ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বগুড়ায় তাকবীর হত্যা রহস্য উদঘাটন

নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া
🕐 ১২:৩৩ অপরাহ্ণ, জুন ১৫, ২০২১

বগুড়ায় তাকবীর হত্যা রহস্য উদঘাটন

বহুল আলোচিত ছাত্রলীগ নেতা তাকবীর হত্যা রহস্য জানা গেছে। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি কে কী ভূমিকায় ছিল সেটাও জানা গেছে। হত্যাকারীদের প্রশ্রয়দাতাদের সম্পর্কেও জানতে পেরেছে পুলিশ। শিগগিরই আদালতে জমা দেওয়া হবে প্রতিবেদন। শনিবার বিকালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বগুড়া সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুল মালেক এসব কথা বলেন। তাকবীর বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক 
এবং বগুড়া শহরের মালতীগর দক্ষিণপাড়ার জহুরুল ইসলামের ছেলে।

তদন্তকারী কর্মকর্তার দাবি, তদন্ত কাজ শেষ পর্যায়ে। মামলার ১ নম্বর আসামি আব্দুর রউফ হত্যাকা-ের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। অন্য আসামিদের সঠিক ঠিকানা ও অবস্থান নিশ্চিত করে শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করা হবে। আদালতে দেওয়া হবে চার্জশিট। তাছাড়া আদালতে আত্মসমর্পণ করতে আসা মামলার এজাহারনামীয় তিন আসামি এবং সন্দেহভাজন গ্রেফতার একজনসহ কারাগারে রয়েছে চারজন। গ্রেফতার সবাই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ছাত্রলীগের আব্দুর রউফ ওরফে ‘রগচটা রউফ’-এর নেতৃত্বে সরাসরি কিলিং মিশনে ছিল ৯ থেকে ১০ জন। মারা যাওয়ার আগে হামলাকারীদের সম্পর্কে তাকবীর বলে গিয়েছিলেন। তাকবীর হত্যাকা- তিন মাস পেরিয়ে গেলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাছের হওয়ায় শুরু থেকেই আসামি গ্রেফতারে পুলিশ সদস্যদের তেমন ভূমিকায় দেখা যায়নি। উল্টো বলা হয়েছে, আসামিরা দেশে নেই, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত জেলা শহর ও নিজ গ্রাম ছাড়াও দলবল নিয়ে কক্সবাজারে সৈকত ভ্রমণেও দেখা গেছে আসামিদের। বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মজিবর রহমান মজনু ও দফতর সম্পাদক আল রাজি জুয়েলসহ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় হত্যাকা-ের আগে মোটরসাইকেলে খুনির দল নিয়ে প্রায়ই মহড়া দিয়ে পুলিশকে শক্তির জানান দিত ‘রগচটা রউফ’।

সুচতুর ও ঠাণ্ডা মাথার খুনি হিসেবে পরিচিত রউফ প্রথমে চেষ্টা করে কোনোভাবেই যেন এ হত্যা মামলায় তার নাম না আসে। এ কারণে তিনি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মজিবর রহমান মজনুকে দিয়ে জেলার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে ফোন করিয়ে নেয়। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে মামলার প্রধান আসামি হিসেবে নাম ওঠার পর এখন সে নতুন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে চেষ্টা করছে অভিযোগপত্রে প্রত্যক্ষ খুনি না হয়ে হুকুমের আসামি হওয়ার। এরই মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে আদালতের বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে দৌড়ঝাঁপ করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আল রাজি জুয়েল। আল রাজি জুয়েল সাংবাদিককে বলেন, তিনি ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকাবস্থায় রউফ তার কর্মী ছিল। মামলা হওয়ার পর থেকে তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।

পুলিশের রেকর্ড ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র দাবি করে, পূর্বপরিকল্পিতভাবে চলতি বছরের ১১ মার্চ সন্ধ্যায় বগুড়া শহরের জিরো পয়েন্ট সাতমাথায় ছাত্রলীগ নেতা তাকবীর হত্যার মিশনে রউফ সরাসরি নেতৃত্ব দেয়। সেদিন হত্যাকারীরা দেশীয় ধারালো অস্ত্রসহ মোটরসাইকেল নিয়ে আজিজুল হক কলেজের পাশে ওয়াপদা গেটে জড়ো হয়ে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রার্থী তাকবীরের ওপর উপর্যুপরি হামলা চালিয়ে গুরুতর জখম করে। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ মার্চ মারা যান তাকবীর। পরে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফ (সদ্য বহিষ্কৃত), সহযোগী জাহিদ হাসান, আনোয়ার হোসেন, শ্রী বিধান চন্দ্র, মো. নিশাদসহ সাতজনের নাম উল্লেখপূর্বক অজ্ঞাত পরিচয় ৩৫ জনকে আসামি করে বগুড়া সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন তাকবীরের মা মোছা. আফরোজা ইসলাম। কয়েকটি সিসি ক্যামেরা ফুটেজ, মারা যাওয়ার আগে তাকবীরের জবানবন্দি, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং ১৬৪ ধারার জবানবন্দি সব কিছুই রউফের বিপক্ষে।

এদিকে, মামলার প্রধান আসামি সরাসরি কিলিং মিশনে থাকা ধুনট উপজেলার বিলচাপরী গ্রামের ফরাজুল ইসলামের ছেলে আব্দুর রউফ ওরফে রগচটা রউফ সম্পর্কে জানতে চাইলে ধুনট থানার ওসি কৃপা সিন্ধু বালা কোনো তথ্য নেই বলে জানান সাংবাদিককে। এরই মাঝে দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর এজাহারনামীয় আসামি জাহিদ হাসান, বিধান চন্দ্র মোহন্ত ও মো. নিশাদ ৩১ মে আদালতে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থনা করলে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে জেলার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ শাহরিয়ার তারিক জামিন নামঞ্জুর করে আদেশ দেন। অপরদিকে, চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডে আল-আমিন নামের যে যুবককে পুলিশ গ্রেফতার করে জবানবন্দি আদায় করে নিয়েছেন, তার নাম মামলার এজাহারেই উল্লেখ নেই। সমালোচনা হয়েছে, এজাহারভুক্ত আসামিকে গ্রেফতার না করে মামলার বাইরের একজনকে ধরে জবানবন্দি নেওয়ায়।

নিহত তাকবীরের বাবা জহুরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, আল-আমিনের নাম এজাহারে না থাকলেও তাকে গ্রেফতার ও জবানবন্দির বিষয়টি সন্দেহজনক। একই আদালতে ১৮ মার্চ সন্দেহভাজন আসামি আল-আমিন হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পুলিশের দাবি, সিসিটিভি ফুটেজে শনাক্ত করার পর তাকে কাহালু থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অথচ রউফের নামে করা হত্যা মামলাকে মিথ্যা দাবি করে শহরের বেশ কয়েকটি স্থানে পোস্টারও সাঁটানো হয়েছে। রউফকে রক্ষায় জেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশের যে ইন্ধন রয়েছে, সেটাও প্রায় নিশ্চিত। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে উল্লেখ করে দাবি করেন, ছাত্রলীগের একজন নেতা হিসেবে রউফ তার সহযোগিতা পেয়েছে। কিন্তু সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হওয়া এবং হত্যা মামলার আসামি হওয়ার পর পুনরায় তার কাছে ভিড়তে পারেনি।

তাকবীরের মা মোছা. আফরোজা ইসলাম বলেন, ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই মামলাটি আপস করার জন্য হুমকি দিচ্ছে। বিচার নিয়ে সংশয়ে আছি। আবার পুলিশের ভূমিকাও ততটা জোরালো নয়। তাকবীরের বাবা জহুরুল ইসলাম বলেন, তার ছেলেকে প্রকাশ্যে খুন করলেও মামলা নিয়ে এখনো চক্রান্ত চলছে। উপযুক্ত বিচার পাওয়া নিয়ে চিন্তায় রয়েছি। বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ বলেন, রউফকে ধরতে পুলিশের একাধিক দল শুরু থেকেই মাঠে ছিল। বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা জানান, হত্যাকাণ্ডে জড়িত সব আসামি গ্রেফতারে শুরু থেকেই পুলিশ সচেষ্ট ছিল। আসামি গ্রেফতারপূর্বক হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করে পুলিশ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।

 
Electronic Paper