কত সময়ে শেয়ারবাজার প্রতিষ্ঠিত হবে
মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম
🕐 ৪:০৯ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২২, ২০২২
কোভিড ১৯-এর অভিঘাত মোকাবিলা করে পুরো বিশ্ব যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই করোনার নতুন সংস্করণ ওমিক্রন জনমনে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের ভয় সঞ্চার করছে। জানান দিচ্ছে, করোনার নেতিবাচকতা নিয়ে উপসংহার টানার সময় এখনো আসেনি এবং হুঁশিয়ারি দিচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সময় এখন নয়। যারা খেলছে, সেই সব খেলোয়াড়দের মুখোশ উন্মোচন করাই ওমিক্রনের কাজ। ভয়াবহ করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন ডেলটার দাপট বিশ্ববাসীর মনে এখনো দগদগে। এর ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই গত ২৪ নভেম্বর আফ্রিকার বতসোয়ানায় প্রথম ধরা পড়ে এই নতুন ধরন ওমিক্রন। যা ক্রমেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী।
বাংলাদেশসহ প্রায় দুই শ’র মতো দেশে ওমিক্রন সংক্রমণের বিস্তার ঘটেছে। এ তালিকায় প্রতিদিনই নতুন নতুন দেশ যুক্ত হচ্ছে। এ জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ইউরোপের অনেক দেশ লকডাউনসহ কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। ফলে সবকিছুই এখন উলটে-পালটে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে আবার দেখা দিতে পারে স্থবিরতা। করোনার বিধি-নিষেধ মানেই অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব। ২০২২ সালে কি আবার ২০২০ সালের পরিস্থিতি ফিরে আসবেÑ এটাই এখন সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয়। এই মুহূর্তে বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বোঝা মুশকিল। আর সেই আশঙ্কার পাল্লা ক্রমেই ভারী হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের মনে। বিশেষ করে বিশ্বের অর্থনীতিতে মোড়ল দেশগুলোয় শেয়ারবাজারের পতন হয়েছে। তা থেকেই বোঝা যায় বিনিয়োগকারীদের মনের অবস্থা। গত ১৭ ডিসেম্বর বিশ্বের অর্থনীতির চালিকাশক্তি মার্কিন শেয়ারবাজারে এর আগের তিন সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে বড় দরপতন হয়। ওইদিন ৫৩২ পয়েন্ট বা দেড় শতাংশ কমে যায় দেশটির শেয়ারবাজারের সূচক। ইউরোপের বড় বড় শেয়ারবাজারেও দরপতন হয়েছে প্রায় এক শতাংশ। এশিয়ার বেশির ভাগ শেয়ারবাজারের একই হাল। বড় দরপতন হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে তেমন প্রভাব পড়বে না- এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ক্রিসমাস ডে-র রপ্তানি বহু আগেই শেষ হয়েছে। উইন্টারের শিপমেন্টও প্রায় শেষ। এখনো কিছু অর্ডার আসছে। কোভিডের প্রভাব কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের অর্থনীতি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পূর্বাভাসেও এই ইঙ্গিত মিলছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াতে পারে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের জন্য রয়েছে আরও সুখবর।
সংস্থাটি বলছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৭ দশমিক ১ শতাংশ। সামগ্রিক অর্থনীতিতে সুখবর থাকলেও শেয়ারবাজার যেন এ কথা মানতে নারাজ। শেয়ারবাজার বড় ধরনের পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত এপ্রিল থেকে টানা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাজার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এরপর শুরু হয় দরপতন। যা এখনো বহাল রয়েছে এবং এটিকে অনেকে স্বাভাবিক মূল্য সংশোধন বলে থাকেন। বিনিয়োগকারীরাও আশা করেন, এটি যেন মূল্য সংশোধন পর্যায়ই থাকে। আমাদের শেয়ারবাজারের বিগত ইতিহাস ভালো নয়। বারবার দেখা গেছে, বাজার এভাবেই পতনে রূপ নেয়। মূল্য সংশোধন যেন থামতেই চায় না। হঠাৎ বড় উত্থান হচ্ছে তো পরের দিন বড় পতন। তবে সম্প্রতি পতনটা বেশি হচ্ছে। বাজার কোনদিকে যায়, সেদিকেই এখন নজর বড় বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের। তারা শেয়ার কেনাবেচায় সতর্কতার আড়ালে বলা যায় একেবারে নিষ্ক্রিয়। তাই তো লেনদেন বহু কাক্সিক্ষত ৫-১০ হাজার কোটি টাকার পরিবর্তে খুঁজে বেড়াতে হয় ৮-৯ মাস আগেরকার ইতিহাসের পাতায়। গত ১৬ আগস্ট বাজারে লেনদেন হয় ২ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা।
আর ডিসেম্বরে এসে সেখানে লেনদেন হয় ৬০০-৭০০ কোটি টাকা। আবার এটিও প্রকৃত লেনদেন কিনা, সেটি নিয়েও বাজার-সংশ্লিষ্টরা সন্দিহান। ধারণা করা হয়, কারসাজি চক্র নিজেদের মধ্যে শেয়ার কেনাবেচা করে লেনদেন বাড়িয়ে রেখেছে। এখনকার লেনদেনের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হচ্ছে গুটিকয় ব্যক্তি ও তাদের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে। যেসব নি¤œমানের স্বল্প মূলধনী কোম্পানি লেনদেনের শীর্ষে থাকছে, তাতে স্পষ্টতই বোঝা যায়, কারসাজি চক্র সক্রিয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতে, সবকিছুই স্বাভাবিক গতিতে চলছে। ডিসেম্বরে এসে নাকি বাজার এরকমই হয়। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। আমাদের শেয়ারবাজারের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো এটি সম্পূর্ণ ইক্যুইটিভিত্তিক। এই একটি মাত্র উপাদান দিয়ে শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা আশা করা যায় না। এটিকে নতুন নতুন প্রডাক্ট দিয়ে বড় করতে হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন শেয়ারবাজার বন্ধ থাকার পর মাত্র নয়টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে ১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মতো ডিএসই কার্যক্রম শুরু করে। ভাবা যায়, এই ৪৫ বছর পরে এসে এখনো তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা মাত্র ৩৪৩টি। অথচ বিবিএসের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশে শুধু ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ রয়েছে ৪৬ হাজার ২৯১টি। দেশের বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান পারিবারিক ব্যবসায় অভ্যস্ত। ব্যাংক ঋণের সহজপ্রাপ্যতা, নিজেদের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির ওপর পারিবারিক আধিপত্য ধরে রাখা, বেশি মানুষকে নিয়ে ব্যবসা ঝামেলা মনে করা আবার অনেকে আইপিও অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রতাকেও এই অনাগ্রহের অন্যতম কারণ মনে করেন। সর্বোপরি জবাবদিহির জায়গা থেকে নিজেদের দূরে রাখতেই শেয়ারবাজারে আসতে আগ্রহী হন না ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশে অনেক বড় বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ও উদ্যোক্তা রয়েছেন। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) বাংলাদেশের বেসরকারি খাত নিয়ে গত বছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একশর বেশি বড় শিল্প গ্রুপ আছে। এর মধ্যে আয়ের দিক থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেÑ এমন শীর্ষ ২৩টি বড় গ্রুপ বা কোম্পানির তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, খুব অল্পসংখ্যক কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। যা সিন্ধুর মাঝে বিন্ধুর ফোঁটা-র মতো। অথচ এসব কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েÑ কোম্পানির সুনাম, মূল্য, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে পারে। আবার কর ছাড়ের মাধ্যমে কোম্পানির আয়ও বেড়ে যায়। ফলে বছর শেষে লভ্যাংশ প্রদানের মধ্য দিয়ে শেয়ারবাজারের সামগ্রিক চিত্রই পালটে দিতে পারে। কারণ, বিনিয়োগকারীরা যেখানে বেশি মুনাফা পাবেন, সেখানেই বিনিয়োগ করবেন। আবার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনতে শুধু ইক্যুইটি মার্কেট থেকে বের করে সত্যিকারের ক্যাপিটাল মার্কেটে পরিণত করতে হবে।
শেয়ারবাজার স্থিতিশীলতায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্টের পাশাপাশি বড় বড় শিল্প গ্রুপের ভালো প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোকে যেভাবেই হোক তালিকাভুক্ত করতে হবে। অন্যথায় স্থিতিশীলতা অলীক স্বপ্নই রয়ে যাবে। এটি অনস্বীকার্য, একটি সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল পুঁজিবাজার প্রতিষ্ঠা হয় সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর সচেতন অংশগ্রহণের মাধ্যমে। সচেতনভাবে বিনিয়োগের যাত্রা শুরু করলেও সত্যিকার সুষ্ঠু বাজার তথা বিনিয়োগ নির্ভর করে বিনিয়োগকারীর সক্ষমতা, বিনিয়োগ আচরণ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সুশাসনের ওপর। বস্তুত সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সত্যিকারের স্থিতিশীল বাজার কার্যকর হয়। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে-দুর্বৃত্তায়ন তথা কারসাজি চক্রের কারসাজি বন্ধ করা গেলে সত্যিকার স্থিতিশীল বাজারের দেখা মিলবে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে, আইনের শাসন নিশ্চিত করে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অন্যথায় শেয়ারবাজার স্থিতিশীলতার চ্যালেঞ্জের পরিধি বাড়বে বৈ কমবে না।
আবার অনেকে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার করেও বাংলাদেশকে নতুন বলে থাকেন। এটি নিজেদের দুর্বলতা বা ব্যর্থতা ঢেকে রাখার অপচেষ্টা মাত্র, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার শামিল। তবে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার নবীন বলার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ জন্মের বহু আগেই শেয়ারবাজারের জন্ম। তা আমরা এখনো এই পঞ্চাশ বছর পরে এসেও কাজে লাগাতে পারিনি বা বুঝে ওঠতে পারিনি। নানা কারণে আজও এটি অবহেলিত। এটিকে অপব্যবহার করা হচ্ছে। লজ্জা হয় যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আগামীতে মার্কেট ভালো হবে’। মনে প্রশ্ন জাগে, কত দশক বা কত প্রজন্ম সময় পেলে একটি দেশের শেয়ারবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, বাজার স্থিতিশীল হয়, ভালো মানের বিনিয়োগকারী তৈরি হয়। তাই মৌলিক বিষয়গুলোতে সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ঐকমত্য জরুরি। এ করা না গেলে শেয়ারবাজারের সুষ্ঠুতা, স্থিতিশীলতা ও সুনাম অর্জন বারবার হোঁচট খাবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা জাতির সামনে শেয়ারবজারের যে অমিত সম্ভাবনার পথ দেখাচ্ছে, তা বাধাগ্রস্ত হবে। আর ওই সুযোগ গ্রহণ করবে দুষ্ট লোকেরা। যারা আদৌ শেয়ারবাজার স্থিতিশীলতা নিয়ে ভাবে না। তারা এ রকমই শেয়ারবাজার দেখতে চায়।
মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক