে কর্তা বাধ্য নয়। দয়াকে ইসলাম উৎসাহিত করে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
অর্থ : “এবং আল্লাহ যা তোমাকে দিয়েছেন, তার দ্বারা পরলোকের কল্যাণ অনুসন্ধান করো। ইহলোকে তোমার বৈধ সম্ভোগকে উপেক্ষা করো না। আল্লাহ তোমার প্রতি যেমন সদাশয় হয়েছেন তুমি তেমনি (মানুষের প্রতি) সদাশয় হও এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করতে চেয়ো না; কারণ নিঃসন্দেহে আল্লাহ অশান্তি সৃষ্টিকারীকে ভালোবাসেন না।” (২৮:৭৭)

* পারিভাষিক অর্থ
কর্জে হাসানা এর সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে প্রদান করা হয়েছে। নিম্নোক্ত সংজ্ঞাগুলো আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
* মাল-পণ্য অপরকে প্রদান করা, যেন তার মাধ্যমে সে উপকৃত হয়, অতঃপর দাতাকে সেই মাল কিংবা তার অনুরূপ ফেরত দেওয়া। এতে কোনো অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করে না।
* আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের আশায়, সওয়াবের নিয়তে বিনা শর্তে কাউকে কোনো কিছু ঋণ দিলে তাকে ‘কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ বলে।
একটি ভালো ঋণ যা আর্থিক সুবিধা ছাড়া কোনো কারকে প্রদান করা হয়।
ঋণগ্রহীতার শিষ্টাচার
আমরা জানি যে, শিষ্টাচার মূলত নিহিত আছে এক সঙ্গে কাজ করার মনোভাব ও ব্যহারকারীর সাধারণ বিবেচনাবোধে। অন্য ব্যবহারকারীর প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণ করুন, নমনীয় হোন এবং আপনার কাজের প্রতি মনোযোগী হোন। এখানে ঋণগ্রহীতার শিষ্টাচার বলতে বুঝানো হয়েছে যে, তিনি কিভাবে এই ঋণ পরিশোধ করবেন এবং তার আচরণ কী হবে। এ ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা নিম্নোক্ত।
১) সময়মত পরিশোধ করা
রাসূলুল্লাহ্ [সা.] ইরশাদ করেন,
অর্থ : তোমাদের মধ্যে উত্তম লোক সেই, যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করে।

২) ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার সঙ্গে লাভ নেওয়ার শর্ত না দেওয়া।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
অর্থ : ‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান কর, তবে তিনি তোমাদের জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী ও ধৈর্যশীল। [সূরা- তাগাবুন, আয়াত- ১৭]
৩) ইসলামী সমাজে বেশি দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ও নয়।
যদি শর্ত দেওয়া হয় কিংবা এটা সমাজে প্রচলিত থাকে, তাহলে বেশি নেওয়া সুদ হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন
রাসূল [সা.] ইরশাদ করেন, সুদ গ্রহণকারী, প্রদানকারী ও সুদের দু’সাক্ষীর প্রতি অভিশাপ করেছেন। রাসূল (সা.) বলেন, অভিশাপে তারা সবাই সমান।

৪) ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে বিলম্ব না করা।
ঋণদাতা যখন মানুষের উপকার্থে ঋণ প্রদান করে, তখন ঋণগ্রহীতার দ্বীনী ও নৈতিক দায়িত্ব হবে তা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া। যদি এইরকম না করে টালবাহানা শুরু করে, মিথ্যা ওজর পেশ করতে লাগে, তাহলেই আপসে মিল-মহব্বত ও ভ্রাতৃত্ব নষ্ট হয়, শত্রুতা বৃদ্ধি পায় এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
“উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কি হতে পারে?” [সূরা আর রাহমান- ৬০]
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, হকদারদের হক তাদের নিকট পৌঁছে দিতে।” [ সূরা নিসা- ৫৮]
রাসূলুল্লাহ [সা.] ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমতাবস্থায় যে, সে তিনটি স্বভাব থেকে মুক্ত ছিল, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে- অহংকার, গনীমতের সম্পদ হতে চুরি এবং ঋণ।” [ইবনু মাজাহ, আলবানী (রহ.)]

৫) ঋণ পরিশোধের পূর্বে মৃত্যুবরণ না করার দুআ করা।
রাসূলুল্লাহ [সা.] ইরশাদ করেন, আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত-
তিনি বলেন, নাবী (সা.) বলেছেন : তোমাদের কেউ দুঃখ কষ্টে পতিত হওবার কারণে যেন মৃত্যু কামনা না করে। যদি কিছু করতেই চায়, তা হলে সে যেন বলে : হে আল্লাহ! আমাকে জীবিত রাখ, যতদিন আমার জন্য বেঁচে থাকা কল্যাণকর হয় এবং আমাকে মৃত্যু দাও, যখন আমার জন্য মরে যাওয়া কল্যাণকর হয়। [৫৭২]
ঋণ মানুষের হক-পাওনা, তা পূরণের পূর্বে মৃত্যুবরণ করা মানে মানুষের হক নিজ স্কন্ধে থেকে যাওয়া, যা বড় অপরাধ। সেই কারণে এই প্রকার ব্যক্তির জানাযার নামাজ রাসূল [সা.] নিজে পড়েননি। ইমাম তিরমিযী হাসান-সহীহ সনদে আবু ক্বাতাদাহ (রা.) হতে বর্ণিত করেন, নবী (সা.) এর কাছে একদা এক ব্যক্তির জানাযা নিয়ে আসা হলে, তিনি (সা.) বলেন- “তোমরা তোমাদের সাথীর জানাযা পড়; কারণ সে ঋণী।’’ [তিরমিযী, অধ্যায়ঃ জানাযা, নং- ১০৬৯]

৬) অভাবী ঋণীকে অবকাশ দেওয়া।
যারা সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ঋণ শোধ করতে টালবাহানা করে, তেমন সত্যিকারে এমন লোকও রয়েছে যারা নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম নয়। এই রকম ব্যক্তিকে ইসলাম অতিরিক্ত সময় দিতে ঋণের সমর্থন করে।
রাসূলুল্লাহ [সা.] একদা এক উষ্ট্রী ধার নেন এবং ফেরত দেওয়ার সময় সেই সমগুণের উষ্ট্রী না পাওয়ায় তার থেকে উত্তম গুণের পুরুষ উট ফেরত দেন এবং বলেন- “তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি সে, যে উত্তম ঋণ পরিশোধকারী।’’ [বুখারী, অধ্যায়, ইস্তিকরায, নং- ২৩৯০]

৭) ঋণ লেনদেনে মেয়াদ নির্ধারণ করা।
ঋণদাতা এবং ঋণগ্রহীতা লেনদেনের সময় একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ নির্ধারণ করবে। প্রয়োজনে হলে মেয়াদ বৃদ্ধিও করতে পারে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন
“হে বিশ্বাসীগণ! যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধারে কারবার করবে, তখন তা লিখে রাখবে। এবং তোমাদের মধ্যে কোনো লেখক যেন ন্যায়ভাবে তা লিখে দেয়, যেহেতু আল্লাহ তাকে শিক্ষা দিয়েছেন” [সূরা বাকারাহ -২৮২]
কর্জে হাসানা [ঋণ] প্রদানের ফজিলত :
এর দ্বারা বুঝায় শ্রেষ্ঠত্ব বা ভালো গুণাবলি এবং নৈতিক শক্তি। এখানে কর্জে হাসানা শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ [সা.] ইরশাদ করেন,
আমি যখন মিরাজে গিয়েছিলাম, তখন বেহেশতের দরজার ওপর লেখা দেখেছি, খয়রাতের সওয়াব ১০ গুণ, আর কর্জে হাসানার সওয়াব ১৮ গুণ। দান বা খয়রাত ফেরত দিতে হয় না কিন্তু কর্জে হাসানা ফেরত দিতে হয়। কর্জে হাসানা ফেরত দেওয়ার পরেও প্রায় দ্বিগুণ সওয়াব পাওয়ার কারণ আছে।
মূলত আল্লাহ তাআলা প্রতিটি মানুষকে স্বাবলম্বী করার জন্য ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ [সা.] ইরশাদ করেন, হে মুসলমানরা, তালির ওপর তালিযুদ্ধ ছিন্নবস্ত্র পরিধান করা, ঋণ গ্রহণ অপেক্ষা উত্তম। যদি তা শোধ করার শক্তি না থাকে। (মুসনাদ আহমাদ)
ঋণগ্রহীতার সর্বদাই মনে রাখতে হবে আল্লাহ তাআলা বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য এ পদ্ধতি প্রদান করেছেন। এ কর্জে হাসানা নিয়ে বিলাসিতা করার জন্য নয়। ঋণ প্রদান একটি সাওযাবের কাজ, যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে। এর মাধ্যমে লোকের সাহায্য করা হয়, তাদের প্রতি দয়া করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা হ্রাস করা হয় কিংবা সমাধান করা হয়।
রাসূলুল্লাহ [সা.] ইরশাদ করেন,
অর্থ : ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দুনিয়াবী বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তাআলা তার আখেরাতের বিপদ দূর করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অভাবির কষ্ট সহজ করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতে সহজ করবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্য করেন যতক্ষণে বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করে।” (সহীহ্ মুসলিম)
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
“আল্লাহ সুদের আয়কে ধ্বংস করেন এবং দানকে বাড়িয়ে দেন, আল্লাহ অবিশ্বাসী বা অকৃতজ্ঞ পাপীদের ভালোবাসেন না।” (২:২৭৬) কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা জুুলুম করবে না এবং তোমাদের জুলুম করা হবে না।
রাসূলুল্লাহ [সা.] ইরশাদ করেন,
“যে কেউ কোনো মুসলিমকে দুইবার ঋণ দেয়, তা সেই অনুযায়ী একবার সাদকাহ করার মতো।’” [ইবনু মাজাহ, সূত্র হাসান, ইরওয়াউল গালীল নং ১৩৮৯]
অতঃপর মেয়াদ নির্ধারিত থাকলে ঋণদাতা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে ঋণ ফেরত নেওয়ার দাবি করতে পারে না। বরং সে নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বাধ্য। কারণ নবী (সা.) বলেন- কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ শুধুমাত্র নিরুপায় হয়ে গ্রহণ করা উচিত।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
“(হে নবী!) আপনি বলে দিন যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, তার মধ্যে আমি কোনো হারাম বা নিষিদ্ধ খাদ্য পাইনি, কিন্তু মৃত পশু বা জন্তু অথবা শরীর থেকে বেরিয়ে পড়া রক্ত অথবা শুকরের মাংস যা অপবিত্র বা অবৈধ; এ ছাড়াও যবেহ করা জন্তু যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়। অতঃপর যে নিরুপায় হয়ে (বা ক্ষুধায় কাতর হয়ে) নাফরমানি করার ও উপভোগের উদ্দেশ্য ছাড়াই এ ধরনের খাবার খেতে বাধ্য হয় এবং সীমা লঙ্ঘন করে না, (তার জন্য তা পাপ হবে না) নিশ্চয়ই আপনার পালনকর্তা ক্ষমাশীল দয়ালু।” (৬:১৪৫)
*২) কর্জে হাসানা নিয়ে অঙ্গীকার রক্ষা করতে হবে। তা না হলে গুনাহ হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
অর্থ : আল্লাহ বনী ইসরাঈলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এবং আমি তাদের মধ্য থেকে বার জন সর্দার নিযুক্ত করেছিলাম। আল্লাহ বলে দিলেন- আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। যদি তোমরা নামায প্রতিষ্ঠিত কর, জাকাত দিতে থাক, আমার পয়গম্বরদের প্রতি বিশ্বাস রাখ, তাঁদের সাহায্য কর এবং আল্লাহকে উত্তম পন্থায় ঋণ দিতে থাক, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের গুনাহ দূর করে দেব এবং অবশ্যই তোমাদেরকে উদ্যান সমূহে প্রবিষ্ট করব, যেগুলোর তলদেশ দিয়ে নিঝরিনীসমূহ প্রবাহিত হয়। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি এরপরও কাফের হয়, সে নিশ্চিতই সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। [ সূরা মায়েদা- ৫:১২ ]
৩) যে উত্তম ঋণ দেবে, তাহলে তিনি বহুগুণে ইহাকে বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্য আছে সম্মানজনক পুরস্কার।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
অর্থ : এমন কে আছে যে, আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবে? তাহলে তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্যে রয়েছে সম্মানজনক প্রতিফল। [সূরা-হাদিদ, আয়াত-১১।]
৪) উত্তম প্রতিদান প্রাপ্তি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
নিশ্চয়ই দানশীল ব্যক্তি ও দানশীলা নারী, যারা আল্লাহকে উত্তমরূপে ঋণ দেয়, তাদেরকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে, আর তাদের জন্যে রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার। [সূরা- হাদিদ, আয়াত -১৮।]
‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান কর, তবে তিনি তোমাদের জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী ও ধৈর্যশীল। [সূরা- তাগাবুন, আয়াত ১৭।]
৫) সৎ আমলের অন্তর্ভুক্তি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
অর্থ : তা তোমরা পাবে আল্লাহর কাছে উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার হিসেবে মহোত্তম। আর তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর আল্লাহর কাছে; নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [মুযাম্মিল, আয়াত-২০।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে মুসলমানরা ঋণ গ্রহণ থেকে বেঁচে থাক। কেননা, ঋণ রাত্রীকালে মর্ম বেদনা ও দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে এবং দিনের বেলায় অপমান ও লাঞ্ছনায় লিপ্ত করে। (বায়হাকি)
অনেকে আছেন ব্যাংক থেকে বিরাট অঙ্কের ঋণ নিয়ে বেমালুম হজম করেন। তাদের পরিচয় ঋণখেলাপি। অথচ অনেকে শখের বশে ব্যবসায়ের খাতে ঋণ নিয়ে উধাও হয়ে যায়। তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা।
রাসূলুল্লাহ [সা.] ইরশাদ করেন, সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, যদি কোনো ব্যক্তি জিহাদে শহীদ হয়ে যায়, জীবিত হয়ে (পুনরায়) শহীদ হয়ে যায় আবার জীবিত হয়ে (তৃতীয়বার) শহীদ হয়ে যায়, তার জিম্মায় কারও ঋণ প্রাপ্য থাকলে সে জান্নাতে যাবে না, যে পর্যন্ত তার ঋণ শোধ করা না হয়। (নাসায়ি, তিবরানি, হাকেম)
আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী [সা.] এর জিম্মায় একজন লোকের এক নির্দিষ্ট বয়সের উট ঋণ ছিল। লোকটি তাঁর নিকট সেটির তাগাদা করতে আসল। তিনি সাহাবীদের বললেন, তাকে একটি উট দিয়ে দাও। তাঁরা সে বয়সের উট তালাশ করলেন। কিন্তু তার চাইতে বেশি বয়সের উট ছাড়া পাওয়া গেল না। তিনি বললেন, সেটি তাকে দিয়ে দাও। লোকটি বলল, আপনি আমাকে পূর্ণ হক দিয়েছেন, আল্লাহ আপনার পূর্ণ বদলা দিন।
ঋণ থেকে বাঁচার জন্য করণীয় :
মানুষ মাত্রই প্রয়োজনের শেষ নেই। সেই প্রয়োজনেরও রয়েছে বিভিন্ন স্তর এবং পূরণেরও নানা পথ। ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাস্তবিকই প্রয়োজন আছে কিনা, থাকলে সেটা কোন পর্যায়ের, ঋণগ্রহণ ছাড়া অন্যভাবে পূরণ সম্ভব কিনা এবং ঋণ গ্রহণ করলে সময়মত পরিশোধ করা যাবে কিনা- এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা অতি জরুরি।
ঋণ মানুষের ওপর একটা বড় বোঝা। ঋণগ্রস্ততা অধিকাংশ সময় দুশ্চিন্তা, অশান্তি ও অনৈতিকতার কারণ হয়। এজন্য বান্দার কর্তব্য, আল্লাহ তাআলার কাছে ঋণ থেকে আশ্রয় চাওয়া এবং দুআ করা, তিনি যেন ঋণ ছাড়াই সব প্রয়োজন পূরণ করে দেন। রাসূলুল্লাহ [সা.] আল্লাহর কাছে ঋণ থেকে আশ্রয় চাইতেন। এ প্রসঙ্গে দুটি হাদীস উল্লেখ করা যায়।
১. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ [সা.] নামাযে এ দুআ করতেন-
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় চাই। মাছীহ দাজ্জালের ফেতনা থেকে আশ্রয় চাই। জীবনের ফেতনা ও মৃত্যুর ফেতনা থেকে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে গোনাহ ও ঋণ থেকে আশ্রয় চাই।
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ [সা.] এ দুআ করতেন-
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দুঃখ-দুশ্চিন্তা থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, ভীরুতা ও কার্পণ্য থেকে, ঋণের বোঝা ও মানুষের প্রাবল্য (এর শিকার হওয়া) থেকে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩৬৯
২). ঋণ থেকে দূরে থাকতে দৃঢ় সংকল্প করা।
বিশেষ প্রয়োজন এবং নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধের প্রবল ধারণা ছাড়া ঋণ না নেওয়ার। মানুষ প্রতিদিন তার সমস্যার সমাধান করতে পারে।
৩) সার্বক্ষণিক আয় ও ব্যয়ের মাঝে সমন্বয় করে চলা।
৪) প্রদর্শনী থেকে দূরে থাকতে হবে।
যেমন- নামডাক, কৃত্রিমতা ও রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা।
৫) বরকত বিনষ্টকারী কর্ম থেকে বেঁচে থাকা।
যেসব কাজ জানমালে বরকতের পক্ষে সহায়ক তা গুরুত্বের সঙ্গে করা। আর যেগুলো বরকত বিনষ্টকারী তা থেকে সযত্নে বেঁচে থাকা। একই সঙ্গে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআও করা। আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য, ঋণ থেকে বাঁচার ক্ষেত্রেও পরস্পরকে সাহায্য করা। পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে কাউকে ঋণগ্রহণের দিকে ঠেলে না দেওয়া। কাউকে এ কাজে উৎসাহ না দেওয়া।
উপসংহার :
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, কর্জে হাসানা’ নামটি অতি সুন্দর এবং সৎ আমল। আমরা সকলেই এ আমলটির সঙ্গে পরিচিত। যিনি নামাজ পড়েন, জাকাত দেন, কর্জে হাসানা দেন এবং আল্লাহ পাকের কাছে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চান- তাহলে তাকে আল্লাহ কর্জে হাসানার সওয়াব বহুগুণে দেবেন, সম্মানজনক পুরস্কার দেবেন এবং ক্ষমা করে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার পাদদেশে নহর প্রবাহিত।
কর্জ হাসানা সম্পর্কে হাদীসে আরও বর্ণিত আছে যে, কর্জে হাসানাকে সাদকাহ হিসেবে সওয়াব বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। এ আমলের যথাযথ প্রায়োগিক ব্যাবস্থাপনা না থাকায় ‘আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কর্জে হাসানার ভূমিকা’ উপলব্ধ হচ্ছে না। যদি এর যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়, তাহলে উন্নত সমাজ গঠনে তা অত্যন্ত কার্যকরী হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে পরিপূর্ণভাবে কর্জে হাসানা সম্পর্কে জেনে এর ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন, আমীন!

লেখক : প্রফেসর সৈয়দ ড. মাকসুদুর রহমান
চেয়ারম্যান, আল-হাদীস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

 
Electronic Paper