শ্রমিক বঞ্চিত, পুঁজিতোষী উন্নয়ন কথকতা
জাফর আহমদ
🕐 ৩:৩৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৬, ২০২১
রাজধানীর অদূরে শিল্প পল্লী আশুলিয়ার জামগড়ার রাস্তার পাশে সবজি বিক্রি করছেন প্রৌড়ত্বে হেলে পড়া এক ব্যক্তি। শরীরজুড়ে শ্রমের চিহ্ন। পাশে চায়ের দোকানে আমাদের পত্রিকার আলোচনা শুনে বারবার লক্ষ করছিলেন তিনি।
ক্রেতাদের পাশে সরিয়ে সবজির দাম বলছিলেন, সবজি মাপার সময়েও আমাদের দিকটা ফাঁকা রাখছিলেন। সবজি বিক্রেতার এমন কাণ্ড ক্রেতা কারও কারও দৃষ্টি না এড়ালেও প্রথমে আমাদের চোখে পড়েনি। অবস্থা বুঝে কাছে যেতেই তিনি হেসে বললেন, আপনাকে চিনি।
-চেনেন! প্রশ্ন করলাম।
-আপনার নাম কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন।
-আমার নাম আতিক, আতিকুর রহমান। ইউনিভার্সেলে চাকরি করতাম। আপনি পত্রিকার সাংবাদিক না! আপনি আগে আসতেন, তুহিন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতেন। আপনাকে চিনি।
কথাগুলো একদমে বলে গেলেন আতিকুর রহমান। অকৃতজ্ঞের দণ্ডে দাঁড় করিয়ে দিলেন। ততক্ষণে স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে পেলাম নিজের অস্তিত্ব। আতিকুর রহমান হলেন আশুলিয়ার ফ্যান্টাসি কিংডমের পাশে বিখ্যাত একটি সোয়েটার কারখানার শ্রমিক।
২০০৬ সালে যে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিল তার বিস্ফোরণ হয়েছিল এই কারখানা থেকে। কারখানাকেন্দ্রিক অনেক ঘটনাই তার জীবনে আলো দেখায়। তৈরি পোশাক শিল্পকে মানুষ এক সময় শিল্পের বদলে দর্জি কারখানা বলত, উদ্যোক্তা-সমাজের দৃষ্টিতে এ শিল্প অনেকটাই অমর্যাদার ছিল। পেশা হিসেবে গার্মেন্ট কারখানার চাকরি অবহেলার চোখে দেখা হতো, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হতো।
গেট থেকে মানুষ নিয়ে এসে মেশিনে বসিয়ে কাজ দিত, এই ছিল নিয়োগ প্রক্রিয়া। নারী শ্রমিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হতো। যখন ইচ্ছা চাকরিচ্যুত করত। খারাপ ব্যবহার করত, শ্রম আইন থাকলেও প্রয়োগ ছিল না। অধিকার আদায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়- এটা তখনো বড় অংশ শ্রমিকের কাছে অজানা বিষয় ছিল। ২০০৬ সালের জুন মাসে শ্রমিকরা কারখানা থেকে বের হয়ে আসার মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা তাদের উপস্থিতি জানান দেন। সরকার নড়েচড়ে বসে। এক দশকের বেশি সময় ধরে টেবিল থেকে হারিয়ে যাওয়া শ্রম আইন সংস্কারের উদ্যোগের নড়াচড়া শুরু হয়, বেতন বৃদ্ধির জন্য বোর্ড গঠনের তাড়া আবার নতুন করে প্রাণ পায়। যে শ্রমিক উৎপাদন করে তার অস্তিত্ব টের পায় উদ্যোক্তারা।
এ জাগরণটা মূলত ২০০৬ সালের শ্রমিক বিদ্রোহ থেকে শুরু হয়। আর এই বিদ্রোহটা শুরু হয় আশুলিয়ার মোড়ের পাশে বিদেশে মালিকানাধীন তৈরি পোশাক কারখানা ইউনির্ভাসেল সোয়েটার থেকে। গাজীপুরের এসকিউ সোয়েটার কারখানায় শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া থেকে শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হয়। আর আশুলিয়ার এই ইউনিভার্সেল কারখানায় অভ্যন্তরীণ চলমান দাবির আন্দোলনে ধাক্কা দিলে বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণ পুরো শিল্পকে টালমাটাল করে দেয়। শ্রমিকদের এতদিন ধরে দাবিয়ে রাখা হতো, দমিয়ে রাখা হতো, মুখ বন্ধ করে রাখা হতো। সেই দমনের বিরুদ্ধে আঘাত সৃষ্টি হয়। আতিকুর রহমান এই কারখানার শ্রমিক ছিলেন।
২০০৬ সালের পরও কয়েক বছর চাকরি করেছিলেন আতিকুর রহমান। বছর খানেক পরে বাধে বিপত্তি। তাকে ছাঁটাই করা হয়। আতিকের বয়সও তৈরি পোশাক শিল্পের ধরন বিরোধী হয়ে যাচ্ছিল, ৩০ ছুঁই ছুঁই। এ বয়সে কারখানা মালিক শ্রমিকদের রাখে না। তখন বেতন বেড়ে যায়, প্রডাকশনের টার্গেট পূরণ হচ্ছে না- এমন সব অভিযোগ করে এসব শ্রমিকদের ওপর চাপ শুরু হয়। চাপ সহ্য করতে না পেরে চাকরি ছাড়ে। তারপর অন্য কারখানায়। এভাবে এক কারখানা থেকে আরেক কারখানায় ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে তৈরি পোশাক শিল্পই ছাড়ে।
-হ্যাঁ। কিন্তু আপনি তো সেই ইউনিভার্সেল কারখানার কাছেই আছেন। এতদিন পর দেখে খুব ভালো লাগল।
-কাছে থাকলেও কারখানায় নেই। আপনি তো দূরে থাকলেও গার্মেন্টস কারখানার সঙ্গেই আছেন। বন্ধুর কাছ থেকে শুনি। আমি তো থাকতে পারিনি।
-জি। আছি বলতে পারেন। আপনার ছেলেমেয়েরা কোথায় কী করছে, তারা চাকরিবাকরি করছে, নাকি লেখাপড়া? ব্যবসা কেমন লাগছে? গার্মেন্টস কারখানার চাকরি ছাড়লেন কেন, ভালো লাগছিল না? একনাগাড়ে এতগুলো প্রশ্ন নিজের অজান্তেই বের হয়ে যায় মুখ ফসকে।
-গার্মেন্টস কারখানা তো আমাকে রাখেনি। আমার যতদিন শক্তি-সামর্থ্য ছিল ততদিন রেখেছে। বয়স বেড়ে গেলে তো তারা রাখে না। আমাকেও রাখেনি। ওরা তো শুধু আমাদের তাকদের ফেরিওয়ালা। তাকদ শেষ, প্রয়োজনও শেষ।
-তাই তো!
-ছেলেমেয়ে দুইজন। মেয়েটা ছোট্ট, স্কুলে যায়। ছেলেটার হাইস্কুল পর্যন্ত স্কুলে গিয়ে আর সম্ভব হয়নি। একটা নিটিং কারখানায় হেলপার হিসেবে কাজ করে। আপনার ভাবি বাসায় থাকে। কোনো কারখানায় কাজ পাওয়া গেল না, বাড়ি যেতেও ভালো লাগল না। আশুলিয়ার মায়া ছাড়তে পারলাম না, থেকে গেলাম। বেঁচে তো থাকতে হবে। কিছু একটা করতে হবে।
তাই রাস্তার ধারে সবজি বিক্রি শুরু করেছি। কোনোমতে চলে যায়। এর আগে চা বিক্রি করেছিলাম, চলল না। পুঁজি শেষ হয়ে গেল। সবজি বিক্রি করছি। ছেলেমেয়েরা কারখানায় যায় রাস্তার ধারে বসে বসে দেখি।
-আপনি লেখাপড়াও জানেন।
-সে কথা আর নাইবা বলি। আমি কলেজ পর্যন্ত গেছি। আমার ছেলেমেয়েদের আমার নিজের সমানই পড়াতে পারলাম না। এদিক থেকে হিসাব করলে মন খারাপ হয়ে যায়। হিসাবে মেলে না। আমি কাজ করেছি শুধু কারখানার জন্য, মালিকের জন্য। আর আপনারা বলে থাকেন দেশের উন্নয়নের কথা, সেই উন্নয়নের জন্য আমরা কাজ করেছি। আমার জন্য, আমার সন্তানের জন্য- পরিবারের জন্য করিনি। করার সিস্টেম নেই। যা করব আখ ছেঁচে রস বের করার মতো সব ছেঁচে নেয় মালিকরা। আর আমি ছোবড়া হিসেবে থেকে যাই। আমি হলাম এই যে বড় বড় বিল্ডিং, উসার রাস্তা, রাস্তাজুড়ে রঙ-বেরঙয়ের গাড়ি আর কিছু মানুষের শান-শওকত জৌলুসের ছোবড়া। আমাদের চুষে এসব উন্নয়ন, এসব চাকচিক্য।
গত ক’বছর ধরে সম্পদের বৈষম্যের হিসাবনিকাশ হচ্ছে। সম্পদের মালিকানার হিসাবনিকাশ হচ্ছে। দেশে রাত পোহালেই মাথাপিছু আয় বাড়ছে। হ্যাঁ, বাড়ছে। কিন্তু আতিকুর রহমানের বাড়ছে না। তাদের শ্রম শোষণ করে হয়েছে এই সব চোখ ধাঁধানো জৌলুস। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব মতে মতিঝিল-গুলশান-বনানীর মানুষের ব্যাংকে যত টাকা আছে তার সমান টাকা সারা দেশের মানুষের নেই। আতিক কারখানায় পরিশ্রম করে যে টাকা পান সেই টাকা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে।
সংসার চলার মতো কোনো সঞ্চয় থাকে না, ছেলেকে স্কুলে পড়ানোর মতো টাকা অবশিষ্ট থাকেনি। এমনকি শরীর নিংড়ে শ্রম দেওয়ার ফলে শরীরে বাসা বাঁধা রোগ-শোকেরও চিকিৎসা করাতে পারেন না। তাই বয়স ৩০ পার হলেই এসব শ্রমিককে কারখানা থেকে ছাঁটাই হতে হয়। ছাঁটাইয়ের সময় এসব শ্রমিককে বেতনের বাইরে অন্য যে সব ভাতা তার কিছ্ইু দেওয়া হয় না। কোনো কোনো কারখানা শেষ মাসের বেতনটাও দেয় না, বঞ্চিত করে আইন মেনে আগে রিজাইন দাওনি বলে। অথচ ওই কারখানা কর্তৃপক্ষ নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করে কারখানা থেকে শ্রমিকদের রিজাইন করতে বাধ্য করায়। দেশে প্রতিবছর রপ্তানি আয় পাঁচ থেকে বছরভেদে ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। কারখানা মালিকরা এক কারখানা থেকে বছর শেষে একাধিক কারখানার মালিক হয়।
অথচ এসব শিল্প মালিকের আটানব্বই শতাংশই শ্রমিকের ভবিষ্যৎ তহবিল বা প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠন করে না। ফলে শ্রমিক যখনই কারখানা থেকে বের হন খালি হাতে বের হন। জীবনের মূল্যবান সময় কারখানা মালিককে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফেরেন।
বিশ^জুড়ে কোভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাসের মহামারী চলছে। এই মহামারী কখনো কখনো প্রলঙ্করী ঢেউ হিসেবে আসছে। মানুষকে ভাসিয়ে যাচ্ছে। এ সময় বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে কখনো লকডাউন, কখনো শাটডাউনের নামে ঘরবন্দি মহামারীর ঢেউ থেকে রক্ষার চেষ্টা চলছে। এ সময় দেশের শিল্প উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদন, রপ্তানি, মুনাফা অব্যাহত রাখার জন্য কারখানা লকডাউনের আওতামুক্ত রাখছে। তারা ঘোষণা দিচ্ছে, তৈরি পোশাক শিল্পের প্রায় আশি ভাগ শ্রমিকই তরুণ, যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৫ এর মধ্যে। ৩০ বছরের শ্রমিকের হিসাব করলে হয়তো পুরো শিল্পের শ্রমিকের হিসাব পাওয়া যাবে।
এসব শ্রমিকের করোনা প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি। করোনা দেশজুড়ে তাণ্ডব চালালেও শ্রমিকদের ক্ষতি করতে পারেনি। মালিকের এই আত্মতুষ্টির মধ্যেই এক বর্বরোচিত হলোকাস্টের সন্ধান মেলে, ভয়ঙ্কর ক্ষতের ফসিল জানান দিচ্ছে। তা হলো, পোশাক শিল্পে ১৮ বছরে শ্রমিকরা প্রবেশ করছে আর ৩০-এর আগেই কারখানা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। এসব শ্রমিক কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন? সামাজিক পরিচয়ইবা এদের কী? এবং তাদের সংখ্যাইবা কত? আতিকের চোখের তারা সে উত্তর খুঁজে ফেরে। আতিক শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছেন ঠিকই কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাননি। তিনি বলেন- আমি হয়তো শরীরের সব তাকদ মালিককে দিয়ে এসেছি। কিন্তু একবার তো জ্বলে উঠেছিলাম আমরা। আলোর ছটা দেখিয়ে দিয়েছি। আবার মালিকের অ-হিসেবি কোনো সময়ে জ্বলে উঠবে। মালিকের সব জাল ছিঁড়ে নতুন কিছু করবে। মালিক হয়তো মনে করে তারা সব রাষ্ট্রযন্ত্র কবজা করে বিচার রহিত করেছে।
এই ভাবনার যথেষ্ট কারণও আছে। দেশে উন্নয়নই হচ্ছে বৈষম্যকে কেন্দ্র করে। উন্নয়ন সাহিত্য স্বজনতোষী পুঁজিবাদমুখী। সম্প্রতি দেশে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এমন কথাই উঠে এসেছে। সেখানে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘উন্নয়ন মডেল হিসেবে বাংলাদেশ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে বেশি অনুসরণ করেছে। কিন্তু দেশের উন্নয়ন সাহিত্যে জাপানকে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। জাপানের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি সমতামূলক। দেশটি সব সময় শ্রমিকদের কল্যাণের বিষয়টি মাথায় রেখে নীতি প্রণয়ন করেছে। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রে শত কোটি ডলারের মালিক যেখানে ৬৭৫ জন, জাপানের মাত্র ২৫ জন। এমনকি ভারতেও শত কোটি ডলারের মালিক ১৫৩ জন।
অর্থাৎ জাপানে বৈষম্য কম।’ বাংলাদেশ এখন পঞ্চম তরুণ জনশক্তির দেশ। এই শক্তির ওপর নির্ভর করে জিডিপি বাড়ছে, বাড়ছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি। এ শক্তি থাকবে আগামী দুই দশক। তারপর বাংলাদেশ আস্তে আস্তে প্রবীণের দেশে পরিণত হবে। সরকারের লক্ষ্যও ঠিক করেছে ওই সময়ে দেশ হবে উচ্চ আয়ের দেশ। শ্রমিক যদি তার বেতন দিয়ে সুস্থ জীবনযাপন করতে না পারেন, যদি আগামী দিনের কর্মক্ষম কর্মী বানানোর জন্য শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে না পারেন, যদি বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হয় তাহলে পরিকল্পনা ও লক্ষ্যে পৌঁছানো অধরাই থেকে যাবে। দেশে সড়ক, সেতু, জ্বালানি, বন্দরের মতো বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ হলেও কারখানা, ফসলের মাঠ অথবা প্রবাসে কাজ করার মতো যোগ্য কর্মী মিলবে না। এ অবস্থার অপরিবর্তিত থাকলে কাক্সিক্ষত চল্লিশের দশকে যখন পৌঁছাব তখন প্রাণ থাকবে, শক্তি থাকবে না।
আতিক একদা অধিকার আদায়ের স্লোগান দিয়েছেন, পরিবর্তন-অভীষ্ট পাঠচক্রে গেছেন। দুনিয়ার মজদুরের ঐক্য কামনা করতেন। সেই আতিকের কোনো কথা হয়তো অচেনা নয়। অচেনা শুধু কারখানার চাকরি হারিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে অন্য সব জীবনযোদ্ধার ভবিতব্য। যারা ভোর থেকে মাঝরাত অবধি পরিশ্রম করেন শুধু বেঁচে থাকার মতো বেতনের জন্য।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
[email protected]