ওঝার অজ্ঞতায় বছরে প্রাণ যায় ৬ হাজার
দেশে প্রতি বছর সাপের কামড়ের শিকার হন ৩ লাখ মানুষ
মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী
🕐 ১:৪৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২১
ন্যাশনাল গাইড লাইনের ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি বছর ৩ লাখ মানুষ সাপের কামড়ের স্বীকার হন। এতে মারা যান প্রায় ৬ হাজার মানুষ। কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভাষ্য, ওঝার অজ্ঞতা ও সাধারণ মানুষের অসচেতনতা। ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর সহযোগী সংগঠন ট্যাক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ ‘বিশ্ব সর্প দংশন ও চিকিৎসা দিবস’ পালন করে আসছে।
এই ট্যাক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের অন্যতম সদস্য বোরহান উদ্দিন রোমন বিশ্বাস জানান, ‘এখনো অধিকাংশ মানুষের বদ্ধমূল ধারণা- হাসপাতালে সাপের কামড়ে চিকিৎসা হয় না। এ কারণে তারা সাপের কামড়ের পর ওঝার দারস্থ হন। কিন্তু বিষধর সাপগুলো যদি বিষযুক্ত কামড় দেয়, তবে ওঝারা কিছুই করতে পারেন না। তারা শুধুমাত্র রোগীকে সুস্থ করার লোক দেখানো নাটক করে থাকেন।’
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে রয়েছে ৯২টি প্রজাতির বিষধর সাপ। অন্যদিকে রাজশাহীর স্নেক রেসকিউ অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টারের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ১০২ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২৮টি প্রজাতির সাপ বিষধর। এই ২৮ প্রজাতির বিষধর সাপের মধ্যে ১৩টি থাকে সমুদ্রে এবং বাকি ১৫টি থাকে স্থলে বা ডাঙ্গায়। এদিকে মেডিকেল সায়েন্স বলছে, এই ১৫টি সাপের মধ্যে গোখরা প্রজাতির সাপগুলো গড়ে ১০০টি কামড় দিলে গড়ে ৮৫টি কামড়েই তারা দাঁতের বিষ ঢালে না। মূলত মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় এটিকে ‘ড্রাইবাইট’ বলা হয়। এতে মৃত্যু হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ওঝারা এই ড্রাইবাইটের সুযোগ নিয়ে তারা তাদের কৃতিত্ব জাহির করে। এতে সাধারণ মানুষ ওঝাদের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই একটি ভুল ধারণায় আবদ্ধ থাকেন। যে সুযোগটি তারা নিয়ে থাকেন।
কিন্তু গড়ে ১৫টি ঝোবলের মধ্যেই থাকে মৃত্যু ঝুঁকি। এছাড়া অন্যান্য যে বিষধর সাপগুলো রয়েছে যেমন- রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া, কমন ক্রেইট বা কালাচ এই সাপগুলোর ড্রাই বাইটের প্রবণতা নেই বললেই চলে। এ ধরনের সাপের কামড়ের পর ওঝাদের কাছে চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর স্বীকার হয়েছেন অনেকেই। একারণে ওঝারা বলে থাকেন রাসেলস ভাইপার কিংবা কমন ক্রেইট কামড়ালে মানুষ বাচে না, বাস্তবে তা নয়।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আবু শাহিন বলেন, ‘সাপে কামড়ানোর পরে প্রথম দুই ঘণ্টা রোগীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে। যদি সাপে কামড়ানো ব্যক্তিটি দুই ঘণ্টার মধ্যে মেডিকেলে পৌঁছাতে পারেন এবং চিকিৎসা নেন তবে তার মৃত্যুর সম্ভাবনা শূন্য হয়ে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘রামেকে ৯৫ শতাংশ রোগী আসে ওঝার ফেরত। এতে দুটো সমস্যা হয়ে থাকেÑ প্রথমত, তারা সময় নষ্ট করেন। দ্বিতীয়ত, ওঝার ভুলভাল চিকিৎসা ও অসঙ্গত কাটাছেঁড়া। এতে রোগীর অবস্থার আরও সঙ্কটাপন্ন করে ফেলেন ওঝারা।’
এদিকে রাজশাহী স্নেক রেসকিউ অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টারের গবেষক ও তত্ত্বাবধায়ক বোরহান বিশ্বাস রমন বলছেন, দেশে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ওঝাদের চিকিৎসা প্রথা উচ্ছেদ জরুরি। কারণ, গত জুন থেকে অদ্যাবধি এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মোট ৩৮ জন মানুষ ওঝাদের কাছে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মারা গেছেন। এর মধ্যে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলাতেই আটজন মারা গেছে। গত দু’বছরে গোদাগাড়ী উপজেলার নিমতলী গ্রামে ১৩ জন মারা গেছেন। তবে ৫ জন মেডিকেলে চিকিৎসা নেওয়ায় তারা বেচে গেছেন।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে ঠাকুরগাঁও জেলার রানী শংকৈলে গ্রামের রুবেল হোসেন (২৫) নামের এক ফুটবলারকে রাত আড়াইটার দিকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানায় সাপ কামড় দেয়। দুর্ভাগ্যবশত রুবেলের পিতা নিজেই একজন ওঝা। তিনি তার ছেলের চিকিৎসা নিজেই শুরু করেন। রাত আড়াইটা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত তিনি সময়ই নষ্ট করেন। যখন অবস্থার অবনতি চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন মেডিকেলে পাঠান। কিন্তু মেডিকেলে পৌঁছানোর আগেই সকাল ৮টায় রুবেল মারা যায়।
আবার গত দুইদিন আগেও নওগাঁর সাপাহারে এক গরু ব্যবসায়ী সাপের কামড়ে মারা যান। এই মৃত্যুর জন্যও ওঝাই দায় ছিলেন। এক মাস পূর্বে রাজশাহীর দুর্গাপুরে নানির বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় এক শিশুকে সাপে কামড় দেয়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, তারও প্রাথমিক চিকিৎসা ছিল ওঝার কাছে।
গবেষক রমন বলেন, বাংলাদেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে এখনো দেখা যায়- সাপে কামড়ের চিকিৎসা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো দিতে চান না বা দেন না। কারন, সাপে কামড়ে চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা নার্স নেই। আবার জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে আইসিইউ সাপোর্ট নেই। এ সকল কারণে সাপে কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে অনাগ্রহ দেখান।
রাজশাহী স্নেক রেসকিউ অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টারের তত্ত্বাবধায়ক ও গবেষক বোরহান বিশ্বাস রমন বলেন, ‘বাংলাদেশের সাপে কামড়ের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের তৈরি নিজস্ব এন্টিভেনম প্রয়োজন। যা বাংলাদেশে এখনো নেই। তবে আশার বিষয় হচ্ছে- এর উৎপাদন করার বিষয়টি নিয়ে কাজ চলমান রয়েছে। যেটা বাংলাদেশে ভেনম রিসার্চ সেন্টার নামে পরিচিত।’
তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশে সাপে কামড়ের যে এন্টিভেনম দেওয়া হয় সেটি পাশর্^বর্তী দেশ ভারত থেকে আমদানিকৃত। এই আমদানিকৃত ওষুধটি পলিভেলেন্ট আকারে আসে। যেটি বাংলাদেশের সবগুলো সাপের কামড়ে একটিই এন্টিভেনম। এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়- ভারত থেকে আমদানিকৃত এন্টিভেনমটি বাংলাদেশে সাপে কামড়ের বিপরীতে কতটা কার্যকর?’
তিনি আরও বলেন, ‘একমাত্র জনসচেতনতা ও বাংলাদেশে তৈরি এন্টিভেনম সাপে কামড়ের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। ২০১৭ সালে এক সম্মেলনে ডব্লিউএইচও সর্প দংশন ও এর চিকিৎসার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। প্রতিটি দেশকে তাদের নিজ এলাকার সাপ থেকে এন্টিভেনম তৈরি করতে হবে তারও একটি নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল ওই সম্মেলনে। সেক্ষেত্রে এ বিষয়ে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে।’
সম্ভাবনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যদি এন্টিভেনম উৎপাদন করা সম্ভব হলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে একটি বড় সাফল্য অর্জিত হবে। কারণ, ভারত থেকে একডোজ এন্টিভেনম কিনতে খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। কিন্তু এসব এন্টিভেনম একজন সাপে কামড়ানো ব্যক্তিকে দুই থেকে তিন ডোজ এন্টিভেনম প্রয়োগ করতে হচ্ছে। কিন্তু দেশেই যদি এর নিজস্ব উৎপাদন থাকত তবে সেটি এক ডোজেই চিকিৎসা যেত। এমনকি আমাদের দেশ থেকে পাশর্^বর্তী দেশে এন্টিভেনম সরবরাহ করে লাভবান হতে পারত দেশ।’
এদিকে রামেকের চিকিৎসক ডা. আবু শাহিন জানান, বাংলাদেশে সাপে কামড়ের চিকিৎসা এখনো উন্নত নয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সাপে কামড়ের রোগী মেডিকেলে পৌঁছানোর পর তাকে পর্যবেক্ষণে রেখে দেখা হয়- বিষক্রিয়ার লক্ষণগুলো রোগীর আসছে কিনা? যদি বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা দেয় তখন রোগীকে একডোজ এন্টিভেনম দেওয়া হয়। এরপরও আবার পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।’
তিনি যোগ করেন, ‘কিন্তু উন্নত বিশ্বে সাপে কামড় দেওয়া ব্যক্তিকে মেডিকেলে প্রবেশ মাত্রই তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট করা হয়। তার শরীরে কতটুকু বিষক্রিয়া হয়েছে? বর্তমান শারীরিক অবস্থা কী? কতটুকু পরিমাণ এন্টিভেনম দেওয়া প্রয়োজন? ইত্যাদি দেখা হয়। তারপর প্রয়োজন মতো চিকিৎসা হয়ে থাকে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. আবু রেজা তুহিন জানান, মূলত সাপে কামড়ের দুর্ঘটনাগুলো ঘটে থাকে গ্রামীণ জনপদের তৃণমূল পর্যায়ে। এমনিতেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্ন। উপরন্তু শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় চিন্তাধারাও সেকেলে। বেশিরভাগ মানুষ জানেই না, সাপে কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়টি। তাদের ধারণা মেডিকেলে সাপে কামড়ের চিকিৎসা হয় না। এই অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে তারা ‘ট্রেডিশনাল পদ্ধতি’ প্রয়োগ করে অর্থাৎ ওঝার দারস্থ হয়। আর এতেই মৃত্যু হয় সাপের কামড়ানো ব্যক্তির।