ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পুরনো সব ভুল ক্ষমা করে দাও হে প্রভু

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী
🕐 ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৬, ২০২৩

পুরনো সব ভুল ক্ষমা করে দাও হে প্রভু

দেখতে দেখতে জীবনের ক্যালেন্ডার থেকে আরেকটি বছর হারিয়ে গেল। পা রাখলাম নতুন বছরে। বিদায়ী বছর কারও জন্য ছিল সুখের, কারও দুঃখের। কেউ গেল বছরে উঠে দাঁড়িয়েছে, কেউবা ভেঙে পড়েছে। স্বজনদের থেকে কেউ ব্যথা পেয়েছে, কেউবা পুরনো ব্যথা ভুলে নতুন করে সম্পর্ক জোড়া দিয়েছে। কেউ জীবন সংসার ত্যাগ করে ইহলোকে পাড়ি জমিয়েছে, কেউবা সংসার জীবনে প্রবেশ করে আগামী দিনের স্বপ্ন বুনছে। কারও কোলজুড়ে চাঁদের মতো নতুন অতিথি এসেছে। কারও বারান্দায় খাটিয়া এসে প্রিয়জনকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে। এভাবেই বছর কাটে। কাটে জীবন। ব্যথা জাগে। ব্যথা ভরা মনে আবার আনন্দের ফুল ফোটে।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক বর্ষশেষ সন্ধ্যায় পুরনো বছরের সূর্য পশ্চিমাকাশে নিঃশব্দে অস্ত যেতে দেখে বললেন, সূর্য নয় যেন কাটিয়ে দেওয়া আমার জীবনের দিনগুলোর নিঃশব্দ বিদায়যাত্রা অনুভব করছি। বিদায় মাত্রই বেদনা। তবে আবশ্যিক বিদায়কে বেদনা নয় শক্তিতে রূপান্তর করাই জ্ঞানী মানুষের পরিচয়। রবীন্দ্রনাথ এখানে জ্ঞানীর পরিচয় দিয়েছেন।

তিনি প্রার্থনার সুরে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন- ‘হে চিরদিনের চিরন্তন! অতীত জীবনকে এই যে আজ বিদায় দিতেছি, এই বিদায়কে তুমি সার্থক করো; আশ্বাস দাও যে, যাহা নষ্ট হইল বলিয়া শোক করিতেছি, তাহার সকলই যথাকালে তোমার মধ্যে সফল হইতেছে। আজি যে প্রশান্ত বিঘাদ সমস্ত সন্ধ্যাকাশকে আচ্ছন্ন করিয়া আমাদের হৃদয়কে আবৃত করিতেছে, তাহা সুন্দর হউক, মধুময় হউক, তাহার মধ্যে অবসাদের ছায়ামাত্র না পড়ুক।’

যা নষ্ট হয়েছে বলে শোকের সাগরে বুক ভাসাচ্ছি, তা আসলে নষ্ট হয়নি- চিরদিনের চিরন্তন মহান প্রভু আল্লাহতায়ালা আমাদের সে আশ্বাস দিয়েছেন। শুধু কি আশ্বাস! তাতে বিশ্বাস রাখাই ইমান। যা ঘটেছে তা তকদিরে লেখা ছিল বলেই ঘটেছে।

যে ক্ষতি আমার হয়েছে, বিশ্ব পরিচালনার স্বাভাবিক গতিতেই তা হয়েছে। আমি যত চেষ্টাই করতাম সে ক্ষতি ঠেকাতে পারতাম না। রসুল (সা.) যখন সাহাবিদের নিয়ে জিহাদে যেতেন তখন মদিনার মুনাফিকরা বারবার তাদের সতর্ক করে বলত, খবরদার! তোমরা অনর্থক মারামারিতে নিজেদের জড়িও না। তোমরা কিন্তু জীবন বিপন্ন করতে যাচ্ছ। তোমাদের পরিবার আছে। ব্যবসা আছে। এভাবে বিভিন্ন কথা বলে জিহাদ থেকে সাহাবিদের মন ফেরানোর ধান্দা করত।

সাহাবিরা যখন জিহাদে গিয়ে শহীদ হতেন বা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন তখন মুনাফিকরা খোঁচা দিয়ে বলত, কী ব্যাপার! বলেছিলাম না যাওয়ার দরকার নেই। খামোখা পা হারালে। হাত কাটা পড়ল। এখন চলবে কীভাবে? শুনেছি তোমার ভাই নাকি মারা গেছে! ছেলে বন্দি হয়েছে। আমাদের কথা শুনলে আজ ভাই আর ছেলেকে হারাতে হতো না। মুনাফিকদের এ ধরনের তির্যক মন্তব্যের বিপরীতে আল্লাহ আয়াত নাজিল করে দিলেন।

আল্লাহ মুমিনদের এমন একটি কথা শিখিয়ে দিলেন যাতে করে মুনাফিকদের মুখে কুলুপ এঁটে যায়। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! বলো, ‘আল্লাহ যা নির্ধারিত করেছেন, এর বাইরে কিছুই আমাদের জীবনে ঘটবে না।’ তিনিই আমাদের প্রভু, সর্বকর্ম বিধায়ক। আর বিশ্বাসীদের তো শুধু আল্লাহর ওপরই ভরসা করা উচিত’ (সুরা তাওবা-৫১)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা চাইলেও কিছু করতে পারবে না, যদি আল্লাহর ইচ্ছা না হয়’ (সুরা তাকভির-২৯)।

প্রকৃতির নিয়মই এমন যে, পুরনো যায় নতুনকে জায়গা করে দিতে। নতুন মানেই আনন্দ। নতুন মানেই সামনে এগিয়ে যাওয়া। রাতের অন্ধকার যেমন নতুন দিনের আলো নিয়ে আসে, তেমনি নতুন বছরও পুরনোর ব্যর্থতা ও গ্লানি মুক্তির বাণী নিয়ে হাজির হয়। পুরনো না গেলে নতুন আসতে পারে না। শূন্য অতীত গেলেই আগামীর পূর্ণতার দুয়ার খুললে যায়। তাই বিগত বছর চলে যাওয়ার যে বেদনা তা আসলে নতুন সম্ভাবনা প্রসবের ব্যথা।

শুধু পুরনো দিন বা বছরই নয় যে কোনো বিদায় যন্ত্রণাই নতুনের জন্ম ব্যথা। তাই নতুন বছরে আমরা খোদার কাছে মোনাজাত করি! হে আমাদের পরম প্রেমময় প্রভু! তিল তিল করে যে ভুল-ক্লেদ আর অবহেলার ধুলো আমরা জমিয়েছি, তা একটু একটু করে সরিয়ে দাও আমাদের জীবন থেকে। আমিন।

 
Electronic Paper