ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সবার জন্য রেশন কতদূর?

উমর ফারুক
🕐 ৯:৪৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৩, ২০১৮

আমাদের সমাজের অনেক কিছুই উল্টোপথে চলে। উল্টোপথে রাষ্ট্র চলে। সমাজ চলে। উল্টোপথে চলে মন্ত্রীর গাড়ি। চলে ট্রাফিক ব্যবস্থা। চলে পাগল, চলে পদ্ধতি। চলে আমাদের হতদরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাও। মুঠোফোন সংযোগের উপহারও উল্টোপথে চলে। আপনি একটি মুঠোফোন সংযোগ ক্রয় করবেন, কদিন ব্যবহার করবেন, দীর্ঘদিন ফেলে রাখবেন। তারপর ফিরে এলে আপনার জন্য থাকছে বিশেষ উপহার।

বিনামূল্যে মিনিট, ইন্টারনেট, আরও কতো কী! অথচ যিনি নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ ব্যবহার করলেন তার জন্য উপহারটা অতীব সামান্য। কখনো কখনো তা হাস্যকর পর্যায়ে অথচ উপহার তো তার জন্যই বেশি হওয়া উচিত ছিল যিনি নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ ব্যবহার করছেন। অন্যদিকে, আমাদের সমাজে কিছু মানুষ প্রতিদিন না খেয়ে থাকছে, তাদের জন্যও রাষ্ট্রের কিছু বরাদ্দ আছে। তবে তা অতি সামান্য। বাড়াবাড়ি বরাদ্দটা তো তাদের জন্য যারা মাস শেষে বেতন পান, বছরে দুটো বোনাস পান তাদের জন্য। যেমন রেশন, যা সবার জন্য নয়, শুধু চাকরিজীবীদের জন্য অথচ রেশন সবার আগে তাদের জন্য বরাদ্দ হওয়া উচিত ছিল যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তাই নয় কী? বিস্ময়কর তাই না!
আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দারিদ্র্যের শেকড় উৎপাটনের চেষ্টা চলছে। কিন্তু সে শেকড় প্রতিনিয়ত আরও গভীর হচ্ছে। গাঢ় হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক, ধনতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থা ও বৈষম্যমূলক অর্থনীতির জাতাকলে দারিদ্র্য ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছে। মুদ্রাস্ফীতি ও বিলাসী অর্থনীতি মানুষের বাড়তি আয় ও শ্রমকে নামিয়ে আনছে শূন্য উপযোগে। ফলে ভালো নেই আমাদের অর্থনীতি। ভালো নেই দরিদ্র মানুষ। ভালো নেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ভালো নেই আমাদের দারিদ্র্য উন্নয়ন কার্যক্রম বরং নিকৃষ্ট অর্থনীতি নিংড়ে নিচ্ছে মানুষের সকল প্রাণশক্তি। ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাজার নিয়ম মেনে না চললে দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্রের পরিধি ক্রমাগত প্রসারিত হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ধাপে ধাপে নিম্নবিত্তের দিকে ধাবিত হয়। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, আমাদের বাজার ব্যবস্থা একশ্রেণির মুনাফাভোগী আমদানিকারক ও মজুদদারের নিয়ন্ত্রণে। সরকার তাদের সঙ্গে কেবল আপস করে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিতে অনেকাংশে অসহায়। ফলে জিম্মি হয়ে পড়ে আমাদের অর্থনীতির মৌলিক সূচকগুলো। বিলাসী অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুদ্রাস্ফীতি হয়। কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে একশ্রেণির মানুষের আয় স্থির অথবা ক্রমহ্রাসমান এবং মুদ্রাস্ফীতির হার অসহনীয়। ফলে, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দারিদ্র্য ক্রমহ্রাসমান নয়। কোনো কোনো অঞ্চলে এটা ক্রমবর্ধমানও। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে ১০০ টাকায় যে পণ্য পাওয়া যেত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সেই একই পরিমাণ পণ্য পেতে অর্থ ব্যয় হয়েছে প্রায় চারশত টাকা। এখন প্রশ্ন উঠছে, এই ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে হতদরিদ্র মানুষের জীবনমানের বর্তমান অবস্থাটা কোথায়? ক্ষুধা মানবিক নিরাপত্তার অন্তর্ভুক্ত। বিষয়টি মৌলিক অধিকার নিরাপত্তারও বটে। খাদ্য নিরাপত্তা ছাড়া সরকারি অনেক কর্মসূচি নিষ্ফল। আমরা জেনেছিলাম, পোশাক শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালুর প্রক্রিয়া করছিল সরকার।
কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে সরকার বিষয়টি নিয়ে নিশ্চুপ। কেন যেন মনে হয়, সরকারি পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সম্পর্কে উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। বোধ হয় নীতিনির্ধারকরা মনে করে থাকে, এ খাতে ব্যয় রাষ্ট্রের তেমন কোনো কাজে আসে না। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বজনীনভাবে আমাদের গ্রাস করার আগে, আমাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। আর ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কর্মসংস্থান বৃদ্ধি আবশ্যক। যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা না যায় তাহলে রেশনিং সর্বোত্তম বিকল্প।
বাংলাদেশ সরকার ওএমএস, কাবিখা, টিআর, কাবিটা, ভিক্ষাবৃত্তি অবসান, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বয়স্কভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা, হিজড়া ভাতা, এতিম শিশুদের জন্য ভাতা, উপবৃত্তি, একটি বাড়ি একটি খামার, অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান, ভিজিডি, ভিজিএফ ও প্রকল্পসহ বিভিন্ন রিলিফের মাধ্যমে সমাজে খাদ্য নিরাপত্তা প্রদানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় সরকারের দুর্নীতি এ কর্মসূচিগুলোর সফলতাকে ম্লান করে দিচ্ছে। বলে রাখা ভালো, সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ে বেকারকে নিরাপত্তা দিতে কোনো ব্যবস্থা নেই। একজন বেকার সমাজের বোঝা। ফলে এক সময় সেই মানুষটি সমাজে অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে। তাই সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ে বেকারকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১: দারিদ্র্য বিমোচন, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ২: ক্ষুধামুক্তি ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১০: বৈষম্য হ্রাসকরণ কর্মসূচিতে ইতিবাচক অগ্রগতির জন্য সরকার ইতোমধ্যে নানান কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মাথাপিছু দারিদ্র্যের হার ৬.২ শতাংশ হ্রাস করা (২৪.৮% থেকে ১৮.৬% কমিয়ে নিয়ে আসা), অতি দারিদ্র্য হার প্রায় ৪.০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো (২০২০ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্য হার ৮.৯% নিয়ে আসা), সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় জিডিপির ২.৩% হারে বর্ধিত করা, পিছিয়ে থাকা অঞ্চলের জন্য তহবিল গঠন করা, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নির্দেশিত খাদ্য হস্তান্তর কর্মসূচি জোরদার এবং সংহতকরণ, পাঁচ বছরের কম বয়সের খর্বকায় শিশুদের হার ৩৬.১% থেকে ২৫% এ কমিয়ে আনা, পাঁচ বছরের কম বয়সের কম ওজনের শিশুদের হার ৩২.৬% থেকে ২০% কমিয়ে আনা, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় জিডিপির ২.৩% হারে বৃদ্ধি করা, আয় বৈষম্য বা অসমতা সূচক ০.৪৫৮ থেকে কমিয়ে আরও নিম্নগামী করাসহ নানাবিধ কর্মসূচি ইতোমধ্যে চলমান। কিন্তু বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে, সবার আগে, সবার জন্য রেশন কার্ড চালু করা আজ খুবই প্রয়োজন।
একথা সত্য, একসঙ্গে সবার জন্য রেশন কার্ড প্রদান সম্ভব নয়, আবার একথাও সত্য সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ রেশন কার্ড গ্রহণ করতে আগ্রহীও নয়। তাই সরকার চাইলে সূচনালগ্নে এক বা একাধিক বিশেষ শ্রেণির মানুষের জন্য রেশন কার্ড চালু করতে পারে। তখন তারা আর বাজারে আসবে না। ফলে, বাজারে ক্রেতার চাপ সামান্য কমবে, বাজারের ক্রেতা সংকট দেখা দিলে হয়তো বিক্রেতাদের অতিমুনাফার আগ্রহটা সামান্য কমে আসবে। এভাবে বাজারের ঊর্ধ্বগতি স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। রেশনিং এর ফলে সবার জন্য খাবারের নিরাপত্তা যেমন সম্ভব হবে, তেমনি সরকার যখন কৃষকের কাছ থেকে অতিমাত্রায় চাল ক্রয় করবে তখন কৃষককে আর মহাজনদের দ্বারস্থ হতে হবে না। ফলে, কৃষক সমাজও পণ্যের যথাযথ মূল্য পাবে। রেশন কার্ড চালু করা হলে, একইসঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে আমাদের কৃষক। অর্থনীতি মাথা তুলে দাঁড়াবে। রেশন কার্ড কেমন হবে, প্রাথমিকভাবে কাদের জন্য হবে সেই রেশন কার্ড সেটি পরিকল্পনার বিষয়। দুই ধরনের রেশন কার্ড চালু করা যেতে পারে। যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে, তাদের এক ধরনের কার্ড এবং যারা এর নিচে, তাদের জন্য অন্য রেশন কার্ড। ভূমিহীন বা স্বল্পভূমির মালিক, যেসব পরিবারের দৈনিক জনপ্রতি আয় ৩০ টাকার নিচে এবং যেখানে দুস্থ ও অনগ্রসর সদস্যের সংখ্যা ব্যাপক, প্রাথমিকভাবে তাদের জন্য রেশন কার্ড চালু করা যেতে পারে। সত্যকথা বলতে কী, রেশনিং বাঁচাতে পারে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের।
প্রশ্ন জাগে, গত সাড়ে চার দশকেরও বেশি সময়ে আমরা কী করলাম? আমাদের প্রান্তিক মানুষের নিরাপদ খাদ্য পেতে আর কতদিন লাগবে? আমাদের মনে রাখতে হবে, খোলাবাজারে চাল বিক্রির (ওএমএস) মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। বেতন কাঠামোতে রেশনিং ব্যবস্থা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে।
দেশের সব শ্রেণির মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে খাদ্য নিরাপত্তাবলয় বাড়াতে হবে। সেজন্য একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ আবশ্যক। কোন কোন পণ্য রেশনে অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। মহাপরিকল্পনায় ধাপে ধাপে সবার জন্য রেশন কার্ড প্রচলনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই বাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তাহলে সীমিত আয়েই মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
খাদ্য নিরাপত্তার জন্য রেশনিংই সর্বোত্তম পন্থা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যবিমোচন করতে, সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান করতে, রেশনের কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্রকে আজ সোজা পথে হাঁটতে হবে, উল্টোপথে নয়। সবার জন্য রেশনের ব্যবস্থা করতে আজ এখনই কার্যকর প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। তাহলেই সামাজিক নিরাপত্তাবলয় শক্তিশালী হবে। খুব জানতে ইচ্ছে হয়, আর কতটা পথ হাঁটলে আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি পরিপূর্ণ সফল হবে? আর কতটা পথ হাঁটলে নিশ্চিত হবে সবার জন্য রেশন? উত্তর যাই হোক, মনে রাখতে হবে, আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে রেশনই সামাজিক নিরাপত্তার পূর্বশর্ত।

উমর ফারুক : শিক্ষক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
[email protected]

 
Electronic Paper