নীলফামারীর ‘মেহমানখানা’য় অন্যরকম ঈদ আনন্দ
মোশাররফ হোসেন, নীলফামারী
🕐 ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ০৫, ২০২০
চার দিনের ব্যতিক্রমি এক ‘মেহমান খানা’ চালু হয়েছে নীলফামারীতে। ঈদ আনন্দে যাদের ভাগ্যে জোটেনি ভালো খাবার, তারাই ওই মেহমানখানার আমন্ত্রিত অতিথি। এ মেহমানখানায় খাবারের মেনুতে রয়েছেÑপোলাও, গরুর মাংস, ডিম, ডাল, মিষ্টি ও কোমল পানীয়।
নীলফামারী জেলা শহরের শেখ কামাল স্টেডিয়ামের ভিআইপি গ্যালারিতে ঈদের তৃতীয় দিন গত সোমবার দুপুর থেকে ‘মেহমানখানা’ চালু করেছে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেইফ ফাউন্ডেশন। এমন আয়োজনের মধ্য দিয়ে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করছে সংগঠনের সদস্যরা।
প্রতিদিন মেহমানখানায় আপ্যায়িত হচ্ছেন ঈদ আনন্দ বঞ্চিত ৬০০ জন মানুষ। সোমবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত দুই দিনে উন্নতমানের খবার পরিবেশন করা হয় এক হাজার ২০০ অতিথির মাঝে। এসব অতিথি সকলেই নিম্ন আয়ের। রয়েছেন ছিন্নমূল, এতিম সন্তানরা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষও। আমন্ত্রণ পেয়েছেন রিকশাচালকসহ অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ।
সোমবার ও মঙ্গলবার ‘মেহমানখানায়’ দুপুরের খাবার খেতে দেখা গেছে আমন্ত্রিত অতিথিদের। শেখ কামাল স্টেডিয়ামের ভিআইপি গ্যালারিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাজানো চেয়ার-টেবিলে বসে সুশৃঙ্খলভাবে খাবার খাচ্ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে ছিল অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্তা। অতিথিরা তাদের দেওয়া খাবার খেয়ে তৃপ্ত। শুধু তাই নয়, তারা সন্তুষ্ট সদস্যদের আতিথিয়তায়।
গতকাল মঙ্গরবার দুপুরেও ওই মেহমানখানায় গিয়ে দেখা যায় অতিথিদের ভিড়। এদিন ওই মেহমানখানার অতিথি ছিলেন জেলা শহরের রিকসাচালক জিকরুল হক (৪৫)। তিনি সঙ্গে এনেছিলেন মেয়ের জামাই বাবু মিয়াকে (২২)। মেহমান খানায় আতিথিয়তায় মুগ্ধ হয়ে জিকরুল হক জানান, এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশে দাওয়াত খাওয়া তার জীবনে এটিই প্রথম। গরিব মানুষের জন্য দাওয়াত মানেই বিশৃঙ্খল পরিবেশ, কিন্তু মেহমানখানায় এসে পাল্টে গেছে তার ধারণা।
জিকরুল বলেন, ঈদের দিন ভাগ্যে জোটেনি ভালো খাবার। বাড়িতে দাওয়াত দিতে পারিনি মেয়ে-জামাইকে। এজন্য জামাইকে নিয়ে এসেছি দাওয়াতে। ভালো খেলাম, তাদের আতিথিয়তায় সন্তুষ্ট আমরা।
জেলা শহরের রিকশাচালক মনছুর আলম (৩২) বলেন, করোনা দুর্যোগের পর থেকে খুব দুর্দিন যাচ্ছে। এ সময়ে ভালো খাবার দূরের কথা; সাধারণ খাওয়াও জোটেনি পেটপুরে। আজকে খেয়ে অনেক দিনের ভালো কিছু খাওয়ার সাধ পূরণ হলো আমার। সোমবার ওই মেহমানখানায় দেখা যায় অতিথিদের ভিড়। এদিন সেখানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন করোনাকালে ক্ষুদ্র ব্যবসা হারিয়ে বেকার জেলা শহরের শাহীপাড়া মহল্লার নজরুল ইসলাম (৬০)। তিনি এসেছিলেন তার আদরের সাত বছর বয়সের নাতিকে নিয়ে।
খাবার খেয়ে তিনি বলেন, করোনা মহামারিতে আমার ক্ষুদ্র ভাতের হোটেল ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। যেটুকু পুঁজি ছিল সব শেষ হয়েগেছে। এখন বেকার হয়ে বাড়িতে বসে আছি। রমজানের ঈদ গেছে পুরাতন কাপড় আর ডালভাত খেয়ে। কোরবানির ঈদও একইভাবে কেটেছে। ঈদের দিনে ভালো খাবার জোটেনি। নাতিটাকেও খাওয়াতে পারিনি। তাই নাতিটাকে নিয়ে আসলাম। অনেক দিন পর তৃপ্তি সহকারে ভালো খাবার খেলাম।
একই কথা বলেন, সেখানে আগত বাসাবাড়ির শাপলা বেগম (৩০), রোজিনা বেগম (৬০), হোটেল শ্রমিক শুকুর আলী (৪৫), বদরুল ইসলাম (৫৫), কামাল হেসেনসহ (৩৫) অনেকে। তারা সকলে ঈদে ভালো খাওয়া জোটাতে না পেরে ঈদ আনন্দ থেকে ছিলেন অতৃপ্ত।
সোমবার দুপুরে ওই মেহন খানা পরিদর্শনে এসেছিলেন সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহিদ মাহমুদ। তিনি বলেন, সেইফ ফাউন্ডেশনের এমন ব্যতিক্রমি উদ্যোগ এর আগে কখনো দেখিনি জেলায়। তাদের উদ্যোগে সামিল হতে পেরে আনন্দিত। যারা এ উদ্যোগে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেইফ ফাউন্ডেশনের প্রধান সম্বয়কারী রাসেল আমীন স্বপন বলেন, ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে করতে আমাদের এ আয়োজন। প্রতিদিন ৬০০ করে চার দিনের আয়োজনে দুপুরের খাবার খাবেন দুই হাজার ৪০০ অতিথি। ৬ আগস্ট দুপুরের খাবারের পর সমাপ্ত হবে আমাদের ওই মেহমানখানা।
উল্লেখ্য, করোনা দুর্যোগকালে শহরের সমাজ সেবকদের নিয়ে এ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ। এরপর থেকে মানুষের মাঝে স্বাস্থ সচেতনতা সৃষ্টি, ৪০ হাজার নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ, গত রমজান মাসজুড়ে ইফতারী বিতরণ, ঈদের জামা-কাপড় বিতরণ, বন্যার্তদের সহযোগিতা, বৃক্ষরোপণ, বইপড়াসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে আসছে সংগঠনটি। ঈদের আগে ৫৪১ অস্বচ্ছল পরিবারে প্রদান করে মাংস, চাল, আটাসহ রান্নার অন্যান্য উপকরণ। তাদের এসব কাজে সহযোগিতা করছেন- নীলফামারী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, নীলফামারী পৌরসভার মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদসহ দেশ-বিদেশে থাকা জেলার বিভিন্ন স্বচ্ছল মানুষ।