ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দিনাজপুরে ছাদহীন স্থাপত্য

মেহেদী হাসান উজ্জ্বল, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর
🕐 ১১:২০ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ০৮, ২০২১

দিনাজপুরে ছাদহীন স্থাপত্য

বৃহত্তর দিনাজপুরকে বলা হয় প্রত্নসম্পদের রত্নভাণ্ডার। এর দক্ষিণাঞ্চল পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, হাকিমপুর ও ঘোড়াঘাট আরও সমৃদ্ধ। এই জনপদের বিস্তৃীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন কীর্তির নমুনা।

এই প্রত্নসম্পদের খোঁজে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সংলগ্ন, ফুলবাড়ী দুধিপুর সড়কের পশ্চিম পার্শ্বে ধাপের বাজার ভিটায় প্রায় এক মাস ধরে চলছে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ। গত ৫ মার্চ থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ও রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের যৌথ অর্থায়নে এই খনন কাজ শুরু করা হয়।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের বগুড়া মহাস্থান গড়ের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক সোহাগ আলীর নেতৃত্বে একই বিভাগের শিক্ষক জেসমিন নাহার ঝুমুর ও শিক্ষার্থী মেহনাজ চৌধুরী টুম্পা (মাস্টার্স), বহ্নি রায় (২য় বর্ষ), ইসমাইল হোসেন (৩য় বর্ষ), সাজ্জাদুল হোসেন (১ম বর্ষ), রুপন ইসমাইল শৌখিন, অপূর্ব কৃষ্ণ রায় (৪র্থ বর্ষ) সাখাওয়াত হোসেন অনিক (মাস্টার্স), নাদিয়া শিউলী (৩য় বর্ষ) খননে সক্রিয় রয়েছেন। আরো রয়েছেন মহাস্থান জাদুঘরের খননে অভিজ্ঞ মোত্তালেব হোসেন, ঠান্ডু মিয়া, আজিজুর রহমানসহ একদল শ্রমিক। ইতিমধ্যে ছাদবিহীন এ প্রাচীন স্থাপত্যের প্রায় ৬০ ভাগ অবকাঠামো উন্মোচিত হয়েছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে এর ছাদ বহু আগে ধসেগেছে।

ইটের দেয়াল, যার প্রস্থ ১২ ইঞ্চি, গাঁথুনি কাদামাটি দিয়ে। খননে ভিতের সন্ধান পাওয়া গেছে ১৪ ফুট নিচে। দেয়ালের গাঁথুনির ইটগুলোর রং এতকাল পরও অক্ষত। গাঁথুনিতে ১২ ইঞ্চি লম্বা ও ১১ ইঞ্চি চওড়া ছাড়াও ৫/৬, ৫/৪, ৮/৪ ইঞ্চি সাইজের ইট পাওয়া গেছে।

কাদামাটি দিয়ে দেয়ালের গাঁথুনি দেখে ধারণা করা যাচ্ছে, যে যুগে এ অবকাঠামো নির্মিত হয়েছিল, তখন ইটভাঁটাতে ইট নির্মাণের প্রচলন ছিল না। ইট নির্মাণ কারিগররা কাঁচা ইট আগুনে পুড়ে পাকা করে ব্যবহার করত। এ পর্যায়ে হাঁড়িপাতিল ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ বের হচ্ছে, তবে এখন পর্যন্ত কাল নির্ণয়ক কোনো প্রত্নসামগ্রী অথবা পাঠলিপি পাওয়া যায়নি। চারদিক থেকে ক্রমান্বয়ে ঢালু হয়ে সমতল ভূমির সঙ্গে মিশে গেছে। ভিটা বা ঢিবির উত্তর দিকে যে ভিত উন্মোচিত হয়েছে, সেটি বাড়ির সিকিউরিটির প্রহরীদের জন্য কক্ষ কিনা তা অজানা।

প্রত্নতত্ত্বের এ সাইট পরিদর্শনকালে খননে দায়িত্বরত সোহাগ আলী বলেন, অবকাঠামোতে ব্যবহৃত ইট ও নির্মাণশৈলী দৃষ্টে ধারণা করা যায় স্থাপনাটি হাজার বছরের পুরনো তবে কাল নির্ণয়ক প্রত্নবস্তু না পাওয়া পর্যন্ত এর প্রাচীনত্বের ব্যাপারে আগাম ধারণা করা মুশকিল। তিনি আরও বলেন, অতি স্বল্প বাজেট বরাদ্দ নিয়ে খনন শুরু করা হয়েছে। যার ফলে আমরা খননে গভীরে যেতে পারছি না। পরিপূর্ণ খনন করা গেলে এখানে কোনো না কোনো মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী পাওয়া যাবে বলে তার ধারণা।

প্রত্নতত্ত্ববিদ আ কা মো যাকারিয়ার বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ পুস্তকে ফুলবাড়ী, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, হাকিমপুর ঘোড়াঘাট ও এই ধাপের ভিটায় ছোটবড় ১৫০টির মতো ঢিবি ও স্তূপের বিবরণ উল্লেখ রয়েছে। এগুলোতে সামান্য মাটি খুঁড়লে পুরনো ইট ও বিভিন্ন ধরনের প্রত্নবস্তু বেরিয়ে আসে। তবে ইট হরণকারীদের অত্যাচার ও মাটি কেটে সমান করে কৃষি কাজের উপযোগী করায় এখন ২৫টি ঢিবিরও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

এক্ষেত্রে ঝোপঝাড় ও জঙ্গলাকীর্ণ ও রাস্তার ধারে হওয়ায় ভূমিখেকোদের কবল থেকে রক্ষা পেয়ে এখনো অক্ষত ধাপের ভিটার ধ্বংসপ্রাপ্ত পুরাকীর্তিটি। এই বরেণ্য প্রতœতত্ত্ববিদ (আ কা মো যাকারিয়া) তার এই পুস্তকে আরও উল্লেখ করেছেন, এ ঢিবিগুলোতে যে বৌদ্ধস্তূপ ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাতে ধারণা করা যায় যে, এসব ছিল বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র। সঠিক সময় নির্ধারক কোনো প্রত্ন প্রমাণের অভাবে এই স্তূপগুলোর সঠিক বয়স নির্ণয় না করা গেলেও এগুলো যে নবাবগঞ্জের সীতাকোট বৌদ্ধবিহারের সমসাময়িক তা অনুমান করা যায়। এসব আমাদের লুপ্ত ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। এসব রক্ষা না করলে হারিয়ে যাবে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাস।

 
Electronic Paper