স্বাধীনতার স্বপ্ন ও আজকের বাংলাদেশ
এম. রনি ইসলাম
🕐 ২:০৭ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৫, ২০২১
প্রতিটি সংগ্রামেরই যেমন নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা স্বপ্ন থাকে তেমনই আমাদের একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেরও ছিল কিছু স্বপ্ন। আমরা চেয়েছিলাম নিজেদের জন্য একটি নিরাপদ ও মানবিক সমাজ, যেখানে থাকবে না কোনো হিংসা-প্রতিহিংসা কিংবা কোনো ধরনের দমন-পীড়ন।
বাঙালির স্বাধীনতার এক পরম লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র, জনগণের মৌলিক অধিকার, বাক-ব্যক্তি, সংবাদমাধ্যম ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা। এসবকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেই আপামর জনসাধারণ সেদিন অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যে রাষ্ট্রে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত হবে পূর্ণ মানবিক মর্যাদা এবং সুযোগের সমতার ভিত্তিতে। কোনো ধর্ম-গোত্র বা অন্য কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগত বিভাজনের চেতনা তাদের মধ্যে ছিল না।
দুর্ভাগ্য হলো, বিগত পাঁচ দশকে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বড় একটি অংশ সামগ্রিকভাবে সব নাগরিকের অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করেছে, এখনো করছে। বিশ্ব ইতিহাস তার রক্তাক্ত পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করেছে, যেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বিজয় পরবর্তীকালে সেখানেই নেমে আসে দুর্ভোগ। স্বাধীনতার ফসল হিসেবে যেমন স্বাধীনতা-উত্তর দুর্বৃত্ত-দুশ্চরিত্র একটি শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, তেমনি মগজশূন্য মানুষের প্রাদুর্ভাবও ঘটতে থাকে। বিশ্ব ইতিহাসের বাংলাদেশ এটার অন্যতম অপকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। দেশটির হাজার বছরের ইতিহাস যে খুব গৌরবের, এমনটা দাবি করা যায় না।
ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে শুভর চেয়ে অশুভের দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। বাঙালির সৃষ্টিশীলতাকে তাই বারবার তলিয়ে দেয় অপসৃষ্টি। যতটা সৃষ্টি করে সে, ধ্বংস করে তার চেয়ে বহুগুণ। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো স্বাধীনতার পরই স্বাধীনতার স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করা।
এভাবে চলছে আমাদের কাল থেকে কালান্তরের যাত্রা। সেই অতীত থেকে দেখা গেছে যখনই বহির্শত্রুর আক্রমণ কিংবা ষড়যন্ত্র চলেছে এদেশে, তখনই অতি সহজে ও সস্তায় বিশ্বাসঘাতক দালালও মিলে গেছে। সেজন্যই পরাজিত হতে হয়েছে নবাব সিরাজ-উদ দৌলাকে, সন্ত্রাসীর তকমা পেতে হয়েছে সূর্যসেন, প্রীতিলতা ও তিতুমীরসহ আরও অনেক মহান ব্যক্তিকে। তাই আমাদের স্বাধীনতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, বিজয়ের ভেতর দিয়ে নীরব দাসত্ব বরণ করে নিতে হয়েছে।
বাংলা-ভূমি দখলকারী ভারতবর্ষের অন্যপ্রান্তের শক্তিই হোক, বহিরাগত আরব-ইরান-আফগান বাহিনীই হোক, চাই কি সাতসমুদ্র তের নদীর ওপারের ইংরেজ-ওলন্দাজ-ফরাসি শক্তিই হোক, তাদের পক্ষ নিয়ে মাতৃভূমির বিরুদ্ধে দালালির লোকের অভাব ঘটেনি এই দেশে। আজও দালালের অভাব নেই, বরং মাত্রাটা অধিক পূর্বের তুলনায়। বাড়িয়ে বলতে গেলে দাঁড়ায় আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা এশিয়ার যে দেশটি ঔপনিবেশিক অধীনতা ভেঙে স্বাধীন হয়েছে, সে দেশটিতে সৃষ্টি করা হয়েছে দেশ ও গণবিরোধী দালাল শক্তি। যে কোনো দেশের তুলনায় সেই শ্রেণিটি বাংলাদেশেই সংখ্যায়, শক্তিতে এবং অপকৌশল প্রয়োগ ক্ষমতায় অধিক দক্ষ। আফ্রিকা বা ল্যাটিন দেশগুলোতে পুরনো প্রভুদের সৃষ্টি করা গৃহযুদ্ধ যতটা দেশগুলোর বারটা বাজিয়েছে, গৃহযুদ্ধ ছাড়াই বাংলাদেশের গণবিরোধী দালালরা চৌদ্দটা বাজিয়ে ছেড়েছে দেশের।
ইংরেজ আমলে যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি সৃষ্টি হয়েছিল সেই সময়ে, তারাই ছিল আধুনিক জাতীয়তাবাদের ধারক। বিদেশি ইংরেজ শাসককে দেশ থেকে তাড়িয়ে স্বরাজ, স্বাধীনতা পেতে চেয়েছিল তারা। তাই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি একটি দল রক্তাক্ত সশস্ত্র সংগ্রামের পথে দেশ স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন। কূটচালের বঙ্গভঙ্গ এবং মহাকূটচালের বঙ্গভঙ্গ রদ করার ভিতর দিয়ে গোপনে যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করা হয়েছিল, কিছুদিন যেতে না যেতেই তার ফসল ফলতে শুরু করেছিল। বাঙালি হয়ে যায় হিন্দু আর মুসলমান। ইংরেজরা সফল হয় বাঙালির মধ্যে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ সৃষ্টিতে। বেঁধে যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। রক্তে ভাসে হিন্দু-মুসলিম।
বাংলা বিভক্তির জন্য দাঙ্গাটা প্রয়োজন ছিল ইংরেজদের কাছে। বাঙালির স্বাধীনতার প্রত্যাশা দখলের জন্য আরও প্রয়োজন ছিল ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নেওয়া। তাই তো তারা বাঙালি সুভাষ বসুকে ক্ষমা করেনি। আজও জাতিসংঘের যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় সুভাষের নাম রয়েছে মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তি হিসেবে। অপরপ্রান্তে পশ্চিমবঙ্গের তিতুমীরের কথা ভোলেনি ইংরেজ। ভোলেনি তার সমর্থকদের ইংরেজ বিরোধিতার কথা, সশস্ত্র লড়াইয়ের কথা। তাই হিন্দু আর মুসলমান বাঙালিকে চিরদিনের শিক্ষা দেওয়ার জন্য ইংরেজরা ভাগ করে দিল বাঙলাকে।
যে হিন্দু-মুসলমান পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজ বিতাড়নে অংশ নেয়, এমন অবস্থা সৃষ্টি করা হয়, তারা অনেকেই নিজেদের মাতৃভূমিতে চিরস্থায়ী বসবাসের অধিকার পর্যন্ত হারায়। ইংরেজের মনোভাবটা এমন যে, রাখ, দেখাচ্ছি মজা; আমাদের তাড়াচ্ছিস; আমরাই তোদের দেশছাড়া করে ছাড়ব! জয় হলো ইংরেজদের ইচ্ছার। ভাঙা দেশ নিয়ে হিন্দু-মুসলমান পেটে ঢুকে গেল হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান নামক দুই রাক্ষসের।
দাঙ্গা আর উদ্বাস্তুর অভিশাপ ওই যে শুরু, আজও তার শেষ নেই। একই ভাগ্যবরণ করতে হয় পাঞ্জাবি আর পাঠানদের। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছিল এই দুই জনগোষ্ঠী। তারই ফল রক্তাক্ত পাঞ্জাব আর দ্বিখণ্ডিত পাঞ্জাব। আর স্বাধীনচেতা পাঠানরা? গোলাম হয়ে গেল পাকিস্তানের। এই হলো ইংরেজের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের ফল। শেষ জীবনে এ নিয়ে বড় আক্ষেপ করে গেছেন পাঠান নেতা সীমান্ত গান্ধী খান আব্দুল গাফফার।
আজও পাঠানদের মুক্তি নেই। ষড়যন্ত্র করে তালেবান বানিয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া হয়েছে। তাই তাকিয়ে দেখা যাক বাংলায় হিন্দু-মুসলমান ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতা যোদ্ধাদের অবস্থাটা কেমন। মাতৃভূমি থেকে কি বিতাড়িত হতে হয়নি সূর্যসেনের বংশধরদের? মূলোচ্ছেদ ঘটে কোথায় আজ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা আর তিতুমীরের বংশধররা? এই ছিল স্বাধীনতা পিপাসু বাঙালি জাতির কপালের দুর্ভোগ।
স্বাধীনতার বদলে কেউ হলো গোলাম, কেউবা পুরাতনের বদলে নয়াদিল্লির সেবাদাস আবার কেউ ছিন্নমূল উদ্বাস্তু। সেই দাসত্ব মুক্তির প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ ঘুমিয়ে থাকলেও ১৯৭১-এ জেগে উঠেছিল পূর্ববঙ্গের মানুষ। প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, পূর্ববঙ্গ জাগলেও পশ্চিম কেন জাগেনি তখন? পশ্চিমবঙ্গ জাগেনি এ কারণে যে, ওরা গোড়া থেকেই গণতন্ত্র ভোগ করে, সামরিক স্বৈরাচার তাদের গ্রাস করেনি কখনো। অন্যদিকে বিশাল ভারত ভূখণ্ডের তুলনায় ওরা অতিক্ষুদ্র অঞ্চলের বাসিন্দা, সংখ্যায় এক শত দুই কোটির মধ্যে মাত্র নয় কোটি বাঙালি (তৎকালীন হিসাবমতে)।
ভৌগোলিক অবস্থাটাও ভাগাভাগির জন্য বড় জটিল। অথচ পূর্ববঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থান, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনসংখ্যার হিসাব, ভাষার প্রভাব, সবই ছিল পূর্ববঙ্গবাসীর আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার অনুকূলে।
তাই প্রয়োজন হয়েছিল অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। শুরু হয়েছিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। যদিও আমাদের সংগ্রামটা ছিল সামনাসামনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, কিন্তু পরোক্ষ শত্রু ছিল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা। আমেরিকার ইচ্ছার বাইরে পূর্ববঙ্গের জনগণ হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েও দমন করা গেল না তাদের। পারল না আমেরিকা। প্রকৃত অর্থে সেদিন আমাদের বিজয়টা কেবল পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই ছিল না, ছিল মার্কিনের বিরুদ্ধেও।
আমেরিকার বিরুদ্ধে বাঙালির এ বড় ক্ষমাহীন বেয়াদবি। ওরা ক্ষমা জানে না। অবাধ্যকে কীভাবে বাধ্য করতে হয় তারা তা জানে। জানে বলেই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আর সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ষড়যন্ত্রের পথে মাত্র কয়েক বছর পরেই পঁচাত্তর সালে বাঙালির স্বাধীনতার স্বাদ কেড়ে নেয়। পাকিস্তানপন্থীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার ভিতর দিয়ে তখন সাম্রাজ্যবাদ প্রতিশোধ নিয়েছিল অবাধ্য বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে।
সেই যুদ্ধ চলাকালে সব বাঙালি কি জানতেন তাদের এ যুদ্ধ কেবল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও? বামপন্থীরা জানলেও তৎকালের শাসকরা তা জানতেন না, বা জানলেও মানতে রাজি ছিলেন না। তাই তো তাদের ভিতর থেকেই অতিদ্রুত সৃষ্টি করা হয়েছিল একদল লুটেরাকে, সৃষ্টি করা হয়েছিল গণতন্ত্র অস্বীকারকারীদের। সৃষ্টি করা হয়েছিল মহাদুর্ভিক্ষ। চালের জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাগরে। ব্যাপারটা এমন- স্বাধীনতা চেয়েছিস? নে স্বাধীনতা, পেটভরে স্বাধীনতা খা।
ওই যে ইংরেজের বিরুদ্ধে অস্ত্রধরা এবং পরবর্তীকালে তারই বিশ্বস্ত তাঁবেদার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, এ যেন বাঙালি জাতির এক পবিত্র মহাপাপ! ইংরেজি ভাষাভাষীরা চলে যায়, চলে যায় উর্দু-পসতু-পাঞ্জাবি ভাষাভাষীরাও, কিন্তু দুর্গতি আর গেল না। বাঙালি তো ইংরেজ তাড়াতে পারে, পারে পাকিস্তান হঠাতে, যাকে পারে না সেই শক্তির নাম সাম্রাজ্যবাদ আর ধর্মান্ধতা। পারবেইবা কীভাবে? সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদাররা তো শুধু ইসলামাবাদ, ওয়াশিংটন আর লন্ডনে বসে নেই। ওরা আছে বাঙালির ঘরে ঘরে।
ওদের ভাষা ইংরেজিও নয়, উর্দুও নয়, ওরা কথা বলে বাংলায়। প্রতিদিন ওরা জন্মে বাঙালির ঘরে ঘরে, আঁতুড়ঘরে। তাই তো অত্যাচারী হিন্দু জমিদার পালায়, শোষক উর্দুভাষী মুসলমানও হটে যায়, হটে না কেবল দুর্ভোগ, দুর্ভোগ তো ছাড়ে না বাঙালি জাতিকে। বারবার স্বাধীন হতে হয় বাঙালি জাতিকে, কিন্তু গণতন্ত্র হাতের নাগালে পায় না কিংবা পেলেও তা শুধু গণতন্ত্রের খোলস মেলে, মেলে না গণতন্ত্র।
তাই আজ মনে বিস্ময় জাগে, স্বাধীনতা অর্জন কি পাপ ছিল আমাদের! যদি তা-ই না হবে, তবে অনিঃশেষ এই প্রায়শ্চিত্ত করে যাওয়া কেন? আজ তো আর ধর্ষক-হত্যাকারী জমিদার নেই, আছে কি কুঠিয়াল-নীলকুঠির সাদা সাহেব? ১৯৪৭ সালে কিংবা ১৯৭১ সালে বাঙালি কি ভেবেছিল, বুঝতে পেরেছিল সংগ্রাম-যুদ্ধে শত্রুকে হারালেও বিজয় তার ঘটেনি? বাঙালি কি আন্দাজ করতে পেরেছিল জমিদার আর নীলকুঠিয়াল প্রতিদিন জন্ম নেবে তার নিজেরই ঘরে? নিশ্চয়ই জানত না। জানবেইবা কেমন করে? সাতচল্লিশে খেয়েছিল ধর্মের উন্মাদ বটিকা, একাত্তরে গিয়েছিল উগ্র জাতীয়তাবাদের দাওয়াই। রোগ আর সারল না। তাই প্রশ্ন ওঠে একটি জাতি এই দুনিয়ার ইতিহাসে কয়বার স্বাধীন হয়? মাত্র একবার, একটিবার।
অথচ আমরা দু’বার স্বাধীন হলাম। একবার মুসলিম হিসেবে অন্যবার বাঙালি হয়ে। এত যে স্বাধীনতার স্পৃহা, এত যে মুক্তির স্পৃহা, এত যে মুক্তির কাঙাল, এত যে উন্মাদ, পরিণামে কী পেয়েছিলাম আমরা? গোলামির দুর্দশা তো স্বাধীনতাও তাড়াতে পারল না।
বাঙালি কি জানে তার রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে গোপনে বহমান বেঈমান, ধর্ষক, হত্যাকারী, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, টাকা পাচারকারী, ব্যাংক লুটকারী, লুটেরা ইংরেজ আর পাকিস্তানি পাঞ্জাবির অপবিত্র বীজ-বিষ? তাই তো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের রক্তের ভিতর দিয়েও উচ্ছেদ করা সম্ভব হয় না দুঃখ আর দুর্দিনকে। এটি তবে পরাজিত বিতাড়িত পরাধীনতার অভিশাপ? বাঙালি জাতি তো দৈবে বিশ্বাসী, অতিপ্রাকৃতে অবনত।
তবে কি আমাদের দুর্ভাগ্যের মূলে কাজ করেছে গ্রিক ট্র্যাজেডির ইডিপাসের পূর্ব নির্ধারিত অলঙ্ঘনীয় ভাগ্য? বাঙালি কি অজান্তে-অজ্ঞাতে ইডিপাসের মতো মাতৃ-ধর্ষক, মাতৃ সম্ভোগকারী? কবে তা ঘটেছে? সাতচল্লিশের মাতৃভূমির খণ্ডায়নের ভিতর দিয়ে কি? শোনা যায়, স্বাধীনতা নাকি মানুষকে দেবত্ব দান করে। এটাও শুনেছি স্বাধীনতা নাকি মানুষকে সর্বোচ্চ মহিমায় উন্নীত করে ঈশ্বরের সমকক্ষ করে তোলে। অথচ সবকিছু মিথ্যা করে দিয়ে স্বাধীনতা আজ বাঙালিকে পশুস্তরে নামিয়ে দিয়েছে। পশু তো পশুর মাংস খায়, পশুর প্রজনন-নৈতিক জ্ঞান নেই বলে আপন মায়ের গর্ভে সন্তান জন্ম দেয়।
সত্যিই দুঃখ হয় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় যখন রুপপুরের বালিশকাণ্ড, সরকারি হাসপাতালের পর্দাকাণ্ড, ভর্তি পরীক্ষা ও চাকরির নিয়োগের প্রশ্নফাঁস ঘটে। আমাদের স্বাধীনতা কি এসব দায়িত্বই তুলে দিয়েছে? তা না হলে এদেশে জন্মগ্রহণকারীর মুখে ইংরেজের বুলি কীভাবে উচ্চারিত হয়? সূর্যসেন কি সন্ত্রাসী? সুভাষ বসু কি ফ্যাসিস্ট হিটলারের অনুগামী? কী করে বাঙালি ব্যক্তিত্বের মহান পুরুষ বঙ্গবন্ধুকে ইসলামের দুষমন মনে করে, কীভাবেই তার বুকে বুলেট চালায়? সবই তো ইংরেজ আর পাকিস্তানিদের কণ্ঠস্বর, পাকিস্তানের আওয়াজ। তাই মনে প্রশ্ন ওঠে, তবে কি সবকিছুর মূলেই রয়েছে আমাদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দুর্ভোগ? ভারতবর্ষ ভাঙার পাপ অথবা পাকিস্তান ভাঙার গুনাহ?
এত কষ্ট, এত ত্যাগ, এত রক্তপাতের ভিতর দিয়ে যে জাতি নিজস্ব রাষ্ট্র পেল, সেই রাষ্ট্রে কী করে এত দুর্নীতি হয়? একাত্তরে সমুদ্রের চেয়েও অসীম ছিল যাদের দেশপ্রেম, তারা কী করে হয় দুর্নীতিবাজ জাতি? কারা এর পেছনে! আমাদের আজ খুঁজে বের করতে হবে কারা এর মূলে।
তাদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে। ওরা টিকে থাকলে আমাদের স্বাধীনতার শান্তির বদলে অশেষ দুঃখের বোঝা হয়েই টিকে থাকবে। কেননা স্বাধীনতার বোঝা তো পরাধীনতার বোঝার চেয়েও ভারী। স্বাধীনতার ব্যর্থতা তো পরাধীনতার গ্লানিময় রক্তক্ষরণের চেয়েও কষ্টদায়ক। তাই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে পবিত্র রাখতে প্রয়োজন সকল অসঙ্গতি ও অনিয়ম দূর করে সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয় গ্রহণ করা।
লেখক : শিক্ষার্থী, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]