ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাঁচায় নদী, বাঁচাও নদী

বাইশা ডারা নদী কি রক্ষা হবে না?

ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৮:৪৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৩১, ২০১৮

আমাদের দেশে অসংখ্য নদী আছে যেগুলো কখনোই নদী হিসেবে গ্রন্থগত হয়নি। না সরকারি কোনো সংস্থায় না বেসরকারি কোনো সংস্থায়। আর সে কারণেই আমাদের দেশের নদনদীর প্রকৃত সংখ্যা কেউ বলতে পারেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে এমন অনেক নদীর সন্ধান পেয়েছি যেগুলো এখনো নদীর কাঠামো নিয়ে প্রবাহিত আছে। কিন্তু নদী হিসেবে স্বীকৃতি নেই।

আবার এমন অনেক নদী আছে যেগুলো পুরাতন দলিলে নদী হিসেবেই আছে। নদীগুলোর স্বাভাবিক চরিত্র হারানোর ক্ষেত্রে সরকারেরও ব্যর্থতা কম নয়। আজ যে নদীর কথা বলছি এ নদীর নাম বাইশা ডারা।

সাধারণত নদী যখন তার গতি-প্রকৃতি হারাতে হারাতে কোথাও কোথাও বিশাল প্রস্থ নিয়ে বেঁচে থাকে সেই অংশটিকে রংপুর অঞ্চলে ডারা বলা হয়। হয়তো নদীটির প্রবাহ থাকে অথবা থাকে না। বাইশা ডারা নদীরও সেই অবস্থা। তবে এখনো এর প্রবাহ বিদ্যমান। বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহ বজায় থাকে। শুষ্ক মৌসুমে অনেক স্থানে একেবারেই শুকিয়ে যায়। এক সময় এ নদীটি বারোমাসি নদী হিসেবেই প্রবাহিত হতো।

বাইশা ডারা নদী খুঁজে পাওয়ার গল্পটি বলি। তিন-চার বছর আগে রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার পাওটানা বাজারে গিয়েছিলাম। সেই বাজারের পাশ দিয়ে একটি পানির প্রবাহ দেখে এসেছি। সম্প্রতি আবারও গিয়েছিলাম পাওটানায়। সেখানে ওই পানির প্রবাহটির পাশে আবারও যাই। স্থানীয় অনেক বৃদ্ধ লোকের সঙ্গে কথা বলি। কথা বলতে বলতে জানতে পারি এ নদীর অতীত কেমন ছিল।

বাইশা ডারা নদীটি তিস্তার আন্তঃশাখা নদী এবং তিস্তার উপনদী। অর্থাৎ এ নদীটি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা থেকে বের হয়ে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার সাওলা ইউনিয়নের শিবদেব এলাকা দিয়ে তিস্তায় পতিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫-২০ কিলোমিটার। তিস্তার যে স্থানে এ নদীটি মিলিত হয়েছে সেখানে একটি স্লুইস গেট আছে। উপস্থিত বৃদ্ধদের সবাই জানালেন ৪০-৫০ বছর আগে এ নদীতে নৌকা চলত।

নৌকাযোগে তারা কাউনিয়া যেতেন। আবার তিস্তার যে অংশে পানিয়ালের ঘাট আছে সেখানে নৌপথে যাতায়াত করতেন। মাত্র ৪০-৫০ বছরেই একটি বারোমাসি নদী এখন মৌসুমি নদীতে পরিণত হয়েছে। পীরগাছা উপজেলার সাওলা ইউনিয়নের তাসতালুক মৌজার আব্দুর রাজ্জাক জানালেন- উজানে এ নদীটি তুলসি ডাঙা নামে পরিচিত। এ নদীতে নৌকাবাইচ হতো।’

বাইশা ডারা নদীর সামান্য অংশই সরকারি আছে। অবশিষ্ট নদী ব্যক্তিমালিকানায়। স্থানীয় জনগণ বলছেন এ নদীটি সরকারি রেকর্ডপত্রে ব্যক্তিমালিকানায় আছে। খুবই সহজ প্রশ্ন, খুবই সহজ জবাব। নদীর মালিকানা কি ব্যক্তির হতে পারে? উত্তর-না। তাহলে এ নদীর মালিক কীভাবে ব্যক্তি হয়? যেভাবেই নদীর মালিকানার কাগজপত্র তৈরি হোক না কেন এ নদীর প্রকৃত মালিক সরকার।

পাওটানা বাজারের পাশে এ নদীর ওপর একটি বাঁশের সাঁকো আছে। নদীর প্রস্থ মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। তারপর সেখানে সাঁকো দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের অনেক নদী মৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে নদীর চেয়ে সেতু ছোট করে দেওয়া। এতে করে দখলদাররাও সেতুর প্রস্থকেই নদীর প্রস্থ ধরে নিয়ে বাকিটা দখল করতে থাকেন।

এক সময় যে বাইশা ডারা নদীটি যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল, মাছের চাহিদাপূরণের মুক্ত জলপ্রবাহ ছিল সেটি কি আর উদ্ধার হবে না? সরকার চাইলে এ নদী উদ্ধার কঠিন নয়। এর জন্য সরকারের সদিচ্ছা জরুরি।

কিছুদিন আগে এর চেয়েও মৃতপ্রায় দখল হওয়া একটি নদী সরকার উদ্ধার করেছে। এর জন্য স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। স্থানীয় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে। স্থানীয়দের চেষ্টা ছাড়া নদী রক্ষা করা কঠিন।

তিন-চার মাস আগে নীলফামারী উপজেলার ডোমার এবং সদর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া দেওনাই (লক্ষ্মীচাপ-হরিণচড়া) নদীটির দখল নিয়েছিল স্থানীয় কিছু ব্যক্তি। অন্যদিকে আন্দোলনকারীগণ নদীটি রক্ষায় রিভাইন পিপলের মাধ্যমে ‘দেওনাই সুরক্ষা কমিটি’ গঠন করেন।

তারা নদী রক্ষায় অনেক আন্দোলন করেছেন। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পেরে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার জেলা প্রশাসকের কাছে ওই নদী সম্পর্কিত প্রতিবেদন চেয়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড ওই নদীর যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে করে ওই নদীটি তারা তালিকাভুক্ত করেছে এবং খননের উদ্যোগ নিয়েছে। একই সঙ্গে নদীটি এখন উন্মুক্ত হয়েছে। সেখানে জেলেরা বাধাহীনভাবে মাছ শিকার করছেন।

বাইশা ডারা নদীটি রক্ষা করার জন্য স্থানীয় আন্দোলন হলে উপজেলা প্রশাসন এবং জেলা প্রশাসন তখন নড়েচড়ে বসবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এখন নদী রক্ষায় অত্যন্ত তৎপর। নদী রক্ষা কমিশনও তখন এগিয়ে আসবে। সবচেয়ে বড় কথা প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশের নদীগুলো রক্ষায় অত্যন্ত আন্তরিক। তিনি চান দেশের সব নদী কোনো রূপ বাধা ছাড়াই প্রবাহিত হোক।

দেশের যেসব নদী এখনো সরকারের তালিকাভুক্ত হয়নি সেসব নদী তালিকাভুক্ত করা জরুরি। নদীর দখলদারদের হাত থেকে নদীগুলো রক্ষা করাও অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এর জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে শুধু প্রধানমন্ত্রী চাইলেই নদী রক্ষা হবে না। বাইশা ডারা নদীকে কিছুতেই মরতে দেওয়া উচিত হবে না।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসকের কাছে অনুরোধ করি-এ নদী রক্ষায় সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণের। প্রয়োজনে উপজেলা এবং জেলায় যে নদী রক্ষা কমিটি আছে, সেখানে এ বিষয়টি উত্থাপন করা হোক। তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ নদী রক্ষা সম্ভব।

ড. তুহিন ওয়াদুদ : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]

 
Electronic Paper