নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব গাইবান্ধা
সুদীপ্ত শামীম, সুন্দরগঞ্জ
🕐 ৪:১৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৮, ২০২৩
নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজার। দিন দিন এই নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার বেড়েই চলছে। উপজেলার বাজার, শপিংমল থেকে শুরু করে গ্রামের ভেতর ছোট ছোট মুদি দোকানসহ বিভিন্ন কেনাকাটায় কোনভাবেই লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না পলিথিনের ব্যবহার। এতে জনস্বাস্থ্যসহ মারাত্মক হুমকির মুখে জীববৈচিত্র।
সুন্দরগঞ্জ পৌরশহরসহ উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কাঁচাবাজার, দোকান, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্য বহনে ব্যবহৃত হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। একবার ব্যবহারের পর পলিথিন ব্যবহার শেষে সেগুলো ছুড়ে ফেলা হচ্ছে রাস্তা, ফুটপাত কিংবা ড্রেনে। যা পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির মুখে। পলিথিনের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন নিষিদ্ধ হলেও এর ব্যবহার রোধে কর্তৃপক্ষের নজর নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০২ সালে সরকারি সিদ্ধান্তে সব ধরনের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশে পরিবহন ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি।
তাছাড়া গাইবান্ধার বিভিন্ন হাট-বাজারে হাতের নাগালেই পাওয়া যায় পলিথিন। ফলে এর ব্যবহার দিন দিন মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ছে। প্রতিটি খুচরা পণ্যের বিক্রেতারা বিভিন্ন সাইজের পলিথিন ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে তরকারি, মাছ, মাংস ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রেতারা নিষিদ্ধ পলিথিন নির্ভর হয়ে বেচা-বিক্রি করছেন।
স্থানীয়রা জানান, পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে হাটবাজারে এক সময় কাগজের ঠোঙা (খাম), চটের ব্যাগ, নেটের ব্যাগ, ঝুড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। বিশেষ করে খাবারের হোটেলে কাগজের ঠোঙা ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এখন আবার পলিথিন সহজে কিনতে পাওয়ায় কাগজের থলের চাহিদা কমে গেছে।
সুন্দরগঞ্জ পৌর বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী আমজাদ আলী বলেন, ‘পলিথিনের যে দাম, ক্রেতাকে পলিথিন দিতে গেলে পণ্য বিক্রি করে আমাদের লাভ কম হয়। তবুও পণ্য বিক্রির জন্য দোকানে পলিথিন রাখতে হচ্ছে।'
উপজেলার মাংস ব্যবসায়ী শাহিন আহমেদ বলেন, 'আমরা তো পলিথিন ব্যবহার করতে চাইনা। ক্রেতারা সঙ্গে করে ব্যাগ নিয়ে আসেন না। তাই মাংস বিক্রি করতে হলে বাধ্য হয়ে তাদেরকে পলিথিন দিতে হয়।'
বেলকা বাজারের ফল বিক্রেতা আরিফুল ইসলাম বলেন, 'মানভেদে এক কেজি পলিথিনের দাম ২২০-৩৩০ টাকা। নেট ব্যাগের দাম এর তুলনায় দ্বিগুণ। তাছাড়া এখন পলিথিন ছাড়া অন্য কোনো ব্যাগ চলে না। সব জায়গা পলিথিন ব্যবহার চলছে৷ তাই আমরাও ব্যবহার করছি।'
মীরগঞ্জ হাটের কয়েকজন মাছ বিক্রেতা জানান, 'পলিথিনে মাছ না দিলে বিক্রি হচ্ছে না বিধায় বাধ্য হয়ে পলিথিন রাখতে হচ্ছে। আর এখন ক্রেতারা ব্যাগ নিয়ে আসেনা।'
কলেজ পাড়া এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, 'হাট-বাজারের দোকানগুলোতে পলিথিন থাকে, এজন্য পণ্য কিনতে বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে যাওয়া হয় না। যদি পলিথিন না পাওয়া যেত তাহলে ব্যাগ নিয়ে যেতাম।'
হামিদুল ইসলাম নামের একজন রিকশা চালক বলেন, 'বাজার করতে এখন আর ব্যাগ নিয়ে আসিনা। সারাদিন রিকশা চালাই। বাড়ি ফেরার সময় বাজারে গিয়ে দোকানে সদাই কিনি। দোকানদারেরাই পলিথিন দেয়, এতেই বাজার-সদাই বাড়িতে নিয়ে আসি। এখন বাড়িতে পলিথিনের অভাব নাই।'
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা লেখক ও সংগঠক কঙ্কন সরকার বলেন, 'পলিথিনের ব্যবহার বাড়ার কারণে পরিবেশ হুমকির মধ্যে পড়ছে। কেননা, এটি পঁচে না। এটি নষ্ট হয় না। ফলে যেখানে এটি পড়ে সেখানে রয়ে যায় এবং সে স্থানের মাটিকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। আজকাল মাটি, নদী, পুকুর, নালা এমনকি সমুদ্রে পর্যন্ত পলিথিনে সয়লাব। যত্রতত্র পলিথিনের ব্যবহার পরিবেশ করছে দূষিত এবং মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনবে। পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহারেও জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে। আজ মানব দেহে, অন্যান্য প্রাণীদেহে পলিথিন কণার উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। যা স্বাস্থের জন্য হুমকি স্বরূপ। অথচ একটু সচেতন হলে আমরা পলিথিনের ব্যবহার কমাতে পারি।'
তিনি আরও বলেন, 'আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় এবং প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে প্রকাশ্যে এসব পলিথিন ব্যাগ ও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। এগুলো অপচনশীল হওয়ায় পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। এটি বন্ধে আইনের সঠিক ব্যবহার ও সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে।'
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. রাশিদুল কবির বলেন, 'পলিথিন সহজে পচে না। পলিথিন বা যেসব দ্রব্য মাটিতে মিশে যায়না সেসবের কারণে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়। ফসলের শিকড় ভালোভাবে ছড়াতে বাঁধাগ্রস্থ হওয়ায় ফসলের ব্যপক ক্ষতি হয়। পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার না করে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে। সর্বোপরি জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও আইনের প্রয়োগ করে এটি বন্ধ করতে হবে।'
এবিষয়ে গাইবান্ধা সিভিল সার্জন ডা. মো. আব্দুল্লাহেল মাফী বলেন, 'পলিথিন পচনশীল না হওয়ায় জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাওয়ার পাশাপাশি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। পলিথিন ব্যবহার বন্ধে এখন থেকে আমাদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। তা নাহলে এই পলিথিন ব্যবহারে একসময়ে পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।'
পরিবেশ অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. রাইহান হোসেন বলেন, 'পলিথিন ব্যাগের ব্যবহারে সামাজিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমাদের কাজ চলমান রয়েছে। পাশাপাশি পলিথিনের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। গাইবান্ধায় আমাদের অফিস না থাকায় এবং জনবল সংকটের কারণে অভিযান চালাতে পারছিনা। তবে আমরা চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।'
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ-আল-মারুফ বলেন, 'নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পৌর শহরের পাশাপাশি গ্রামের হাটবাজারগুলোতেও অভিযান চালানো হবে।'