ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গাইবান্ধায় ব্যবসায়ী ‘হত্যা’র নেপথ্যে

গাইবান্ধা প্রতিনিধি
🕐 ৯:১৩ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১২, ২০২১

গাইবান্ধায় ব্যবসায়ী ‘হত্যা’র নেপথ্যে

গাইবান্ধায় গত শনিবার এক ব্যবসায়ীর লাশ পাওয়া যায় আওয়ামী লীগ নেতার ঘরে। ওই ব্যক্তির নাম হাসান আলী (৪৫)। মাস খানেক আগে পুলিশের বিরুদ্ধে হাসান আলীকে আওয়ামী লীগ নেতা দাদন ব্যবসায়ী মাসুদ রানার হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগে উঠেছে। এ ঘটনায় তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে পুলিশ। বিষয়টি নিয়ে গতকাল রোববার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন গাইবান্ধার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।

এর আগে শনিবার দুপুরে শহরের খানকা শরিফসংলগ্ন নারায়ণপুর এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের উপদফতর সম্পাদক দাদন ব্যবসায়ী মাসুদের বাসা থেকে হাসানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এদিকে হাসানকে হত্যার অভিযোগে তার স্ত্রী বীথি বেগম শনিবার রাত ১১টার দিকে গাইবান্ধা সদর থানায় লিখিত এজাহার দেন। এজাহারে আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করা হয়। অপর দুজন হচ্ছেনÑশহরের স্টেশন রোডের জুতা ব্যবসায়ী রুমেল হক ও খলিলুর রহমান ওরফে বাবু মিয়া। কিন্তু অভিযোগ দায়েরের ১৮ ঘণ্টা পরও গতকাল রোববার বিকাল পর্যন্ত মামলা নেয়নি পুলিশ।

বিচারের দাবিতে মানববন্ধন
ব্যবসায়ী হাসানকে টানা এক মাস আটকে রেখে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন হয়েছে। গতকাল রোববার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত জেলা শহরের ডিবি রোডে আসাদুজ্জামান মার্কেটের সামনে গাইবান্ধাবাসীর ব্যানারে মানববন্ধন হয়। বক্তারা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত, দাদন ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদের শাস্তি এবং সদর থানার ওসি মাহফুজার, পরিদর্শক মজিবুর, এসআই মোশারফহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানান। মানববন্ধনে বীথি অভিযোগ করে বলেন, ‘শনিবার রাতে থানায় এজাহার দিতে গেলে পরিদর্শক মজিবুর এজাহারের বর্ণনা থেকে তার নাম বাদ দিতে বলেন।’
লিখিত এজাহারে যা লেখা

বীথি বেগম মামলার বিবরণে উল্লেখ করেন, ‘জেলা শহরের স্টেশন রোডে আমার স্বামীর আফজাল সুজ নামের জুতার দোকান রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ রানা (৪২) একজন দাদন ব্যবসায়ী। ব্যবসা চলার সময় মাসুদ রানার কাছে দেড় লাখ টাকা দাদন নেন আমার স্বামী। এ টাকা সুদা-আসলে বর্তমানে ১৯ লাখে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি করেন মাসুদ রানা। সম্প্রতি মাসুদ সুদের টাকার জন্য আমার স্বামী হাসান আলীকে চাপ দেন। একপর্যায়ে গত ৫ মার্চ সকালে লালমনিরহাটের একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে আমার স্বামীকে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে আসেন মাসুদ।

তিনি তাকে গাইবান্ধা শহরের খানকা শরিফসংলগ্ন নারায়ণপুর এলাকায় নিজ বাসায় আটকে রাখেন। এরপর টাকা নিয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে মাসুদের তর্কবিতর্ক হয়। টাকার জন্য তিনি আমার স্বামীকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন এবং নানা ধরনের হুমকি দেন। এসব নির্যাতনের কথা মুঠোফোনে জানতে পেরে আমি স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় স্বামীকে উদ্ধারের চেষ্টা করি। স্বামীকে উদ্ধারের জন্য ওই বাড়িতে যাই। কিন্তু টাকা না দিলে মাসুদ আমার স্বামীকে ছেড়ে না দিয়ে বড় ধরনের ক্ষতি করবে বলে হুমকি এবং আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন।’ ওই দিন সন্ধ্যায় বীথি স্বামীকে উদ্ধারে গাইবান্ধা সদর থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। বীথি বলেন, ‘পরে সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মজিবুর রহমান ও উপপরিদর্শক (এসআই) মোশারফ হোসেন এবং একজন অজ্ঞাতনামা পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদের বাড়ি থেকে আমার স্বামীকে সদর থানায় নিয়ে আসেন। একই দিন রাতে আমাদের উপস্থিতিতে পরিদর্শক (তদন্ত) মজিবুর আমার স্বামীকে আমার জিম্মায় না দিয়ে মাসুদের পক্ষ নেন।

তিনি মাসুদের টাকা ফেরত দিতে বলেন এবং আমাকে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে বলেন। আমি তাতে সম্মত না হলে মজিবুর আমার স্বামীকে মাসুদের জিম্মায় দেন। এরপর দলীয় ক্ষমতার দাপটে মাসুদ আমার স্বামীকে এক মাস আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। আমি অনেকভাবে চেষ্টা করেও আমার স্বামীকে উদ্ধারে ব্যর্থ হই। শুক্রবার রাতে আমার স্বামীকে নির্যাতন করে হত্যা করে বসতবাড়ির বাথরুমে ঝুলিয়ে রাখা হয়। শনিবার সকালে আমি মাসুদের বাড়িতে গিয়ে দেখি, আমার স্বামীর লাশ ঝুলে আছে। মাসুদ ও তার সহযোগিরা পরিকল্পিতভাবে আমার স্বামীকে হত্যা করেছেন।’

মাসুদের হাতে হাসানকে তুলে দেওয়া প্রসঙ্গে পরিদর্শক মজিবুর বলেন, ‘ওসি সাহেবের নির্দেশে এসআই মোশারফ বাড়ি থেকে মাসুদ ও হাসানকে থানায় নিয়ে আসেন। পরে তারা সালিস দরবার করেন। হাসানকে মাসুদের হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’

সদর থানার ওসি মাহফুজার রহমান বলেন, ‘পুলিশ মাসুদের হাতে হাসানকে তুলে দেয়নি। থানা চত্বরে সালিস বৈঠকের পর হাসান, তার স্ত্রী বীথি, মাসুদসহ উভয়পক্ষের লোকজন একসঙ্গে হেঁটে থানা থেকে বেরিয়ে যান। এরপর তারা কী করেছেন, পুলিশ তা জানে না।

যা বললেন পুলিশ সুপার
ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘হাসানকে দাদন ব্যবসায়ী মাসুদের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনায় সদর থানার কোনো কর্মকর্তা জড়িত বা তাদের গাফলতি আছে কি না, তা তদন্তে শনিবার ঘটনার দিনই কমিটি করা হয়েছে। তদন্তে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ মামলা গ্রহণে বিলম্ব করার কারণ জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমাদের কাছে যে কেউ অভিযোগ দিতে পারে, তা আমরা যাচাই-বাছাইরে পর গ্রহণ করে থাকি। হাসানের স্ত্রী যে এজাহার দিয়েছেন, তা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’ এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, এজাহার থেকে নাম বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই।

আওয়ামী লীগ নেতাকে বহিষ্কার
জেলা আওয়ামী লীগের উপদফতর সম্পাদক মাসুদকে কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়ছে। গতকাল দুপুরে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে তাকে বহিষ্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পিয়ারুল ইসলাম, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুজ্জামান, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক আবদুল লতিফ প্রমুখ।

এর আগে শনিবার দুপুরে শহরের খানকা শরিফসংলগ্ন নারায়ণপুর এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদের বাসা থেকে হাসানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে পুলিশ ময়নাতদন্তের জন্য তার লাশ গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।

মাসুদ আটক থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তার স্ত্রী রেহেনা পারভীন তাদের বাসায় হাসানের দীর্ঘ সময় থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে কীভাবে হাসান আলী মারা গেলেন, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

 
Electronic Paper