বিশ্ব স্বার্থে আমাজন বাঁচাতে হবে
অলোক আচার্য
🕐 ৪:০৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২২, ২০২২
পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুর স্থিতিশীলতা রক্ষায় বিশ্বের বনাঞ্চলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বৃহত্তর বন আমাজন। মহাবন আমাজন বিশ্বের বিস্ময়। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদী বিধৌত অঞ্চলে অবস্থিত এক বিশালাকার বনভূমি আমাজন। এই বনের দীর্ঘায়তন এবং বনের প্রকার দেখে এক সময় স্থানীয়রা ধারণা করত এই বন ধ্বংস করা সম্ভব না।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, পৃথিবীর আর দশটা বনের মতো আমাজনও সংকুচিত হতে শুরু করেছে এবং তা বর্তমানে অতিমাত্রায়। ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটার অববাহিকা পরিবেষ্টিত এই অরণ্যের প্রায় ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার মূলত আর্দ্র জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত। ৯টি দেশজুড়ে এই বন বিস্তৃত রয়েছে। তবে অধিকাংশ অর্থাৎ ৬০ ভাগ রয়েছে ব্রাজিল অংশে। এছাড়া ১৩ শতাংশ পেরুতে রয়েছে এবং বাকি অংশ রয়েছে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম ও ফরাসিম গায়ানায়। পৃথিবীজুড়ে রেইন ফরেস্টের অর্ধেকই আমাজনে। ফলে আমাজনের ক্ষতি কোনো একক দেশকে প্রভাবিত করে না। এই বন পৃথিবীর ফুসফুস নামে পরিচিত। সুন্দরবন যেমন বাংলাদেশের ফুসফুস তেমনি আমাজন পৃথিবীর ফুসফুস। ফলে আমাজনের ক্ষতি আমাদের বিশ্বের জন্যই ক্ষতি। প্রতিনিয়তই প্রাকৃতিক ও মানুষের আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডের কারণে আমাজন সংকুচিত হচ্ছে। গত ১৫ বছরের মধ্যে আমাজন উজাড়ের ঘটনা ঘটেছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের পৌঁছেছে। এক বছরেই ব্রাজিলের এই বনাঞ্চল উজাড়ের হার বেড়েছে ২২ শতাংশ। গত বছর আমাজনের ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ব্রাজিলের মহাকাল সংস্থার প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। মানুষ প্রকৃতিকে বশ মানিয়েছে। তবে মানুষের এই প্রতিনিয়ত অত্যাচারে প্রকৃতি আজ হিং¯্র, উন্মত্ত ও ক্ষিপ্ত।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তাই মাঝে মধ্যেই প্রকৃতির ধ্বংসলীলা চলে। এই ধ্বংসলীলার জন্য আজ পৃথিবীতে বহু মানুষ গৃহহীন। মহাবন আমাজন প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি। ব্রাজিলে অবস্থিত এই বন সম্পর্কে একসময় বলা হতো এই বন কখনো ধ্বংস হবে না। বইপুস্তকে আমাজন নিয়ে বহু লেখা আমরা পড়েছি। বহু কল্পকাহিনি, সিনেমা এই আমাজন বন ঘিরে তৈরি হয়েছে। তবে মানুষের ক্রমবিকশিত সভ্যতার কার্যকলাপে আমাজানও সংকুচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই মহাবন সংকুচিত হতে শুরু করেছে। মানুষের লোভের ভয়াল থাবা। আমাজনে প্রায় ৩০ লাখ প্রজাতির উদ্ভিদ ও পশুপাখি রয়েছে; পাশাপাশি, ১০ লাখ আদিবাসী মানুষের বসতি সেখানে রয়েছে। এই মহাবন বিপুল পরিমাণ কার্বডাইঅক্সাইড শোষণ করে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সংস্থাটির তথ্য মতে, ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১২ হাজার ২৩৫ বর্গকিলোমিটার বনভূমি উজাড় হয়েছে। ২০০৬ সালের পর থেকে এটিই সর্বোচ্চ বনাঞ্চল ধ্বংসের ঘটনা। ২০২০ সালে বেআইনিভাবে খননকাজ এবং গাছ কেটে কৃষি জমি তৈরি করার কারণে বন নিধন চরমভাবে বেড়ে গেছে। ২০২০ সালে যে পরিমাণ বন ধ্বংস হয়েছে, ২০২১ সালেও একইভাবে আরও ৭ হাজার ৮৮০ বর্গকিলোমিটার বন উজাড় হয়েছে। তখনো বছর শেষ হয়নি।
আমাজনের ওপর নির্ভর করে আছে নানা রকম প্রাণীকুল। বৈচিত্র্য সম্ভারে আমাজনের দ্বিতীয়টি নেই। একটি বিষয় স্পষ্ট, আমাজনের আজকের এই পরিণতির জন্য মানুষের লোভ এবং লাভের হিসাবই দায়ী। যে আমাজনের ওপর পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্যের একটি বড় অংশ নির্ভরশীল সেখানে মানুষের জন্য আজ পৃথিবীর ফুসফুসের এই পরিণতি। এই সুন্দর পৃথিবীর এখন সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। যে গতিতে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে তাতে অচিরেই পৃথিবীর কোনো কোনো দেশ ভয়াবহ সংকটে পড়তে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবেও অধিকাংশ দেশের জন্য হুমকি। এই হুমকি মোকাবেলায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং অভিযোজন শব্দটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। পৃথিবীর বাতাস ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠছে। অথচ এই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল একসময় সুশীতল, বিষমুক্ত ছিল। সেই আগের মতো বাযুমণ্ডল পেতে হলে পক্ষে এক লাখ কোটি গাছ লাগালে বায়ুমণ্ডল হয়ে উঠবে সেই ১০০ বছর আগের মতো। এমনটাই জানিয়েছেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখে সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ইটিএইচ জুরিখ) একটি গবেষণা। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু গাছ লাগালেই আসন্ন সংকট থেকে সমাধান সম্ভব। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জেরে যে হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে তাতে অনেরক নিচু শহর মারাত্মক হুমকিতে রয়েছে। আর শিল্পায়নের জোয়ারে বাতাসে কার্বনডাইঅক্সাইড বেড়েই চলেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এক লাখ কোটি গাছ লাগাতে জমির অভাব হবে না। হিসাব করে দেখিয়েছে, যদি আপনার সদিচ্ছা আর আন্তরিকতা থাকে দ্রুত এক লাখ কোটি গাছ বসিয়ে ফেলার তাহলে অন্তত জায়গার অভাবে সেসব গাছের বেড়ে উঠতে ও বেঁচে থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না।
মানুষের লোভের পরিণতিতে অথবা প্রাকৃতিক কারণেই হোক অ্যামাজানের এই ক্ষত মানুষের জন্যও শুভ নয়। আমাজানকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হলেও বাস্তবিকপক্ষে প্রতিটি বনাঞ্চলই পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবে কাজ করে। প্রতিটি বনাঞ্চল রক্ষা করার দায়িত্বই মানুষের। যে উন্নয়নের নামে বনাঞ্চল ধ্বংস করে সম্পদের পাহাড় গড়ছি সেই সম্পদ একদিন মানুষের কাধেই বোঝা হয়ে সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হবে। সেক্ষেত্রে সেখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এই বনকে নিজের মতো রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ২০১৯ সালে বোলসোনারো সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমাজনের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার খোয়া গেছে মাত্র এক বছরেই। যার আয়তন প্রায় লেবাননের সমান। যদিও বলসোনারো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০২৮ সালের মধ্যে অবৈধভাবে বন উজাড় ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনবেন। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ তার সময়েই খনিতে খনন কাজ এবং কৃষিজমি তৈরির কাজ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হার না কমালে আমাজনের ধ্বংস সময়ের ব্যাপার মাত্র। একদিকে আমাজনকে রক্ষা করা অন্যদিকে কৃষি জমি তৈরি করে খাদ্য উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়া এবং খনির অর্থনীতি কাজে লাগানো। এতসব একসঙ্গে মেলানো অনেকটাই কষ্টকর কাজ হবে। তাছাড়া এই বনে যেসব অধিবাসীর বাস তাদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সেটা সম্ভব না হলে আদিবাসীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ ঘটতে পারে এবং এরকম কিছু ঘটনা ঘটেছে।
আইএনপিই’র তথ্য উপাত্ত বলছে, শুধু গত বছরের অক্টোবরেই ১১ হাজার ৫০০ এর বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তার আগের বছর ছিল ১৭ হাজার ৩০০। ২০১৯ সালের পর এসব ঘটনা দ্রুত বেড়েছে এবং তখন ছিল ৭ হাজার ৯০০টি। এভাবে ঘনঘন আগুন লাগার ঘটনা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। এভাবে আমাজনকে কতদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
একটি গাছও বিপুল অক্সিজেন যোগায়। আর পৃথিবীর প্রতিটি বন এমন সম্পদ যার মাধ্যমে এই পৃথিবী বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। দ্রুত নগরায়ন প্রক্রিয়ায় সারা পৃথিবী থেকেই বনভূমি উজাড় হচ্ছে। গড়ে উঠছে মানুষের বসতি। তৈরি হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। খাদ্য নিরাপত্তা দিতে তৈরি হচ্ছে কৃষি জমি। অথচ আমাদের এই মুহূর্তে দরকার পরিকল্পিত বনায়ন। বৈশ্বিক উষ্ণতা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামিয়ে আনা প্যারিস চুক্তির লক্ষ। বৈশি^ক উষ্ণায়ন এত দ্রুত প্রতিকূল দিকে ধাবিত হচ্ছে যেখানে বিশ্ব শীতলিকরণের জন্য আমাজনের গুরুত্ব অপরিসীম।
আমাদের খাদ্য বা অন্যান্য সম্পদের যেমন প্রয়োজন রয়েছে তারও আগে এই পৃথিবী টিকিয়ে রাখার গুরুত্ব রয়েছে। আমাজন ঘিরে উন্নয়ন কার্যক্রম তরান্বিত হলে আমাজনের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। সেই সঙ্গে আদিবাসী অস্তিত্বও বিলুপ্ত হবে। যার খেসারত দিতে হবে পুরো বিশ্বকে। ফলে মহাবন আমাজন টিকিয়ে রাখতে হবে ঠিক আগের অবস্থায়।
অলোক আচার্য : শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক, পাবনা