ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষক ও প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

অলোক আচার্য
🕐 ২:০৭ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৪, ২০২১

প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষক ও প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষাস্তরের প্রাথমিক ধাপ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশসাধন, আচরণিক পরিবর্তন, সামাজিক মূল্যবোধের প্রাথমিক স্তর শুরু হয় প্রাথমিক স্তর থেকেই। শিশুদের এই ইতিবাচক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এই স্তরে নিয়োজিত শিক্ষকরা। অন্য যেকোনো স্তরের চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। এই স্তরের প্রকৃতির কারণেই চ্যালেঞ্জ থাকে। এখানে যাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হয় তারা শিশু।

সামাজিকীকরণের শুরুতে থাকে। তারা শিক্ষা স্তরের প্রাথমিক ধাপ অতিক্রমের পর্যায়ে থাকে। এই শিক্ষাই পরবর্তী সময়ে তার ভেতর প্রবাহিত হয়। প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষক মান উন্নয়নে উপকরণ, ডিজিটালাইজেশন এবং প্রশিক্ষণসহ নানামুখী কার্যক্রমের মাধ্যমে আধুনিকায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে আগের চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন ঘটেছে। তারপরও প্রাথমিক শিক্ষা কাক্সিক্ষত অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য করার উদ্যেগ গ্রহণ করেছে। মানুষের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ধারণা বদলেছে এবং আগ্রহ বেড়েছে। ইতোমধ্যেই স্কুল ড্রেস বাবদ টাকা শিক্ষার্থীরা পেয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার চাপও কমবে, উপবৃত্তি প্রদান এবং স্কুল ফিডিং এর কার্যক্রম হাতে নেওয়া।

দেশের লাখ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থীর জন্য এতসব নিশ্চিত করা যে বিশাল একটি চ্যালেঞ্জ সেকথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু এর সবগুলোই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে এবং এর গুণগত মানকে আরও বেশি কার্যকর করে তুলবে। এতদিন বছরের শুরুতে নতুন বই নিয়ে আনন্দে বাড়ি ফিরত শিক্ষার্থীরা। এখন তার সঙ্গে স্কুলের পোশাকও হাতে পায় তাহলে আনন্দের মাত্রা যে আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় একটি বড় পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এই পরিবর্তন তখনই কার্যকরী সুফল বয়ে আনবে যখন এর সঙ্গে লেখাপড়ার মান নিশ্চিত করা যাবে। দেশে অলিতে গলিতে,বিল্ডিংয়ের কোনায় ব্যঙের ছাতার মত কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠছে। এসব হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন নিয়ন্ত্রণে কোন নজরদারি নেই। যেখানে যেমন ইচ্ছা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এত সুযোগ সুবিধা দেওয়া সত্তেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। কারণ ফলাফলে কিন্ডারগার্টেনগুলোই এগিয়ে থাকে। ফলে অভিভাবকদের আগ্রহটাও থাকে এসব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে।


প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শিক্ষকদের জীবন। এই মানুষগুলোর হাতেই শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন নির্ভর করে। শিক্ষা উপকরণ, উপাদান বা পদ্ধতি সবকিছুর সফলতা নির্ভর করে শিক্ষকদের ওপর। ফলে তাদের জীবনযাত্রার দিকে লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। সেক্ষেত্রে প্রথমেই আসে তাদের প্রাপ্ত গ্রেডের প্রসঙ্গ। সম্প্রতি তাদের বেতন গ্রেডের উন্নয়ন হয়েছে। আগে প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ বিহীন যথাক্রমে ১৪ ও ১৫তম গ্রেডে বেতন পেত। এখন তা ১৩তম গ্রেডে উন্নীত হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক। কিন্তু দেখতে হবে এখানে প্রাথমিক শিক্ষকদের যোগ্যতার পুরোপুরি মূল্যায়ন হবে কি না। এখনও কিন্তু প্রাথমিকের শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীই রয়ে গেছেন।


অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের ভিআইপি মর্যাদা দেওয়া হয়। অনেকে বলতে পারেন শিক্ষক অন্য পেশা থেকে ভিন্ন। ফলে অন্য পেশার সঙ্গে মেলানো উচিত হবে না। তবে বিনীতভাবে বলতে পারি, এই পেশা থেকেই তার সংসার বাহিত হয়, শিক্ষার বিশ্লেষণ হয় এবং তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়। উল্লেখ্য, ইউনিয়ন পরিষদ সচিবদের স্নাতক যোগ্যতায় ১৪তম থেকে ১০ম গ্রেডে, কৃষি উপ-পরিদর্শকদের যোগ্যতা এসএসসি ও চার বছরের কৃষি ডিপ্লোমায় ১০ম গ্রেড এবং এরকম আরও আছে। তাহলে প্রাথমিকে শিক্ষকরা সর্বোচ্চ যোগ্যতাধারী হয়েও দশম গ্রেডে কেন বেতন পাবেন না? তাদের দুর্বলতা কোথায়। প্রশ্ন হলো, যোগ্যতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়নের।

বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সময় এই ভিন্নতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এমনকি মাধ্যমিকে একজন সিনিয়র শিক্ষক এবং প্রাথমিকের একজন সিনিয়র শিক্ষকের ভিতর এবং একই যোগ্যতায় অন্য কোনো যোগ্যতার মধ্যে এই পার্থক্য বেশ চোখে লাগে। কোনো নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করা একজন মেধাবী ছাত্রছাত্রী কেন স্বেচ্ছায় প্রাথমিকে চাকরি করবে যদি তাকে সেখানে যোগ্য সম্মান দেওয়া না হয়। তাকে কেন তৃতীয় শ্রেণির চাকরিতে যোগ দিতে হবে? মুখে যতই বলি প্রাথমিকেই মেধাবীদের আনতে হবে। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব হবে তা নিয়ে আলোচনা হলেও ফলপ্রসূ হয়নি আজও। এখানে প্রধান শিক্ষক পান ১১তম গ্রেড। এখানেও সেই বৈষম্য। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীÑ এই দুর্দশা থেকে তাদের মুক্তি দেওয়ার সময় এসেছে। সবকিছুর সঙ্গে যদি আধুনিকায়ন করতেই হয় তবে এখানেও পরিবর্তন করতে হবে। এই ক্ষেত্রে যারা সর্বোচ্চ যোগ্যতাধারী তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা জরুরি।


এখন প্রাথমিকে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ডিগ্রি পাস করা হয়েছে। তবে মাস্টার্স শেষ করে আসছেন বহু শিক্ষক। ফলে এরা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং মেধাবী। একসময় প্রাথমিকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস থাকলেও এখন সে সুযোগ নেই। যোগ্যতার মূল্যায়ন প্রতিটি চাকরিজীবীই আশা করে। সেক্ষেত্রে একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় যদি অন্য চাকরিতে ১০ম গ্রেড পেলে প্রাথমিক শিক্ষকদেরও তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষাই আমাদের লক্ষ্য। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে যোগ্যতার মাপকাঠি সকল ক্ষেত্রে এক করতে হবে।


প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রাথমিকের জন্য এই সময়সূচি দীর্ঘ বলেই মনে হয়। এই সময়সূচি পরিবর্তনের দাবি রয়েছে শিক্ষকদের। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি। এত দীর্ঘ সময় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখা কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে পুনর্বিবেচনা হওয়া দরকার। যেখানে শিক্ষার অন্য স্তরের সময়সূচি এর চেয়ে কম। অপরদিকে দেশের কিন্ডারগার্টেনের সময়সূচি সকালে। দুপুর বারোটার আগেই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা বাড়িতে ফেরে। এসব ছাত্রছাত্রীরা যখন খেলাধূলা করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্কুল শুরু করে। সময়টা নিয়ে দেশের শিক্ষাবিদরা একটু গবেষণা করতে পারে বলে আমি মনে করি। একটু কমানো বা সময়সূচিকে নতুন করে করা যেতে পারে। শিক্ষকদের বেতন গ্রেড সমন্বয় নিয়ে চলতি বছর আলোচনা হয়েছে। শিক্ষকদের পদোন্নতির বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে।


একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে যখন যোগদান করেন তখন তাদের ভেতর পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষক বা সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে বা তার থেকেও বড় পদে চাকরির আশা করতে পারেন। কারণ অন্য সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ যতটা রয়েছে এখানে ততটা নেই। সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকে উন্নীত হলেও সেই প্রক্রিয়াও খুব দীর্ঘ। একজন শিক্ষক সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর যেন নির্দিষ্ট সময় পর প্রধান শিক্ষক এবং কমপক্ষে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পর্যন্ত যেতে পারে সেপথ সুগম করতে হবে। এতে যা হবে তা হলো চাকরির প্রতি দায়িত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং একটি লক্ষ্যে অগ্রসর হবে। প্রাথমিক শিক্ষাস্তর সকল শিক্ষাস্তরের ভিত্তি।

সরকার এই স্তরকে শক্তিশালী করতে সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি গুণগত মান উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। সরকার আন্তরিক আর সেই সঙ্গে তাদের আন্তরিক হতে হবে যারা এই শিক্ষাদানের সঙ্গে জড়িত এবং নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। সেই সঙ্গে এই গুরুত্বপূর্ণ স্তরে যারা কাজ করেন তাদের ভালো-মন্দ, পূর্ণতা-অপূর্ণতাও কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় নিতে হবে। উপরের অপ্রাপ্তির বিষয়গুলোর সঙ্গে রয়েছে টিফিন ভাতা। মাসিক ২ শ’ টাকা টিফিন ভাতা বরাদ্দ রয়েছে। জাতীয় শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জাতীয় বেতন স্কেল-২০০৯ থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা টিফিন ভাতা বাবদ মাসিক ১০০ পেতেন।

২০১৪ সালের জাতীয় বেতন স্কেলে এই ভাতা বাড়িয়ে ১৫০ টাকা করা হয়। এরপর সর্বশেষ অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে এই ভাতা ২০০ টাকা করা হয়। প্রতিদিন সে হিসেবে গড়ে ছয় টাকার সামান্য বেশি টিফিন ভাতা হয়। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে বর্তমান প্রাথমিকের সময়সূচিতে দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে অবস্থান করে যে টিফিন ভাতা দেওয়া হয় তা অত্যন্ত অসম্মানজনক। বর্তমানে একটি শিঙ্গাড়া খেতেও নূন্যতম ৫ টাকা খরচ হয়। ’টিফিন ভাতা’ নামে যে বরাদ্দ রয়েছে তা পরিবর্তন আবশ্যক।


প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে গত কয়েক দশকে শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষকদের জীবনমান, শিক্ষার্থী উন্নয়ন বহুগুণে বদলে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিবর্তন অব্যাহত থাকবে। কিন্তু সবকিছুর সঙ্গেই শিক্ষকদের চাকরি এবং চাকরির সঙ্গে জড়িত থাকে। সেখানে উন্নয়ন শিক্ষকের মানসিক প্রশান্তির কারণ হয়। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ডিজিটাল করার লক্ষ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর পৌঁছে দিয়েছে। সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। বিনা বেতনে লেখাপড়া করার সুযোগ ছাড়াও উপবৃত্তিও দেওয়া হয়।

এছাড়াও প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণসহ আরও সুযোগ সুবিধা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে। এমনটা দেখা যায় যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানরা প্রায়ই এলাকার নামীদামি কোনো কিন্ডারগার্টেনে লেখাপড়া করে। সবাই না তবে এই হারটাই বেশি হবে। তাহলে নিজের সন্তানকে যদি নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে দিতে আস্থা না থাকে তাহলে অন্য অভিভাবকদের দোষ দিয়ে লাভ কী? এটা একটা কারণ মাত্র কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের আস্থা অর্জন করতে হলে প্রথমে নিজেকেই করে দেখাতে হবে। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে এটা করতে হবে।


প্রাথমিক শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর এ কথা সবাই স্বীকার করেন। সেক্ষেত্রে এই ক্ষেত্রে যে অসঙ্গতিগুলো রয়েছে তা দূর করতে হবে। শিক্ষকদের চাকরির সন্তুষ্টি অর্জন ও তাদের কষ্টের জায়গাগুলোতে পর্যায়ক্রমে পূর্ণ করতে হবে। মেধাবী শিক্ষক টানতে শিক্ষকদের গ্রেড অন্য চাকরির সঙ্গে সামাঞ্জস্য করা, পদোন্নতি প্রদান, টিফিন ভাতা এবং বিদ্যালয়ের সময়সূচির পরিবর্তনে গুরুত্বারোপ করতে হবে।

লেখক : মুক্তগদ্য লেখক, পাবনা
[email protected]

 
Electronic Paper