বিপন্ন পরিচ্ছন্নকর্মী শকুন
তানজেরুল ইসলাম ও এসএ স্বপন মৃধা, দিনাজপুর
🕐 ৮:৫০ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৮, ২০২০
পরিবেশ পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবেই পরিচিত তারা। আশির দশকেও কম ছিল না সংখ্যা। শুধু সার্কভুক্ত দেশেই ছিল চার কোটির বেশি। আর আমাদের দেশে ছিল ঝাঁকে ঝাঁকে। এই তো সেদিনের কথা, নব্বই দশক। তখনও দেশে শকুন সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। কালের বিবর্তনে বর্তমানে সেই সংখ্যা সার্কভুক্ত দেশ মিলিয়ে কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজারের কম। আর ২০১২ সালের হিসাব বলছে, বাংলাদেশে শকুন সংখ্যা মাত্র ৫৫০। আর আট বছরের ব্যবধানে তা আরও কমে দাঁড়িয়েছে ২৫০টির মতো। জানা যায়, গবাদি পশুর মাংস খেয়ে বেঁচে থাকা শকুন তীক্ষè দৃষ্টির শিকারি পাখি। আশির দশকে ভারতীয় উপমহাদেশে গবাদি পশুর চিকিৎসায় ছড়িয়ে পড়ে ‘ডাইক্লোফেনাক’ নামের ব্যথানাশক ওষুধ। অভিযোগ আছে, ডাইক্লোফেনাক প্রয়োগ হওয়া মৃত পশুর মাংস শকুনকে বিপন্ন করে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিনের গবেষক ড. লিন্ডসের গবেষণা মতে, ‘মাত্র শূন্য দশমিক ২২ মিলিগ্রাম ডাইক্লোফেনাক’ একটি শকুনের প্রাণ কেড়ে নিতে যথেষ্ট। ডাইক্লোফেনাক হজমের জন্য শকুনের শরীরে কোনো এনজাইম নেই। যে কারণে খাদ্যের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শকুন মারা যায়। এ ছাড়া চরম খাদ্য সংকট, বড় গাছের অভাবে বাসস্থান সংকট ও কৃষি কাজে অতিমাত্রায় সার এবং কীটনাশক প্রয়োগে শকুন আজ বিপন্ন।’
অনেকটা দেরিতে হলেও ২০১০ সালে দেশে গবাদি পশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করে সরকার। যদিও ততদিনে ‘বাংলা শকুন’ মহাবিপন্ন পাখির তালিকায় স্থান করে নেয়। বর্তমানে হিমালয় থেকে উড়ে আসা পরিযায়ী শকুন রক্ষায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বন বিভাগ ও আইইউসিএন।
প্রাণী চিকিৎসকদের মতে, গবাদি পশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ব্যবহার বন্ধ হলেও কিটোপ্রোফেন ব্যবহার বন্ধ হয়নি। কিটোপ্রোফেনের বিকল্প এবং শকুনের জন্য নিরাপদ মেলোক্সিক্যাম ব্যবহারে সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে তেমন প্রচার-প্রচারণা নেই। এ ছাড়া দেশে শকুনের জন্য নিরাপদ দুটি এলাকায় কিটোপ্রোফেন বন্ধ হলেও শত শত মাইল অতিক্রম করে খাদ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম শকুন। এ কারণে, শুধু শকুনের হটস্পটগুলোর দিকে নজর না দিয়ে সারাদেশই কিটোপ্রোফেন উৎপাদন ও বাজারজাত বন্ধ করা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের (আইইউসিএন) তথ্য মতে, এই দেশের আবাসিক শকুন ‘বাংলা শকুন’ নামে পরিচিত। এ ছাড়াও দেশে নানা কারণে আসে হিমালয়ী গৃধিনী প্রজাতির শকুন। সাধারণত শীতকালে এই প্রজাতির শকুন বেশি দেখা যায়। মূলত, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা, নেপালের সমতল ভূমি এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিমালয়ী শকুন চলে আসে। এই তিন দেশের মধ্য সবচেয়ে বেশি দেখা যায় দেশের উত্তরাঞ্চলে।
আইইউসিএন আরও জানায়, ২০১৪ সাল থেকে অসুস্থ ও আটকেপড়া শকুনগুলো উদ্ধার, চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনসহ বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে বন অধিদফতর এবং আইইউসিএন। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও রংপুর জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে শকুন উদ্ধার করা হয়। অসুস্থ ও আঘাতপ্রাপ্ত শকুনগুলো উদ্ধারের পর পরিচর্যার জন্য ২০১৬ সালে দিনাজপুর শিংড়ায় শকুন উদ্ধার এবং পরিচর্যা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে।
বন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে দুটি অঞ্চলকে শকুনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করে। সেখানে শকুনের প্রজনন স্থল, বিশ্রামস্থল ও বিচরণ এলাকায় রুস্টিং ট্রি সংরক্ষণ এবং শকুনের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। অসুস্থ কিংবা উড়তে অক্ষম এমন শকুনের চিকিৎসার পাশাপাশি পুনর্বাসনের জন্য গাজীপুর এবং দিনাজপুরে দুটি কেন্দ্র রয়েছে।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এএসএম জহির উদ্দিন আকন জানান, বিগত দিনে বগুড়া এবং কুমিল্লা থেকে অসুস্থ শকুন উদ্ধারের পর চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক এবং দিনাজপুরে পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় বন বিভাগকে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট বিভিন্ন সময় তথ্য দিলে তারা দ্রুত সময়ে ব্যবস্থা নেয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (এসিএফ) মো. তবিবুর রহমান জানান, গত দেড় বছরে সাফারি পার্কে ১৪টি বিভিন্ন প্রজাতির অসুস্থ শকুন চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছে। আগে দুটি শকুন চিকিৎসা সেবায় সুস্থ হলে আকাশে অবমুক্ত করা হয়। বর্তমানে ১২টি শকুন সাফারি পার্কের পুনর্বাসন কেন্দ্রে রয়েছে। খাদ্য হিসেবে প্রতিদিন সাড়ে ছয় কেজি তাজা গো-মাংস দেওয়া হচ্ছে।
বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল) মিহির কুমার দো বলেন, শকুন রক্ষায় কিটোপ্রোফেন উৎপাদন ও বাজারজাত বন্ধ করা জরুরি। এ ব্যাপারে বন বিভাগ ও আইইউসিএন দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে।