ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কাজী আনোয়ার হোসেন ও ‘মাসুদ রানা’

আফরোজা পারভীন
🕐 ৪:১৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৩, ২০২২

কাজী আনোয়ার হোসেন ও ‘মাসুদ রানা’

আমাদের শৈশব-কৈশোর ছিল মাসুদ রানাময়। প্রগতি প্রকাশনীর রঙ-বেরঙের বইগুলো পড়তে পড়তে যখন বেড়ে উঠছি তখন দেখতাম মা অজস্র কাজের ভিড়ে মরুতীর্থ হিংলাজ, মহাপ্রস্থানের পথে, পথের পাঁচালীর সঙ্গে দস্যু বনহুর, দস্যু বাহরাম, কিরীটি রায় পড়েন। দয়ালু দস্যু মোহনের প্রেমে পড়ে মা তার নিজের ছেলের নাম রাখলেন মোহন। কোনো মা যে তার ছেলের নাম দস্যুর নামে রাখতে পারে এ ঘটনা নিজ পরিবারে না ঘটলে বিশ্বাস করতাম না। তাহলেই বুঝুন কেমন ছিল সে দস্যু! পাঠকের হৃদয়ের কোথায় অবস্থান নিয়েছিল সে। মা নিজে অনেকবার এক গল্প আমাকে বলেছেন। আর এও বলেছেন, ছেলে মোহনের জন্য রমা নামের একটা মেয়েকে বউ করে আনবেন। কারণ দস্যু মোহনের স্ত্রীর নাম ছিল রমা। মুগ্ধতা আর কাকে বলে! একটু বড় হয়ে দেখলাম দাদারা লুকিয়ে লুকিয়ে লাল মলাটের বই পড়ে। দু’চারবার আমিও লুকিয়ে সে বই পড়লাম। কিন্তু মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। শুধু এটুকু বুঝলাম শ্রেণিশোষণ বলে একটা জিনিস আছে, সম্পদের অসম বণ্টন বলে একটা বিশ্রী ব্যাপার আছে। এসবের অবসান হওয়া দরকার। তবে ও বই আমাকে টানল না। আমি তখন ছোট। ওসব ভারি ভারি কথা কি মাথায় ঢোকে! এইসময় একদিন হাতে এলো মাসুদ রানা। দু’দাদার হাতে হাতে ঘুরতে লাগল। একটা যায় একটা আসে। একদিন দেখতে চাইলে দিল না। বলল, এগুলো বড়দের বই। ব্যস, আকাক্সক্ষা উদগ্র হলো। এমনিতে আমাদের বাড়িতে পড়াশোনার অবারিত সুযোগ ছিল। গল্পের বই পড়াকে কখনো বাজে পড়া বা অহেতুক সময় নষ্ট মনে করা হতো না। তার মাঝে এই বিধিনিষেধ। তাহলে কী আছে ওই বইতে!

যত মুশকিল তত আসান। একদিন ঠিকই সে বই হাতে এলো। আর আমি হা করে প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বলিষ্ঠ এক যুবক, তামাটে রং, শক্ত চোয়াল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। বই পড়তে শুরু করলাম। আর কিছুক্ষণের মধ্যে মগ্ন হয়ে গেলাম। দুঃসাহসী এক অভিযানে নেমেছে বাংলাদেশি এক গুপ্তচর। কী তার মেধা, কী তার বুদ্ধি, কী প্রাখর্য সে বুদ্ধির! অল্পক্ষণের মধ্যেই যেন ভোজবাজির মতো সমাধান করে ফেলল রহস্যের। একটানে পড়ে বই শেষ করলাম। তারপর শুরু হলো লুকিয়ে মাসুদ রানা পড়া। নড়াইল ছেড়ে যশোরে পড়তে এসে কিনতে শুরু করলাম রিকশাভাড়া বাঁচিয়ে। কোথায় যায় না এই দুঃসাহসী যুবক! পাহাড় বন্দর মরুভূমি এদেশ সেদেশ সর্বত্র। দেশি-বিদেশি সব লোক সাহায্য নেয় তার, তার প্রতিভার। এ যেন আরেক জেমস বন্ড, বাংলাদেশি জেমস বন্ড। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা যখন তোপসেকে নিয়ে গুপ্তধনের সন্তানে কোনো বনেদি বাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুরছে, মাসুদ রানা তখন দেশের কোনো জাতীয় সমস্যা সমাধানে প্রাণবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুঃসাহসী অভিযানে।

সবার যেমন সঙ্গী লাগে, টিম লাগে, মাসুদ রানারও আছে। আছে সোহানা। প্রতিবার অভিযান জয়ের পর বা জয়ের মাঝখানে কোনো একান্ত বা টানটান মুহূর্তে ওরা কাছে আসে। কিন্তু না, বাঁধনে জড়ায় না। মাসুদ রানা কাছে টানে কিন্তু বাঁধনে বাঁধে না। এটাই বৈশিষ্ট্য। মাসুদ রানা এক কাল্পনিক চরিত্র, রহস্যাবৃৃত চরিত্র। রহস্য সবসময় উত্তেজক, আনন্দদায়ক। এ দেশের অসংখ্য নারীর জীবনের প্রথম নায়ক মাসুদ রানা। চলচ্চিত্রের নায়কদের নারীদর্শক নায়ক ভাবতে বাধা পায়। কারণ তাদের সঙ্গে নায়িকা থাকে। গল্প উপন্যাসেও নায়িকার উপস্থিতির কারণে মেয়েরা তাদের জীবনের নায়ক ভাবতে পারে না। কিন্তু মাসুদ রানা, তার জীবনে সোহানা থাকলেও সে যেন তার নায়িকা নয়, বন্ধু, সঙ্গী, সহঅভিযাত্রী। তাই মাসুদ রানাকে জীবনের নায়ক ভেবে কত নারী পার করেছে রাতের পর রাত। তিন গোয়েন্দা আর এক ঘোরে নিয়ে গেছে আমাকে, আমাদের।

গোয়েন্দারা চলেছে, আমরা চলেছি। ওদের যাত্রা শেষ হয়েছে। ওদের সঙ্গে নতুন যাত্রায় শামিল হয়েছি আমরা, পাঠকরা।
এই জনপ্রিয় মাসুদ রানা ধারাবাহিকের স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন। সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার তিনি। ষাটের দশকের মধ্যভাগে মাসুদ রানা নামের গুপ্তচর চরিত্রটি সৃষ্টি করেন। এই সিরিজের প্রথম বই ‘ধ্বংস পাহাড়’। সেই গ্রন্থটি থেকে শুরু করে মাসুদ রানা সিরিজে এই চরিত্রকে কেন্দ্র করে চার শতাধিক গুপ্তচরবৃত্তীয় কাহিনির বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো তুমুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। সিরিজের প্রথম দুটি বই মৌলিক। বাকি বইগুলো ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের ভাবানুবাদ বা ছায়া অবলম্বনে রচিত হয়েছে। মাসুদ রানার চরিত্রটি ইয়ান ফ্লেমিং রচিত জেমস বন্ড চরিত্রটি অনুসরণে সৃষ্ট। শুধু মাসুদ রানা নয়, এর আগে কুয়াশা সিরিজের কুয়াশা-১-এর মাধ্যমে লেখালেখির জগতে পা রাখেন তিনি। ‘কুয়াশা’ নামের চরিত্রটিও ছিল ভীষণ জনপ্রিয়। বিদেশি গল্পের ছায়া অনুবাদ বা ভাব অবলম্বনে রচিত বই ছাড়াও কাজী আনোয়ার হোসেনের মৌলিক রচনা অনবদ্য। হাত লেখা সাবলীল গতিময় ও স্বাদু। তার ভাষাশৈলী অসাধারণ। মৌলিক রচনাগুলোও চমকপ্রদ।

কাজী আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই ঢাকায়। পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম ‘নবাব’। পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মাতা সাজেদা খাতুন। তিন বোন সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন এখনো রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

১৯৫২ সালে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ এবং বিএ পাস করেন তিনি। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন।

কী নন তিনি, কী পারেন না তিনি! পড়াশোনা শেষ করে রেডিওতে নিয়মিত গান গাইতে শুরু করেন। প্রশিক্ষণ ছিল না, কিন্তু বাড়িতে গানের চর্চা সবসময় ছিল। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারের সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। কিন্তু বেশিদিন গান গাওয়া অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭ সালে রেডিও কিংবা টিভিতে গান গাওয়া এবং সিনেমার প্লেব্যাক করা ছেড়ে দেন কাজী আনোয়ার হোসেন। বাবার দেওয়া দশ হাজার টাকা দিয়ে ১৯৬৩ সালের মে মাসে সেগুনবাগিচায় প্রেসের যাত্রা শুরু করেন। আট হাজার টাকা দিয়ে কেনেন একটি ট্রেডল মেশিন। বাকি টাকা দিয়ে টাইপপত্র। দুজন কর্মচারী নিয়ে সেগুনবাগান প্রেসের শুরু। পরে যার নাম বদলে হয় সেবা প্রকাশনী। এই প্রকাশনী বাংলাদেশে পেপারব্যাক গ্রন্থ প্রকাশ, বিশ্ব সাহিত্যের প্রখ্যাত উপন্যাসের অনুবাদ এবং কিশোর সাহিত্যের অনুবাদ পাঠকের সামনে তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

১৯৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রহস্যপত্রিকা প্রকাশ করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। নানান কারণে কিছুদিন পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ থাকার পর ১৯৮৪ সাল থেকে রহস্যপত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।

১৯৭৪ সালে মাসুদ রানার কাহিনি নিয়ে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। বাংলাদেশের টিভিতে প্রথম প্যাকেজ নাটক ‘প্রাচীর পেরিয়ে’ নির্মিত হয় কাজী আনোয়ার হোসেন রচিত মাসুদ রানা সিরিজের ‘পিশাচ দ্বীপ’ বই থেকে। ১৯৯৪ সালে নির্মিত ও প্রচারিত নাটক প্রাচীর পেরিয়ের নির্দেশক ছিলেন আতিকুল হক চৌধুরী।

কাজী আনোয়ার হোসেন ড. কাজী মোতাহার হোসেনের পুত্র, সন্জীদা খাতুনের ভাই। কী নন তিনি! লেখক গায়ক নির্দেশক সম্পাদক প্রকাশক। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতাম, কাজী আনোয়ার হোসেন তো কত কিছু করতে পারতেন, কত কিছু ভাবতে পারতেন। কিন্তু তিনি কেন মাসুদ রানা আর রহস্য সিরিজগুলোতে মগ্ন হয়ে রইলেন! তারপর একসময় মনে হলো একটা গোটা দেশের অগণিত ছেলে-মেয়ের শৈশব কৈশোরকে ঘোরবন্দি করতে পেরেছেন তিনি। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে! বাবার গণিতের মাথা, নিজের সাহিত্যজ্ঞান আর মেধা কাজে লাগিয়েছেন তিনি মাসুদ রানা রচনায়। বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা বলে অভিযোগ উঠেছে, অভিযোগ উঠেছে গ্রন্থস্বত্ব নিয়ে।

বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখাতে অপরাধের কিছু নেই। আর গ্রন্থস্বত্বের ব্যাপারে তিনি তেমন মুখ খোলেননি। বরাবরই আড়ালচারী ছিলেন। হয়তো বেঁচে থাকলে কোনো একটি গ্রন্থে মাসুদ রানাই সমাধান করে দিত এই গ্রন্থস্বত্বের! সমালোচনা ছিল তিনি মাসুদ রানা সিরিজে যৌনতা ঢেলে দিয়েছেন। এই রব এতটাই তোলা হয়েছিল যে ‘প্রজাপতি’ মার্কাওয়ালা বই পড়া নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল বাঙালির ঘরে। কিন্তু তারপরও মাসুদ রানা পড়া ঠেকানো যায়নি। যাবে না। মাসুদ রানাতে এমন কিছু আছে যার সন্ধানে বাঙালি কিশোর যুবক যুবতী এ বই পড়বেই। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর একবার ব্রেইন স্ট্রোক ও হার্টঅ্যাটাক হয়। ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ৮৫ বছর বয়সে।

পেয়েছেন বাচসাস পুরস্কার, জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সিনেমা পত্রিকা পুরস্কার। কিন্তু পাওয়ার কথা ছিল আরও বড় স্বীকৃতি।
কাজী আনোয়ার হোসেন, আমাদের কাজীদা দৃশ্যত চলে গেছেন। কিন্তু বেঁচে আছে মাসুদ রানা। মাসুদ রানার বেঁচে থাকা মানে কাজীদার বেঁচে থাকা। তিনি বেঁচে আছেন, থাকবেন।

আফরোজা পারভীন : কথাশিল্পী, গবেষক ও কলাম লেখক

 
Electronic Paper