ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

চরিত্রহীনতার প্রতিযোগিতা

মোস্তফা কামাল
🕐 ৯:৪৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৬, ২০১৮

ভিন্নমত বা প্রতিপক্ষকে অপদস্থ-অপমান করা স্মার্টনেসের বিষয় হতে বসেছে। তা বিশেষভাবে পাকাপোক্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে রাজনীতির ময়দানে। অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও হেয় করতে গিয়ে যে যা পারছেন করছেন। সময়ের স্রোতে রাজনীতির বাইরেও তা এখন ভাইরাসের মতো সংক্রমিত। জাতির মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর শিক্ষক, জাতির বিবেক সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী কেউই বাদ যাচ্ছেন না।

ব্যাধি বা ভাইরাসের বদলে তা এগুচ্ছে গুণ-বৈশিষ্ট্য হিসেবে রূপ পাওয়ার দিকে। সাধ্যমতো এ চেষ্টায় কেউ পিছিয়ে থাকতে চাচ্ছেন না। এ ধরনের প্রতিযোগিতাকে আমাদের কুমিল্লার স্থানীয় ভাষায় সম্বোধন করা হয় গোছ ল্যাংটি, উদাম দৌড়, ন্যাংটা দৌড় ইত্যাদি নামে।
আগে কত ভালো ছিল বলে হা-পিত্যেস থাকলেও রাজনীতি কখনো একদম বিভাজনমুক্ত ছিল? রাজনীতিতে মিলমিশের কিছু গল্প বা মিথ থাকলেও বিভাজনমুক্ত রাজনীতির তেমন তথ্যসাবুদ মেলে না। রাজনীতি কোনোকালে সরলরেখায় ছিল-এই নজিরও নেই। এরপরও ভেতরের ক্ষোভ-ক্ষত, বেদনা, অপ্রাপ্তি জিইয়ে রেখে রাজনীতিকদের মধ্যে কিছু কিছু ঘটনায় ওপরে ওপরে সৌজন্যতার অভিনয়ের চর্চা মানুষ দেখেছে।
এক নেতার বাড়িতে আরেক নেতার খানাপিনা, ফল-ফলাদি পাঠানো, জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার কিচ্ছা-কাহিনীও রয়েছে। যদিও বলা হয়ে থাকে, এগুলোও রাজনীতির মতলবযুক্ত। অনেকে বলে থাকেন, দেশে বিভেদ না থাকলে রাজনীতিকদের ভ্যালু কমে যায়। এরপরও চক্ষুলজ্জার খাতিরে শিষ্টাচারের কিছু বিষয়-আশয় রয়েছে। আর শিষ্টাচারের বাহ্যিক প্রকাশ ভাষায়। নইলে মানুষ রাজনীতিকদের গাল-মন্দ আরেকটু বেশি দিতে পারে। এখন আর সেই ভয়টাও নেই। বরং সেটা এখন বাড়তি যোগ্যতা-দক্ষতার বিষয়ে পরিণত হতে বসেছে।
খুচরা বা আঁতিপাঁতি বাদ দিলেও দল, রাষ্ট্র, সরকার, প্রতিষ্ঠানের উঁচু পর্যায় থেকে যে মানের শব্দ-বাক্যবিনিময় হচ্ছে তা সুস্থ-বিবেকমান যে কারও জন্যই উদ্বেগের। নিদারুণ কষ্টের। কিন্তু তাতে রাজনীতিকদের মান-সম্মানে আঁচড় পড়ে না। চোর, সুদখোর-ঘুষখোর, বেয়াদব, মাতাল-পাগল, চালচুলাহীন, ছাল-বাকলা, রাবিস-খবিস ধরনের শব্দে আহত হওয়ারও যেন উপায় নেই। এগুলো এখন রাজনীতিতে নিত্যব্যবহৃত শব্দ। রাজনীতির বাইরেও বেশ চলছে। পরস্পরকে গাল-মন্দের এ প্রতিযোগিতায় কে চ্যাম্পিয়ন, কে রানার্সআপ তা নির্বাচন করাও কঠিন। এ জাজমেন্ট করতে গেলে সবাইকে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন করা ছাড়া বিকল্প পাওয়া কঠিন। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে চরিত্রহীন বলে মন্তব্যের জের ধরে গাল-মন্দের যেন নতুন আসর বসেছে।
বিষয়টিকে রাজনীতির একমাত্র এবং প্রধান ইস্যু করার চেষ্টাও লক্ষণীয়। ব্যারিস্টার মইনুল রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত না হয়েও ড. কামাল হোসেনের রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে শরিক হওয়ায় ঘটনাটি রাজনীতিতে বিশেষ মাত্রা পেয়ে থাকতে পারে। প্রকাশ্য সভা-সমাবেশে গত কদিন ধরে উচ্চারিত কদাকার শব্দ-বক্তব্যের প্রতিযোগিতায় নেতানেত্রীদের ব্যক্তিগত চরিত্রও প্রকাশ পাচ্ছে। কখনো একজন-আরেকজনের, কখনো নিজেই নিজের চরিত্রের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। ইট মেরে পাটকেল খাওয়ার ঘটনাও কম ঘটছে না। রেহাই মিলছে না স্ত্রী-সন্তানসহ স্বজনদেরও। একদিক থেকে বলা হচ্ছে, ড. কামালের মেয়ের স্বামী বিদেশি। আরেকদিক থেকে প্রশ্ন আসছে, প্রধানমন্ত্রীর ছেলের স্ত্রী কি দেশি?
এ ধরনের শিষ্টাচারবহির্ভূত মন্তব্যে রাজনীতিকদের নিজেদের চরিত্রের যে প্রকাশ ঘটছে তার জের কোথায় গিয়ে ঠেকবে বলা মুশকিল। এসবের মধ্য দিয়ে কিছু সত্যের প্রকাশ ঘটছে। আবার সত্যের সতীত্ব নিয়ে টানও পড়ছে। নারী সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টির চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের চরিত্র, সততা ও অতীত কর্মকাণ্ড নতুন করে আলোচনায়। ওয়ান ইলেভেন সরকারের এই উপদেষ্টার তখনকার ভূমিকা, আচরণ, কথাবার্তাগুলো মানুষের আপনা আপনিই মনে পড়ছে। রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ীদের তাচ্ছিল্য করে এক ধরনের তৃপ্তি পেতেন তিনি। ওই তৃপ্তি লুকাতেন না। ঢেঁকুর দেওয়ার মতো সহাস্য ভঙ্গি করতেন। ভঙ্গির সঙ্গে বিশেষ একটা ভাবও নিতেন। তার সমালোচনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী চলে গেছেন আরেকদিকে। বলেছেন, মইনুল একাত্তরে পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। কী বলতে গিয়ে কী বলা হলো?
আওয়ামী লীগের খাসলোক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার এই পাকিস্তানপন্থী ছেলেকে শেখ হাসিনার পিতা বঙ্গবন্ধু কেন দলে এনে এমপি করেছিলেন-সেই প্রশ্ন তো এসে যাচ্ছে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে অভ্যস্ত এই ব্যক্তিই এখন ঘটনাচক্রে অপদস্থের শিকার হওয়ায় অনেকে আনন্দিতও বটে। পুলিশ হেফাজতে, কোর্টে, কারাগারে তিনি কেমন এবং কোনমাত্রায় নাস্তানাবুদ হচ্ছেন-তা জানতে আগ্রহীর সংখ্যা অনেক। তাদের কাছে এটি আনন্দ, স্বস্তি ও তৃপ্তিদায়ক বিষয়। অন্যের চরিত্র হনন করতে গিয়ে নিজেদের চরিত্রও যে অবশিষ্ট থাকছে না-তা দেখা বা ভাবার সময়ও যেন নেই। কে ময়লামুক্ত, কে গন্ধযুক্ত-এ প্রশ্নের কুলকিনারা মিলছে না।
এর মাঝে আবার সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টির চরিত্র প্রকাশের দায়িত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে আরেক আলোচিত চরিত্রবান দেশান্তরি লেখিকা তসলিমা নাসরিন। তার ভাষায় মাসুদা ভাট্টি ভীষণ রকম চরিত্রহীনা মহিলা। বাংলাদেশি মাসুদার পাকিস্তানি ছাড়াছাড়ি হওয়া স্বামীর নামের একাংশ ভাট্টি এখনো ব্যবহার, এর পূর্বাপরের জীবনাচরণ কিছুই বাদ দেননি তসলিমা। তিনি মাসুদা সম্পর্কে লেখা বা উচ্চারণের অযোগ্য প্রচুর শব্দও ব্যবহার করেছেন। মাসুদা ভাট্টির পক্ষ নিয়ে বিবৃতি দেওয়া লেখক-বুদ্ধিজীবীদেরও এক হাত নিয়েছেন তসলিমা নাসরিন।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, আজ দেশের ৫৫ জন বিশিষ্ট সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টির পক্ষে লড়ছেন। কারণ কেউ তাকে চরিত্রহীন বলেছে। যত অশ্লীল শব্দ বাক্য পৃথিবীতে আছে, তার সবই আমার বিরুদ্ধে উচ্চারিত হচ্ছে আশির দশক থেকে। আমি তো জনপ্রিয় কলামিস্ট ছিলাম তখন, জনপ্রিয় লেখক ছিলাম, কই কোনো বিশিষ্ট সম্পাদক আর কোনো সিনিয়র সাংবাদিককে তো আমার বিরুদ্ধে হওয়া লাগাতার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করতে কোনো দিন দেখিনি!
মাসুদা ভাট্টি আবার তার আত্মপক্ষ পোক্ত করতে গিয়ে বলতে চেয়েছেন, পাকিস্তানিদের তিনি চরম ঘৃণা করেন। অবিশ্বাসও করেন। তবে প্রেমিক ও স্বামী হিসেবে তারা অসাধারণ ও চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। বেশ রসালো আলোচনার খোরাক হয়েছে তার এ বক্তব্য। কে কাকে ঠেকায়? প্রশ্ন উঠেছে-চরিত্র ও আত্মমর্যাদা থাকলে, পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণার বদলে দরদ না থাকলে কেউ পাকিস্তানি বিয়ে করে? পাকিস্তানি নাগরিকের সাবেক স্ত্রী, ডিভোর্সের পরও পাকি স্বামীর পদবি ব্যবহারকারী কীভাবে ৭১ টিভির প্রোগ্রামে দাওয়াত পান-এমন প্রশ্নও বাদ পড়ছে না। একাত্তর টিভি বা মাসুদা ভাট্টির ভেতরে ভেতরে পাকিস্তান এবং জামায়াত কানেকশন রয়েছে কি না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমনতর কথাবার্তাও এসেছে। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচার-প্রকাশনায় নির্ভর বা ভরসা কম করাই ভালো। এটি দায়দায়িত্বহীন মাধ্যম। কিন্তু দায়িত্ববান-সম্ভ্রান্ত অনেকেই যখন এই মাধ্যমে হুমড়ি খান, নানা পোস্ট-ছবি, ব্যঙ্গচিত্র দেন; তখন কি আর সেটিকে হালকা মনে করা যায়?
এমন বাহাসে চরিত্রের বাজারে রীতিমতো আউলা-ঝাউলা দশা। হাস্যকর-তামাশার বিষয়ও করে ফেলা হয়েছে ঘটনাটি। দুই-এক নারীর সূত্র ধরে গোটা নারী সমাজকেও অসম্মানের কাতারে ঠেলে আনা হয়েছে। এক রম্য লেখক প্রশ্ন তুলেছেন নারীর সম্মানের দাম কি মাথাপিছু মাত্র ৫৩ টাকা ৩৩ পয়সা? তার ব্যাখ্যা হচ্ছে, পৃথিবীতে নারীর সংখ্যা ৩৭৫ কোটি। সমগ্র নারী জাতির মর্যাদাহানি করায় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে ২০ হাজার কোটি টাকা মানহানির মামলা করেছেন জামালপুরের যুব মহিলা লীগের এক নেত্রী। অর্থাৎ, নারীর সম্মানের মূল্য মাথাপিছু (২০ হাজার কোটি টাকা : ৩৭৫ কোটি নারী) = ৫৩ টাকা ৩৩ পয়সা মাত্র।
মইনুল আর মাসুদা দুই জগতের মানুষ। একজন বিখ্যাত মানুষের সন্তান ও ওপরতলার মানুষ। আরেকজন সাধারণ পরিবারের সাধারণ মানুষ এবং লেখক। তাদের হজমি শক্তি অনেক। তাদের কাছে চরিত্র ও চরিত্রহীনতার ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে। সেই কারণে তাদের চরিত্রে হয়তো শেষমেশ ফুলের টোকাও পড়বে না। রাজনীতিকদের শেষ পর্যন্ত চরিত্রের ব্যস-ব্যাসার্ধ শুধু ঠিকই থাকে না। আরও তাজা হয়। গাল-মন্দ ও চরিত্র হননের ফলে তাদের শান-মান আরও বাড়ে। সময়দৃষ্টে তারা সুদাসলে তা পুষিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু বাদবাকিদের? চরিত্রের বাহাদুরির আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে গা ভাসিয়ে নৈতিক মূল্যবোধ, সততা, পেশাদারিত্ব হারিয়ে যারা নিজের ওজনও শেষ করে ফেলছি?

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
[email protected]

 
Electronic Paper