বাংলাদেশের মতো অডিয়েন্স বিরল
শ্রীকান্ত আচার্য
🕐 ৯:৩৫ অপরাহ্ণ, মে ১৪, ২০১৮
সুরের ধারার ২৫ বছর পূর্তিতে এসেছিলেন বাংলাদেশে। বাংলা গানের প্রথিতযশা এই শিল্পী সাক্ষাৎকার দিতে গররাজি ছিলেন। পীড়াপীড়িতে সময় দেন পাক্কা আধা ঘণ্টা, কথায় কথায় যা গড়ায় দেড় ঘণ্টায়। খোলা কাগজ-এর কাছে তুলে ধরেন সুর-সংগীত ও জীবনাভিজ্ঞতার সারাৎসার। সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জগন্নাথ বিশ্বাস
(আজ তৃতীয় পর্ব)
আপনার স্ত্রী অর্ণা শীলও তো দারুণ গান লেখেন। তার লেখা বিখ্যাত গান একটা বোধ হয়... দেখেছো কি তাকে... এ গানের পেছনেও কি কোনো গল্প আছে?
অর্ণা মাঝে মাঝে লেখে। খুব বেশি যে লেখে, তা নয়। তবে ও লিখতে ভালোবাসে। বৃষ্টি পায়ে পায়ে.. গানটা বোধ হয় আগে সুর করা হয়েছিল। জয় আর অর্ণা গান নিয়ে অনেক কাজ করেছে। ওদের কথা আর সুর করা গান অনেকেই গেয়েছে। এটা বোধ হয় ২০০৩ সালের ঘটনা। জয় সুরটা করার পরে অর্ণাকে গানের কথা লিখে দেওয়ার অনুরোধ করে। কিন্তু কথা লেখার আগেই কোনো এক আড্ডায় জয় নিজের করা সুরটা শুভমিতাকে শুনিয়েছিল (বৃষ্টি পায়ে পায়ে গানটা যার কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়, সেই শুভমিতা ব্যানার্জি)। ওটা শুভমিতারও খুব পছন্দ হয়। কিন্তু জয় গানটা লোপাকে (জয় সেনগুপ্তের স্ত্রী লোপামুদ্রা মিত্র) দিয়ে গাওয়ানোর জন্য রেখে দিয়েছিল। অর্ণা গানের কথা লেখার পর যাদবপুরের এক আড্ডাতে জয়ের সামনে শুভমিতা গানটা আবার গেয়েছিল। এরপর লোপা যখন গানটা গাইতে গেল তখন ঠিক জমল না। তখন লোপাই ওটা শুভমিতাকে দিয়ে গাওয়ানোর কথা বলে। বাকিটা ইতিহাস। শুভমিতার কণ্ঠে বৃষ্টি পায়ে পায়ে হিট হওয়ার পর লোপা প্রশংসা করে বলেছিল গানটা ঠিক গলায় গাওয়া হয়েছে। আমি একটা গান গেয়েছিলাম, ১৯৯৯ সালে। জয়ের সুরে শুভ দাসগুপ্তের লেখা... তোমাকে বলার ছিল/যত আমি গান গাই/ যত গান গেয়ে যাই/সব গানে সব সুরে/তোমাকে বলার ছিল ভালোবাসি... (গেয়ে শুনিয়ে)। এ গানটা জয় ফাংশনে লোপাকে দিয়ে কয়েকবার গাওয়ানোর পর আমাকে দিয়ে রেকর্ড করায়। কারণ জয়ের মনে হয়েছিল এটা আমার গলায় বেশি ভালো লাগবে।
আপনার কণ্ঠে জনপ্রিয় হওয়া কোনো গান যখন অনুষ্ঠানে শ্রোতারা বারবার গাইতে অনুরোধ করে তখন কেমন লাগে?
অনুরোধে একটা গান কয়েকবার গাইতে আমার ভালো লাগে। লোকে তো ভালোবেসেই শুনতে চায়। আমি তাদের নিরাশ করব কেন? ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’ গানের ক্ষেত্রে এ বাংলাদেশেই একটা অনুষ্ঠানে চারবার গাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে আমার। একবার আমেরিকাতে গাইতে গিয়েও ওরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানকে বলেছিলেন, ‘নির্জন এককের গান।’ পাশ্চাত্যের গানকে বলেছিলেন ‘স্বজন লোকালয়ের’। আপনি যখন বহু শ্রোতার সামনে মঞ্চে নির্জন এককের গান শোনান তখন নিজেকে প্রস্তুত করেন কীভাবে?
আমরা মঞ্চে তো আর পশ্চিমা গান গাই না। বাংলা গান গাই। বাংলা গানের একটা নিজস্ব চরিত্র আছে। দর্শনগতভাবে যা পাশ্চাত্য গানের সঙ্গে মেলে না। আমি যখন মঞ্চে গান গাই, তখন শ্রোতাকে আমার বৃত্তের ভেতরে আনার চেষ্টা করি। অর্থাৎ আমি যদি নির্জন এককের গান গাই, শ্রোতার মনটাকেও নির্জনে আনার চেষ্টা করব। সব সময় শ্রোতার সস্তা চাওয়ার কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়ায় আমি বিশ্বাসী নই। এর মানে এই নয় যে, আমি শ্রোতার চাওয়াতে বিশ্বাস করি না। আমার লক্ষ্য থাকে শ্রোতাকে নিজের গানের কাছে আনার। শ্রোতা আমাকে যেখানে নিতে চায় আমি সেখানে যাব না। শ্রোতার অনুরোধ থাকতে পারে। তা আমি রক্ষাও করতে পারি। কিন্তু সেটা আমার বৃত্তে টেনে আনার পর। আমার গানের যে মেজাজ তা যদি নির্জন এককের কোণ হয় আমি শ্রোতাকে সেখানে নিয়ে আসব। এটা ভিড়ের মধ্যেও হতে পারে। আমার চেষ্টা থাকবে ভিড়ের মধ্যে থেকেও শ্রোতা যেন একা বোধ করে। যেন তার মনে হয়, আমি গাইছি আর সে একা শুনছে। যেন মনে মনে ভাবতে পারে, আমি কেবল তার জন্যই গাইছি।
মঞ্চে গাইতে গিয়ে কখনো হতাশ হননি?
হয়েছি তো, সব জায়গায় অডিয়েন্সের প্রত্যাশা তো এক রকম থাকে না। আমার মন আর অডিয়েন্সের মন মেলেনি। এমনটা অনেকবার হয়েছে। কখনো এমনটাও হয়েছে, আমার মেজাজ-মর্জি ভালো নেই। কিন্তু অডিয়েন্স এত চমৎকার, গান গাইতে গিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। কখনো আবার অডিয়েন্স এত মিক্সড থাকে, শ্রোতার মেজাজটাই ধরা যায় না। কী গান গাইলে কে খুশি হবে এ দোলাচলের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যায়। কিছুটা অসহায়ও লাগে। কিন্তু এ জন্যও প্রস্তুত থাকতে হয়।
বাংলাদেশের অডিয়েন্স সম্পর্কে শিল্পী শ্রীকান্তের অভিজ্ঞতা কেমন?
এখানে গান গাইতে এসেই আমি সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ অডিয়েন্স পেয়েছি। বাংলাদেশের মঞ্চেই বোধ হয়, সবচেয়ে বেশিবার দীর্ঘসময় গান গেয়েছি। ঢাকা ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে তো টানা প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা গান গেয়েছিলাম। পৃথিবীর কোথাও আমি এত দীর্ঘসময় টানা গান করিনি। এ ছাড়া টানা আড়াই-তিন ঘণ্টা অনুষ্ঠান বাংলাদেশে অনেকবার করেছি। শ্রোতার আগ্রহের জন্যই এটা সম্ভব। বছর দেড়েক আগে সিলেটে বেঙ্গলের একটা অনুষ্ঠানে এসেছিলাম। আমাদের লিটু ভাই (বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু) অনুষ্ঠানটা আয়োজন করেছিলেন। প্রায় ২৫ হাজার শ্রোতার সামনে গান গেয়েছিলাম, সে এক অভিজ্ঞতা বটে। জীবনে কোনো দিন এত শ্রোতার সামনে গাইনি। এত উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম যে, কী বলব। এত মানুষ আর কী সুশৃঙ্খলভাবে তারা গান শুনছিল। সত্যিই মনে রাখার মতো। ওখানে গাইতে পেরেছিলাম বলে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এমন বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা আমার বাংলাদেশেই ঘটেছিল।
এবার ঢাকার বিক্রমপুরের গল্প শুনব। আপনার পূর্বপুরুষরা তো বিক্রমপুরের মানুষ। দেশভাগের আগে চলে গিয়েছিলেন। মায়ের মুখে বিক্রমপুরের কথা কি শুনেছেন?
বিক্রমপুর সম্পর্কে যা জানি, তা মায়ের মুখেই শোনা। আমার মায়ের বাল্যকাল কেটেছিল বিক্রমপুরের শ্যামসিদ্ধি গ্রামে। আমার দাদু মানে, মায়ের বাবা কলকাতা চলে গিয়েছিলেন ১৯৪৩-১৯৪৪ সালের দিকে। মায়ের চেয়ে অবশ্য আমার ঠাকুমাই শ্যামসিদ্ধির গল্প বেশি করতেন। ছোটবেলায় শুনেছি, বর্ষায় শ্যামসিদ্ধি গ্রাম জলে ভাসত। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে নৌকায় যেতে হতো। এটা শুনে আমি অভিভূত হতাম। শুনেছি, গ্রামটা এখনো আছে। মাকে নিয়ে একবার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মা হাঁটুর সমস্যায় চলতে পারেন না। তাই আর যাওয়াও হয়নি।
এ সময়ের হাতেগোনা কিছু বাংলা গান ছাড়া গড়পড়তা বাংলা গান শুনে কি আপনার হতাশ লাগে?
একটা সহজ সত্যি কথা মেনে নেওয়া দরকার। আগে যত বাংলা গান তৈরি হতো সে তুলনায় এখন কিন্তু অনেক বেশি বাংলা গান তৈরি হয়। এখন গানের সংখ্যা অসম্ভব বেড়ে গেছে। আর এ সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে গড়পড়তা গানও বেড়েছে। ভালো গান, সত্যিকার অর্থেই ভালো গান আগেও কম তৈরি হতো, এখনো কমই হয়। আগে গড়পড়তা গান কম তৈরি হতো এখন বাজে বা গড়পড়তা গান বেশি হয়।
গানের সংখ্যাবৃদ্ধি এর মানকে নামিয়ে দিচ্ছে। এখন অনেক বেশি গানের ভেতর থেকে একটা ভালো গান খুঁজে বের করতে হয়। আগে হয়তো একশটা গানের ভেতর থেকে ভালো গান খুঁজতাম এখন ১০ হাজার গানের ভেতর থেকে ভালো গান খুঁজি। এর ফলে আমার বা আপনার মনে হচ্ছে, এখন বোধ হয় ভালো গানের সংখ্যা কমে গেছে। আসলে ভালো গান আগেও কমই ছিল। রাশি রাশি ভালো গান কোনো দিনই হয় না। এখন তো বাজে গানের ভিড়ে ভালো গান খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। হয়তো ২০ বছর পরে হঠাৎ একটা ভালো গান শুনে মনে হবে আরে এটা তো শুনিনি। তাই একটু কম গান তৈরি হলে ভালো হয়। তাহলে মানের দিকে নজর দেওয়া যেত। এখন বড্ড বেশি গান হচ্ছে।
(আগামীকাল শেষ পর্ব )