সুখী মানুষের গল্প
মাসুদ কামাল হিন্দোল
🕐 ৯:৪৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৮, ২০১৮
হাসি কান্না আনন্দ বেদনা নিয়ে আমাদের এ জীবন। এ জীবনে পূর্ণতার চেয়ে অপূর্ণতাই বেশি। তাই আমরা দিবানিশি এক টুকরো সুখের সন্ধান করি। পাশ্চাত্যের দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল ‘সর্বাধিক লোকের সর্বাধিক সুখ’ কামনা করেছেন বহু যুগ আগেই। দেশের বুদ্ধিজীবীরা ইদানীং বলছেন, সামাজিক বিপ্লব না হলে সুখ সর্বজনীন হবে না। কিন্তু আমাদের দেশে বিপ্লব করার মতো বিপ্লবীও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তাই সুখ যেন আমাদের কাছে অধরাই থেকে যাচ্ছে। বিশ্ব সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানও ভালো নয়। আসলে আমরা পরিপূর্ণ সুখ ভোগ এবং উপভোগ দুটোই করতে চাই একসঙ্গে। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন সুখের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। সুখ সম্পর্কে একটা ধারণা করা যেতে পারে মাত্র। তাদের দৃষ্টিতে সুখের দুটি দিক আছে। একটি মানসিক আরেকটি সামাজিক। উচ্চবিত্তের চাহিদা এক রকম মধ্যবিত্তের কিংবা নিম্নবিত্তের চাহিদা আরেক রকম। বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া এবং পাওয়ার মাঝে যে এক ধরনের ফারাক তৈরি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রযুক্তি বিকাশের কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। এখন মানুষ খুব সহজেই নিজেকে অন্য ১০ জনের সঙ্গে তুলনা করতে পারছে।
এক.
সুষ্ঠু সুন্দর জীবনের জন্য ঘুম অপরিহার্য। মানুষের দৈহিক, মানসিক ও বোধশক্তির বিকাশ প্রক্রিয়া অনেকখানি নির্ভর করে পর্যাপ্ত ঘুমের ওপর। ঘুম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয়েছে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের জীবনে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা ঘুম অত্যাবশ্যক। অথচ আমরা অনেকে ঘুমাতে পারি না ঘর বিছানা থাকা সত্ত্বেও। ঘুমের জন্য আমাদের ওষুধ খেতে হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হয়। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী চলতে হয়। ঘুমানোর আগে এটা খাওয়া যাবে না। ওটা খাওয়া যাবে না। এমন নির্দেশনা মেনে চলতে হয় অক্ষরে অক্ষরে। ইনসমোনিয়া অনেকেরই নিত্যসঙ্গী।
অথচ বিত্তহীন মানুষদের ঘুমানোর জন্য কোনো আয়োজনের প্রয়োজন হয় না। তারা যেখানে সেখানে ঘুমাতে পারে। ফুটপাতে, রোড ডিভাইডারের মাঝে, মালবাহী ট্রাকের ওপর বা সবজির টুকরির ভেতর হাত পা গুটিয়ে। এভাবেই তারা কি শান্তিতে ঘুম দেয়। রৌদ্র-বৃষ্টিতে সে ঘুমের ব্যত্যয় ঘটে না। পৃথিবীর কোনো কোলাহলই সে নিদ্রা ভঙ্গ করতে পারে না। আমরা কেন ওদের মতো ঘুমাতে পারি না। ওদের ঘুম দেখলে মনে হয় এ যেন শান্তির ঘুম। ঘুমের কত আনন্দ। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে পর্যাপ্ত ঘুমের ওপর নির্ভর করে একজন মানুষের সুস্থতা, কর্মদক্ষতা ও সুন্দর জীবন।
দুই.
হাসির মতো ইচ্ছে করলে জোর করে কাঁদাও যায় না। কিন্তু আমরা এখন কষ্ট পেলেও কাঁদতে পারি না বা চাই না। কাঁদতেও সাহস লাগে। আমরা কি অনেকেই কষ্টে কষ্টে কষ্টি পাথর হয়ে যাচ্ছি? স্বজন হারানোর বেদনায়ও আমরা কাঁদতে পারি না। সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসমর্পণ করেও কাঁদতে পারি না। কাঁদতে গেলেও ভাবি পাছে লোকে কিছু বলে। যদি ফেয়ার পলিশ নষ্ট হয়ে যায় (নারীদের ক্ষেত্রে)। কাঁদার আগেই ঠিক করে নেই কয় ফোঁটা পানি চোখ দিয়ে বের করব। সবকিছুই হয় পরিকল্পনামাফিক। সোসাইটিকে মাথায় রেখে। অথচ বিত্তহীন বা ধার্মিক মানুষরা কত সহজেই কাঁদতে পারে। কান্নার মাধ্যমে খুব সহজেই দুঃখ কষ্ট বেদনা বের করে দেন ভেতর থেকে। তাদের মধ্যে কোনো মেকি কান্না বা মায়াকান্না বলে কিছু নেই। আমরা তো ওদের মতো কাঁদতে পারি না।
মহাজাতকের কোয়ান্টাম টিপসে বলা হয়েছে, ‘কাঁদুন। প্রাণ খুলে কাঁদুন। নীরবে অথবা হাউমাউ করে কাঁদুন। ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদুন বা ডুকরে ডুকরে কাঁদুন। কান্নাকে মেয়েলি ব্যাপার বা অপ্রয়োজনীয় মনে করারও কোনো প্রয়োজন নেই’। সুস্থ মমতাভরা জীবনের জন্য কান্না অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনোবিজ্ঞানীরা বিবেচনা করছেন। চোখের পানি ও কান্না মনের আবেগ প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। তাই মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, দুঃখ ও বেদনার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শরীর ও শরীরের সিস্টেমকে রক্ষা করার এক প্রাকৃতিক নিরাপত্তা প্রক্রিয়া হচ্ছে কান্না। কাঁদতে পারলেই দেখবেন কেমন হালকা লাগা শুরু করেছে। কান্নার মধ্যে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না, হাউমাউ করে কান্না বেশি উপকারী। ফোঁপানি সারা শরীরে মৃদু ও ছন্দময় তৎপরতা সৃষ্টি করে। এ ধরনের কান্না শুধু কণ্ঠনালিতেই নয়, বুকে, পেটে নাভিমূলে এমনকি সাইনাসেও কম্পন সৃষ্টি করে এবং ভেতর থেকে আপনাকে প্রশান্ত করে তোলে।
তিন.
মানুষ খাওয়ার জন্য বাঁচে না। বাঁচার জন্যই খায়। অথচ আমরা অনেকেই খেতে পারি না। আমাদের প্রয়োজন সুষম ও সঠিক পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ। খেলেও পরিপূর্ণ আহার সম্ভব হয় না। খাওয়াতে রুচি হয় না। অরুচির সমস্যা। কত কত রুচিবর্ধক বটিকা সেবন করতে হয়। বাঁচার প্রয়োজনে অনেককে অরুচি সত্ত্বেও খেতে হয়। অথচ এমন অনেক মানুষ আছেন যারা পূর্ণতৃপ্তি নিয়ে আহার করেন। তাদের খাওয়া দেখলে আমাদের অনেকের মনে হয় আমরা কেন তাদের মতো তৃপ্তিসহকারে খেতে পারি না। আমাদের তো খাওয়ার অভাব নেই। ভালো ভালো সব খাবার আমাদের টেবিলে থাকে। আসলে তাদের কাছে Hunger is the best sauce. আমাদের তো কোনো সসেও কাজ হচ্ছে না।
চার.
যত হাসি তত কান্না, বলে গেছেন রাম শর্মা। মেয়েদের বেশি হাসতে নেই। পরে কাঁদতে হয়। এমন সংস্কার রয়েছে। তাই আমাদের দেশে অনেক নারী এখনো প্রাণখুলে হাসে না। আর অনেক পুরুষ প্রাণখুলে হাসে না, পাছে ব্যক্তিত্ব চলে যায়। মুখে আমরা আনন্দ বিনোদনের কথা বললেও আসলে আমরা আনন্দ করতে পারি না বা জানি না। কিসে আনন্দ, কিসে নির্মল হাসি? যারা ঘরে ব্যায়ামের যন্ত্র দিয়ে শরীরচর্চা করেন তাদের হৃদকম্পন ১০ মিনিটে যতটুকু বাড়ে। ১ মিনিটের প্রাণখোলা হাসিতেও সমপরিমাণ হৃদকম্পন বৃদ্ধি পায়। হাসি যে জীবনের জন্য কত প্রয়োজন তা আমরা অনেকেই জানি না। অথচ বিত্তহীন মানুষরা সামান্যতেই আনন্দ খুঁজে পায় এবং হাসতে পারেন। এক প্লেট চটপটি বা একটা আইসক্রিম খেয়ে তাদের যে আনন্দ। আমরা পাঁচতারকা হোটেলের খাবার খেয়েও সে আনন্দ পাই না। আমাদের বাচ্চাদের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য কত কসরতই না করতে হয়। তাদের বাচ্চারা একটা রঙিন বেলুন পেলেই যথেষ্ট। খেলনা পাওয়ার পর তাদের মুখে যে হাসি ফোটে সত্যিই দেখার মতো।
ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও আমরা ঘুমাতে পারি না, খাবার থাকার পরও খেতে পারি না, হাসতে বা কাঁদতে পারি না। বিনোদনের সুযোগ থাকলেও বিনোদিত হই না। ‘সুখেরই পৃথিবী/সুখেরই অভিনয়/আসলে কেউ সুখী নয়।’ তাহলে কি এই গানের কথাই ঠিক? এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক আমরা কি এ রঙ্গমঞ্চে সুখী মানুষের ভ‚মিকায় অভিনয় করে চলেছি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর।
সব শেষে একজন সুখী মানুষের গল্প। এ গল্পটা হয়তো আমরা অনেকেই জানি। ‘সুখী মানুষ’ মমতাজউদ্দীন আহমেদের একটি অনুবাদ নাটিকা। নাটিকাটির কাহিনীতে আছে, মানুষকে ঠকিয়ে, মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে, ধনী হওয়া এক মোড়লের জীবনে শান্তি নেই। চিকিৎসক বলেছেন, কোনো সুখী মানুষের জামা গায়ে দিলে মোড়লের অসুস্থতা কেটে যাবে।
কিন্তু পাঁচ গ্রামে খুঁজেও একজন সুখী মানুষ পাওয়া গেল না। শেষে একজনকে পাওয়া গেল, যে নিজের শ্রমে উপার্জিত আয় দিয়ে কোনোভাবে জীবিকানির্বাহ করে সুখে দিনাতিপাত করছে। তার কোনো সম্পদ নেই, ফলে চোরের ভয় নেই। সুতরাং শান্তিতে ঘুমানোর ব্যাপারে তার কোনো দুশ্চিন্তাও নেই। শেষ পর্যন্ত সুখী মানুষ একজন পাওয়া গেলেও দেখা গেল তার কোনো জামা নেই। সুতরাং মোড়লের সমস্যার সমাধান হলো না। আমরা তো অধিকাংশই সেই মোড়লেরই প্রতিনিধি।
সে সুখী মানুষের গায়ে জামা ছিল না। সুখী মানুষের জামা নেই। সুখী মানুষের গায়ে জামা থাকে না। সুখের রূপকাঠিটা কি রয়ে গেল গোপনে...? সম্পদই অশান্তির কারণ। সুখ একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। একজনের অনেক সম্পদ থেকেও সুখ নেই। আবার আরেকজনের কিছু না থাকলেও সে সুখী থাকতে পারে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গায়িকা রুনা লায়লার সেই বিখ্যাত গানের মতো সুখ তুমি কি বড় জানতে ইচ্ছে করে। সুখ কি আমরা সবাই জানতে চাই। সুখী মানুষকে ঈর্ষাও করি। সুখী দেশের গল্প শুনে হা-হুতোষ করতে পছন্দ করি। নষ্টালজিক হয়ে স্মৃতি রোমন্থন করি ‘অতীত দিনের’। কিন্তু আমরা আসলে অধিকাংশ মানুষই সুখী হতে চাই না। সুখের অসুখের মধ্যে সুখ খুঁজে ফিরি। মান্নাদের সেই গানের কথাই কি সত্যি। সবাই তো সুখী হতে চায়/কেউ সুখী হয় কেউ হয় না/ জানি না বলে যা লোকে সত্যি কি না?/ কপালে সবার নাকি সুখ সয় না। সব শেষে সেই পুরনো কথায়ই ফিরে যেতে হবে। Happiness contains containment (সুখ সন্তুষ্টির ওপর নির্ভর করে)। আমরা কি সন্তুষ্ট?
মাসুদ কামাল হিন্দোল : সাংবাদিক ও রম্যলেখক
[email protected]