অবিভক্ত বাংলার প্রথম দুর্গোৎসব
শ.ম সাজু
🕐 ৯:৪৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০১৮
হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা প্রথম শুরু হয়েছিল রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুরে। ৫৩৮ বছর আগে সম্রাট আকবরের শাসনামলে রাজা কংস নারায়ণ সে সময়কার ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে শুরু করেন দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল হিসেবে তাই গর্ববোধ করেন তাহেরপুরের অধিবাসীরা। অথচ দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল হিসেবে ইতিহাসখ্যাত তাহেরপুর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পুণ্যভূমি হিসেবে আজও স্বীকৃতি পায়নি। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের মতে, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে তাহেরপুরে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা গেলে প্রতিবছর শারদীয় দুর্গাপূজার সময় সারা দেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মিলনামেলায় পরিণত হতো স্থানটি।
হিন্দু শাস্ত্রীয় মতে, মা দুর্গার জন্ম স্বর্গে। সব দেবতার মহাতেজশক্তি নিয়ে মহাপরাক্রমশালী মহিষাসুরকে বধ করার মানসে ক্রেতাযুগে রাবনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দশরথপুত্র মহামতী রাম মা দুর্গার অকাল বোধন পূজা করেন। মা দুর্গা তার পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে রাবন বধের বর দেন। বর পেয়ে রাম লংকারাজ রাবনকে বধ করতে সক্ষম হন।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলায় ৮৮৭ বঙ্গাব্দে (১৪৮০ সালে) সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে বাংলার বারো ভূইয়ার অন্যতম রাজা রাজশাহীর কংস নারায়ণ তাহেরপুরের তাহের খানকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। যুদ্ধ জয়ের স্মতি ধরে রাখতে রাজ পুরোহিত রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শে রাজা কংস নারায়ণ দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। তার আহ্বানে মা দুর্গা স্বর্গ থেকে সাধারণ্যে আবির্ভূত হন। এই ঐতিহাসিক পুণ্যভূমিতে শরৎকালের আশ্বিন মাসে মহাষষ্ঠী তিথিতে দুর্গা দেবীর বোধন হয়।
সেই সময় ৯ লাখ টাকা (বর্তমানে ৬০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ) ব্যয়ে কংস নারায়ণ প্রথম যে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন, সেই প্রতিমা ছিল স্বর্ণের তৈরি। এক মাসব্যাপী মহাধুমধামের সঙ্গে এই ঐতিহাসিক শারদীয় দুর্গোৎসব পালিত হয়। মা দুর্গার প্রথম আগমনে ধন্য হয় বাংলার এই পটভূমি। এই পটভূমি থেকে শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা এবং কালে কালে তা পৃথিবীর সব প্রান্তের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশেষত বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়।
দুর্গাপূজার গোড়ার কথা কালক্রমে যাতে হারিয়ে না যায় সে জন্য তাহেরপুরে ‘রাজা কংস নারায়ণ কর্তৃক প্রথম দুর্গাপূজা সৃষ্টি, মন্দির ও জায়গা রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন কমিটি’ গঠিত হয়েছে। এই কমিটি দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল তাহেরপুরকে বাঙালি হিন্দুদের শারদীয় উৎসবের পুণ্যস্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেতে বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারের কাছে আবেদন করেও স্বীকৃতি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে।
হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীর মতে, ‘আধুনিক দুর্গোৎসব পদ্ধতি পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী প্রণীত এই মহাযজ্ঞের প্রথম অনুষ্ঠান হয়েছিল রাজা কংস নারায়ণ রায়ের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে। অনুষ্ঠানের স্থানটি ছিল বারনই নদীর পূর্বতীরে বাগমারা উপজেলার রামরামা গ্রামের দুর্গা মন্দিরে।’
বাগমারার সব শ্রেণি পেশার মানুষ প্রথম দুর্গাপূজার স্থানটি সংরক্ষণ করে ধর্মীয় তীর্থস্থান ও পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. পি এম শফিকুল ইসলামের মতে, তাহেরপুর ছিল রাজা কংস নারায়ণের সাংস্কৃতিক রাজধানী। এখানে বসে কৃক্তিবাস রামায়ণের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। ঐতিহাসিক এই স্থানে প্রতিবছর দুর্গাপূজার সময় জাতীয় উৎসব পালনের দাবি করেছেন তিনি।
তাহেরপুরে পর্যটকদের তীর্থস্থান করার দাবিতে ২০০২ সালে কমিটির সম্পাদক সঞ্জীব রায় মিন্টু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেন। কিন্তু এত দিনেও পুণ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি তাহেরপুরের।
কলেজশিক্ষক সত্যজিৎ রায় তোতা বলেন, এখানকার রাজবাড়ীর গোবিন্দ মন্দিরে একটি বৃহৎ শিলালিপি রয়েছে। এতে দুর্গাপূজার প্রতিষ্ঠা, স্থান, সাল, তারিখ ও অতীত কিছু ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি অনিল কুমার সরকার বলেন, ঐতিহাসিক তাহেরপুরকে পুণ্যভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হলে এখানে পর্যটননগরী গড়ে উঠবে। সারা বিশ্বে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের প্রতিবছর ঢল নামবে এখানে। বাড়বে সরকারের রাজস্বও।
এদিকে, গত ১১ অক্টোবর সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল বাগমারার তাহেরপুরে রাজা কংস নারায়ণ রায় বাহাদুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দুর্গা মন্দিরে অষ্টধাতু ব্রোঞ্জ প্রতিমা স্থাপন করা হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে এক টনেরও বেশি ওজনের ব্রোঞ্জের তৈরি প্রতিমাটি স্থাপন করা হয়। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার এমপি।
তাহেরপুরের মন্দির কমিটির সভাপতি নিশীথ কুমার সাহার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন- সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক, সাধন মজুমদার এমপি, কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জী, সহ-সভাপতি অনিল কুমার সরকার, বাগমারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাকিউল ইসলাম, ভবানীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আব্দুল মালেক মণ্ডল ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রুবেল।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228