ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অধ্যাপনা ও রাজনীতি : একটি ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ

রফিকুল ইসলাম
🕐 ২:৪৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৬, ২০২১

অধ্যাপনা ও রাজনীতি : একটি ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ

সাম্প্রতিক সময়ে বুয়েট শিক্ষক সমিতি কর্তৃক সেখানে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত, প্রফেসর ড. পরশ যুবলীগের চেয়ারম্যান এবং রাজনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের অংশগ্রহণ বেশ আলোচিত বিষয়। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, মানব জাতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র।

 

কল্পনা করুন রাষ্ট্রহীন জীবন কতটা নৈরাজ্য ও সহিংসতায় ভরা। আর রাষ্ট্র বা সমাজকে জনস্বার্থে পরিচালনার যে কার্যক্রম তাই হচ্ছে রাজনীতি। সুতরাং রাজনৈতিক বা রাজনীতিবিদদের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে জনস্বার্থে অন্যদের মতামতকে প্রভাবিতকরণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করা।

একটা বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে গেল। অধ্যাপক Ellen schrecker Zvi The lost soul of higher education গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন Classroom is not out of politics by other means. অর্থাৎ ক্লাসরুম রাজনীতির বাইরে নয়। বস্তুতপক্ষে একজন অধ্যাপক যখন শ্রেণিকক্ষে জাতীয়তাবাদ, বিশ্বায়ন, গণতন্ত্র, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, দরিদ্রতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন বা পাঠদান করেন তখন নিজস্ব মতাদর্শ থেকে প্রায়ই মুক্ত থাকার সুযোগ থাকে না বা সেখানে বাধ্যবাধকতাও অবান্তর।

রাজনীতি মানে শুধু রাজনৈতিক দলের পদ অর্জন কিংবা রাজপথে স্লোগান বা মিছিল মিটিং নয় বরং মতাদর্শ অনুযায়ী জনমত সৃষ্টি এবং তাকে জনপ্রিয় করে অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাকেও বোঝায়। এই সত্যকে অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ’৭৩ আদেশ অনুমোদন করেন এবং অধ্যাপকদের আদর্শিক কর্ম ও চিন্তার স্বাধীনতা সংযুক্ত করেন।

পশ্চিমা বিশ্বে শিক্ষকতার পাশাপাশি রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ অথবা রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে শিক্ষকতা একটি অতি পরিচিত ঘটনা। বর্তমানে আমরা যে ওয়েস্টমিনস্টার টাইপ ডেমোক্রেসি অনুসরণ করি সেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বেশ কয়েকজন এমপি রয়েছেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিয়েনে/ছুটি নিয়ে সংসদে আইন প্রণেতা হিসেবে কাজ করছেন। ইউরোপের অন্যান্য দেশে এমন উদাহরণ আরও বেশি।

আমি পশ্চিমা সভ্যতার অন্যতম অগ্রসর দেশ নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীদের জীবনবৃত্তান্ত অধ্যয়ন করে দেখেছি, সরাসরি বিশ্ববিদ্যলয়ে লেকচারার বা গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগদান করে পূর্ণ অধ্যাপক হয়েছেন এবং একইসঙ্গে দলীয় রাজনীতি করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এ সংখ্যা নেহাতই কম নয়।

উদাহরণ হিসেবে Dr. Jan de Quay যিনি (১৯৫৯-৬৩) দেশটির প্রধানমন্ত্রী এবং তার আগে তিনি Tilburg University -এর অধ্যাপক হিসেবে কাজ করতেন। Dr. Jan Peter (২০০২-১০), Dr. Jelle Zjilstra (১৯৬৬-৬৭), Dr. Ruud Lubbers (১৯৮২-৯৪) যারা নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা এবং রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। আমি নিশ্চিত ইউরোপের অন্যান্য দেশের অনেক রাজনীতিবিদের জীবনবৃত্তান্ত পর্যালোচনা করলেও এমন তথ্যই পাওয়া যাবে। আমি যখন নরওয়ের ট্রমসো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন সেখানে ড. ওলা ন্ডেনবল্ড মজেস অধ্যাপনা করতেন।

তিনি ‘নরওয়েজীয়ান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি’র অন্যতম প্রধান এবং ২০০৩-০৮ সময়ে ‘নোবেল পিস কমেটি’র চেয়ারম্যান ছিলেন। ইতোপূর্বে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যলয়ের উপাচার্য বা রেক্টর ছিলেন। মজেসের দৈনন্দিন জীবন যেন ছিল পুরোপুরি রাজনীতি এবং একাডেমিক ক্রিয়াকর্মের মিশ্রণ।

আমার ব্যক্তিগত ধারণা, একজন শিক্ষক যিনি দেশ ও মানুষের আবহমান প্রেক্ষাপটকে পাশ কাটিয়ে ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের ‘পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে’ এমন সরল তত্ত্ব বা তথ্য ছাত্রদের শেখায় এবং এর রাজনৈতিক অংশটি অর্থাৎ সত্যটি বলার জন্য কতজনের প্রাণ গিয়েছে? বা এই সত্য কাদের স্বার্থবিরোধী ছিল? তা ছাত্রদের সামনে তুলে ধরেন না, তিনি মূলত অসম্পূর্ণ আলোচনা করে থাকেন।

সুতরাং শিক্ষকতা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আদর্শিক মতাদর্শমুক্ত থাকার সুযোগ কোথায়? ব্যতিক্রম ঘটলে জাতীয় চেতনা এবং মনস্তত্ত্বে বড় রকমের অবক্ষয় সৃষ্টি হতে পারে, যা প্রথাগত রাজনীতিকরা একা সামাল দিতে পারবেন না। কারণ মতাদর্শ তৈরি ও চর্চা আলাদা হলেও বিপরীত নয় বরং সম্পূরক। তাছাড়া সমাজের অগ্রচিন্তার মানুষ হিসেবে সমাজের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতির অবয়ব সৃষ্টিতে অন্যান্য নাগরিকের মতো তাদেরও অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা দরকার।

মহামতি দার্শনিক প্লেটো যথার্থই উল্লেখ করেছেন, ‘কোনো সমাজের মেধাবীরা যদি রাজনীতিবিমুখ হয়, তাহলে সেই মেধাবীরা অপেক্ষাকৃত নিম্ন যোগ্যতার নেতৃত্ব দ্বারা শাসিত হবে।’ রাজনীতিতে মেধাবীদের দেখা যায় না, তা নয়; তবে তাদের অবস্থা কয়লা আর চিনি মেশানোর গল্পের মতো, যেখানে এক সময় চিনি গলে কয়লার সঙ্গে মিশে যায়। রাজনীতিক দলগুলোকে অধিক সংখ্যায় মেধাবীদের অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ব্যবস্থায় বদল আনতে হবে, নয়তো অবস্থানের বদল আসবে না।

আমি মনে করি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে রাজনীতি তা বাংলাদেশের প্রতিটি অগ্রসর চিন্তার মানুষের অংশগ্রহণ থাকা দরকার। এর ব্যত্যয় ঘটলে রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা সবকিছুই অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে পারে। অন্যদিকে শিক্ষকদের প্রথাগত রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে একধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে বিদ্যমান রয়েছে, সেটিও আমলে নেওয়া দরকার। তবে ধীরগতিতে হলেও সমাজে পরিবর্তন আসছে এবং আসতে বাধ্য। প্রফেসর ড. পরশ, যুবলীগের কর্ণধার হয়েছেন, এ ঘটনা তাই ইঙ্গিত করে।

কারণ জ্ঞানভিত্তিক সমাজের নেতৃত্ব- যার কাছে জ্ঞান রয়েছে, তার কাছেই থাকবে এটি অর্থনীতির চাহিদা ও সরবরাহ তত্ত্বের মতোই সত্য। রাজনীতির সঙ্গে বিদ্বান সমাজ যুক্ত থাকলে সেখানেও তুলনামূলক সমৃদ্ধি প্রতিফলিত হয়।

এরিস্টটলের মতো একজন সর্বব্যাপী শিক্ষক না থাকলে হয়তো আলেকজেন্ডার দ্য গ্রেট এর মতো একজন রাষ্ট্রনায়ক সৃষ্টি হতো না। সুতরাং অধ্যাপকদের চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বই অকল্যাণ নয়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 
Electronic Paper