ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বনভূমি উজাড় ও আমাদের করণীয়

কাজী ফারহানা ইসলাম
🕐 ১২:০৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২১, ২০২২

বনভূমি উজাড় ও আমাদের করণীয়

বনভূমি মানবজাতির জন্য ঢালস্বরূপ। সমগ্র পৃথিবীকে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করে থাকে বনভূমি। তবে বর্তমান সময়ে বনভূমি উজাড়ের ফলে এই পরিবেশ ও জনজীবন বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

FAO-এর মতে প্রতি হেক্টর জমিতে কমপক্ষে ০.০৫ হেক্টরে বিভিন্ন ধরনের গাছপালার সমাবেশকে বনভূমি বলে। বনভূমি উজাড় বা বন নিধন বলতে সাধারণত আমরা বন পরিষ্কার করার জন্য বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছপালা কেটে ফেলা বা পুড়িয়ে ফেলাকে বুঝি। অন্যভাবে বলতে গেলে মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজন মেটাতে নির্বিচারে যে বনভূমি ধ্বংস করে চলছে, বনভূমি ধ্বংস করার এই প্রক্রিয়াকে বনভূমি উজাড় বলে। আমরা জানি পৃথিবী পৃষ্ঠের ৩০ শতাংশ বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত। বনভূমি পৃথিবীর ফুসফুস। গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং ছায়া সরবরাহের মাধ্যমে মাটিকে আর্দ্র রাখে। এবং চারপাশের পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখে। কিন্তু যখন কোনো বন কেটে ফেলা হয় বা পুড়িয়ে ফেলা হয় তখন আর্দ্রতা কমে যায় যার ফলে অন্যান্য সব গাছপালা শুকিয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে।

বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগব্যাধি এবং গ্রীষ্মম-লীয় রেইন ফরেস্ট শুকিয়ে আগুনের সূত্রপাত ঘটে এবং তার থেকে দ্রুত বনভূমি ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষের পাশাপাশি বনভূমিতে বসবাসকারী প্রাণীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির উৎপত্তি হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা গত দুই দশক ধরে এ বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছেন। তারা বলেছেন, মানুষ যত সীমা লঙ্ঘন করে বনে প্রবেশ করবে বুনো প্রাণীদের হওয়া নানা রোগব্যাধি মানবজাতিকে তত বেশি সংক্রমিত করবে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর একটুও অবাক হননি ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব মাতো গ্রাসো-র ইকোলজিস্ট আনা লুসিয়ে তোউরিনহো। তিনি পরিবেশ ভারসাম্য বিনষ্ট হলে কিভাবে বন এবং সমাজ অসুস্থ হয়ে পড়ে তা নিয়ে গবেষণা করছেন।

তিনি বলেছেন, যখন কোনো নতুন ভাইরাস সেটির প্রাকৃতিক আবাস ত্যাগ করে মানুষের দেহে প্রবেশ করে তখন ভীষণ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নতুন করোনাভাইরাস সেটাই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পূর্বেই বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বন উজাড়ের কারণে বাদুড়ের আবাস বিনষ্ট হওয়া এবং সেগুলোর চারদিকে ছড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে নতুন মহামারীর বিস্তার সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল।

পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারশর গবেষক আনিতা আফেল্ট তার গবেষণার পরবর্তী মারাত্মক সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব এশিয়া মহাদেশ থেকে হবে বলে জানিয়েছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গত ৪০ বছরে এশিয়া মহাদেশে মারাত্মকভাবে বন উজাড় করা হয়েছে।
গত দুই দশকে (২০০০-২০২০) সুন্দরবনের গাছপালার পরিমাণ মারাত্মক হারে কমেছে। কমেছে বনের ঘনত্বও। বন উজাড় হয়ে ফাঁকা ও পতিত জমির পরিমাণ বাড়ছে। সুন্দরবন আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ১৭৭৬ সালে বাংলাদেশ অংশে বনের বিস্তার ছিল ১৭০০০ বর্গকিলোমিটার কিন্তু ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ অংশে পুরো বনের বিস্তার ৬৪৬৭ বর্গকিলোমিটার।

বনভূমি উজাড়ের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো অবৈধভাবে বনভূমি দখল। দেশের মোট বনভূমির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর কিন্তু এই বনভূমির একটি বড় অংশ প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বন বিভাগের উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- সারা দেশে দুই লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর বনভূমি দখল হয়ে গেছে। এক লাখ ৬০ হাজার ৫৬৬ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এসব বনভূমি জবরদখল করে রেখেছেন। জমি দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে তৈরি করা হয়েছে শিল্পকারখানা।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি, ব্যক্তিমালিকানাধীন কাজে পাহাড়-টিলা কাটা বা অন্য কোনো উপায়ে ভূমিরূপ পরিবর্তন করা যাবে না বলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাহাড় কেটে পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছেই। অন্যদিকে বনভূমি উজাড়ের আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে জনসংখ্যার বৃদ্ধি। দিনদিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলে বৃদ্ধি পাওয়া জনসংখ্যার জন্য বাসস্থানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। মানুষ তার বাসস্থানের জন্য গাছ কেটে বসতির ব্যবস্থা করছে। তাছাড়া বাড়তি জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজন বাড়তি খাদ্যের যা সীমিত সম্পদের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব নয়। মানুষ তার খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে বনভূমি উজাড় করে কৃষি তৈরি করে নিজেদের খাদ্যের জোগান দিচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাঠের চোরাচালান ব্যবসা আছে।

এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকারের বিধিনিষেধ অমান্য করে বেআইনিভাবে গাছ কেটে বনভূমিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য নতুন রাস্তা ও রেলপথ তৈরির জন্য যে জায়গার প্রয়োজন হয় তার জন্য গাছপালা ও বনভূমি কাটা হচ্ছে যার ফলে বনভূমি উজাড় হওয়ার পাশাপাশি তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। বনভূমি অঞ্চল হতে প্রাপ্ত নতুন খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য উত্তোলন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য প্রচুর পরিমাণ গাছ কেটে ফেলা হয়। যার ফলে বনভূমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে হওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। যেমনÑ দাবানল, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, অ্যাসিড বৃষ্টি, ভূমিধস, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদি। দিনদিন জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও কৃষি সম্প্রসারণ ও বিভিন্ন দুর্যোগ ফলে সমগ্র বিশ্বব্যাপী বনভূমি কমছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলে মেরু অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাপী উপকূলীয় নিম্ন এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় নিম্ন এলাকা সাগরের লোনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে সব থেকে বেশি। উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি-পানি ক্রমেই লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলার কারণে নতুন নতুন অণুজীব অবমুক্ত হচ্ছে। যার ফলে সংক্রামক রোগব্যাধির উৎপত্তি হচ্ছে। বনভূমি রক্ষার্থে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে। বিগত বছরগুলোতে প্রাকৃতিক বনের বাইরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ, বাণিজ্যিক বাগান ও সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে গাছের সংখ্যা বেড়েছে।

কাজী ফারহানা ইসলাম : শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 
Electronic Paper