ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পশু-পাখি মানুষের শত্রু নয়

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
🕐 ১:৫৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৪, ২০২১

পশু-পাখি মানুষের শত্রু নয়

দেশের পার্বত্য অঞ্চল, শেরপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় সম্প্রতি অনেকগুলো হাতি মারা গেছে। বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে হাতি হত্যা করা হয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। পাশাপাশি উদ্বেগের বিষয়।

বুনো হাতি হত্যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা হাতির যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দিয়েছি। হাতির পথ আগলে রোহিঙ্গারা বসতি স্থাপন করেছে। রোহিঙ্গারা টেকনাফ ও উখিয়া এলাকার প্রায় ৪ হাজার একর বনাঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কেবল বন ধ্বংস নয়। পরিবেশের চরম বিপর্যয়ের মুখে। যার সুসূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব গোটা চট্টগ্রাম অঞ্চলে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে রোহিঙ্গারা গাছ কেটে নিয়ে আসছে। সংবাদপত্রে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে। বন বিভাগের সর্বশেষ জরিপে বলা হয়েছে বন্য হাতির সংখ্যা ২৬৮টি। এর মধ্যে ৬৭ টি বয়স্ক, ১৭২টি মহিলা ও ২৯টি বাচ্চা হাতি রয়েছে। এছাড়া ১০০টির মতো অভিবাসী হাতি এবং ৯টি পোষা হাতি রয়েছে। সরকারি অনুমতি নিয়ে হাতি পোষা যায়। হাতির বাচ্চা হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়। বিক্রির বেলায় তাদের জানানো নিয়ম।

১৯৮০ সালে বাংলাদেশে বন্য হাতি ছিল ৩৮০টি। বাংলাদেশে হাতির স্থায়ী আবাসস্থল হলো চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, চন্দনাইশ, বাঁশখালী, রাঙ্গুনিয়া, কাসিরখালী, রামু, উখিয়া, আলীকদম, কাউখালী, কাপ্তাই, লংগদু ইতাদি এলাকা।
আবাসস্থল ধ্বংস, খাদ্যের অভাবে বন্য হাতি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। ফসল নষ্ট করে। আমরাই ওদের আবাসস্থল ধ্বংস করেছি। বাড়িঘর, সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ওরা বাধ্য হয়েই লোকালয়ে আসে। আগে এমন আসত না। এক দশক আগে বন্য হাতি লোকালয়ে হামলা করেছে, এমন খবর খুঁজে পাওয়া কঠিন। হাতির প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতা সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ফাঁদ পেতে বেশ কিছু হাতি হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে বাচ্চা হাতি রয়েছে। ধারণা করা হয়, বৈদ্যুতিক ফাঁদে জড়িয়ে তাদের মৃত্যু হয়।

গত এক বছরে শ্রীবরদী উপজেলায় ৭টি হাতি হত্যা করা হয়েছে। জেনারেটেরের ফাঁদ পেতে হাতিগুলোকে হত্যা করা হয়। অথচ হত্যা না করেও হাতি তাড়ানো সম্ভব। যেমন শস্য খেতের পাশে মৌমাছির চাক দেওয়া, ইনফ্রাসাউন্ড ব্যবহার করা। এতে এমন মৃদু তরঙ্গে শব্দ সৃষ্টি করা হয়। যা মানুষ শুনতে না পেলেও হাতি কানে খুব জোরে লাগে। হাতি তাড়াতে টিনের টুকরো আর গুনা তারের (লোহার শক্ত তার) মতো ঝুলিয়ে রাখলেও কাজ হয়। হাতির সঙ্গে তারের স্পর্শ লাগলে টিনগুলো ঝনঝন করে বেজে উঠে। হাতি ভয়ে পালিয়ে যায়। এমন অভিনব উপায়ে হাতি তাড়াতে সফল হয়েছে ভারতের জলপাইগুড়ি এলাকার মানুষ। দূর থেকেই হাতির চলাচলের ওপর নজর রাখার জন্য উঁচু গাছ বা টাওয়ারের ওপর স্থাপিত পর্যবেক্ষণ ক্যাম্প ওয়াচ টাওয়ার এগুলোর মধ্যে একটি। কাঁটাযুক্ত এবং ছোট ছোট বীজ আছে এমন গাছ বা উদ্ভিদ হাতি এড়িয়ে চলে।

এ ধরনের গাছপালা দিয়ে ফসলের জমি ঘেরাও দিয়ে রাখলে এতে হাতির আক্রমণের আশঙ্কা অনেক কমে যায়। একইভাবে চাষিরা হাতির অপছন্দের শস্যগুলো চাষ করলে হাতির আক্রমণের হার কমে যাবে। ট্রিপ অ্যালার্ম স্থাপন পদ্ধতি বা একটি ধাতব তারে ঘণ্টা বা অ্যালার্ম লাগিয়ে বনের সীমানার গাছগুলোতে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই সীমানা অতিক্রম করতে গেলেই হাতির সংস্পর্শে এসে তারটিতে টান পড়ে উচ্চস্বরে ঘণ্টা বেজে ওঠে। চিলি রোপ বা চিলি স্মোক পদ্ধতিতে একটা মোটা দড়িতে আঠালো কিছু জিনিসের সঙ্গে মরিচের গুঁড়া মেখে ফসলের খেতের চারপাশে এমনভাবে রেখে দিতে হবে, যাতে বাতাসের তোড়ে বনের দিকে মরিচের ঝাঁজটি যায়।

হাতি যখনই বন থেকে খেতের দিকে আসবে, তখন তার নাকে মরিচের ঝাঁজ গেলে সে আর এই মুখী হবে না। অবশ্য বন্যপ্রাণী বিশেষ করে হাতির মতো বড় যেসব প্রাণী, সেগুলো সুরক্ষায় আমাদের সক্ষমতা শূন্যের কোঠায়। হাতি গর্তে পড়লে, আহত হলে তার সুচিকিৎসা করতে আমাদের ব্যর্থতা চোখ এড়ানোর মতো নয়। গেল বছর বন্যায় ভারত থেকে বন্য হাতি ঢুকে পড়েছিল দেশে। অনেকদিন তৎপরতা চালিয়েও সেটিকে আমরা বন্দি করতে পারিনি। শেষমেশ হাতিটি মর্মান্তিকভাবে মারা যায়। চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসায়, একাধিক ইনজেকশনে হাতিটির মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ আছে।

বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে হাতি হত্যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। দুঃখজনক বিষয়, কোথাও স্থানীয় প্রশাসন অবৈধ ফাঁদ উচ্ছেদে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। ফাঁদ যারা পাতে তাদের ধরা হচ্ছে না। যদিও থানা নির্বাহী অফিসাররা ব্যবস্থা নিচ্ছেন এমন দায়সারা বক্তব্য দিয়ে থাকেন। বন বিভাগ মৃত হাতির ময়নাতদন্ত আর মাটিচাপা দিয়েই ক্ষান্ত হয়।

দেশের আইনে বন্যপ্রাণী হত্যা দণ্ডনীয় অপরাধ। বন্যপ্রাণী সংরক্ষন আইন ২০১২-তে বলা হয়েছে- বাঘ, হাতি হত্যা করলে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং এর সঙ্গে ৭ বছরের জেল হতে পারে। অন্য সব বন্যপ্রানী হত্যা করলে সবোচ্চা ১ লাখ টাকা জরিমানা এবং ১ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আইন থাকলেও তার প্রয়োগ কতটা হচ্ছে সেটাই প্রশ্ন। ঢাকার আইইসিএন-এর সাবেক আবাসিক প্রতিনিধি নিশাত-এর মতে, আবাসস্থল ধ্বংস, চলাচলের পথ বা কলিডোর বাধাগ্রস্ত, হাতির চলাচলের পথে বসতি স্থাপনের কারণে বুনো হাতির তাণ্ডব বেড়ে গেছে। বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬ বছরে ৫৪টি হাতি মারা গেছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই মারা গেছে মানুষের হাতে। আর এ সময়ে হাতির আক্রমণে ১৩৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ সময়ে হাতি হত্যার ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ১৪টি। তবে একটি মামলাও নিষ্পত্তি হয়নি, কেউ সাজা পেয়েছেন এমন নজিরও নেই।

হত্যা নয়। কৌশলে বুনো হাতি তাড়াতে হবে। পাশাপাশি আবাসস্থল যা আছে সেগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। হাতি থাকবে বনের মধ্যে। অথচ বন কেটে মানুষ বাড়িঘর তৈরি করেছে। পুকুর কেটে মাছ চাষ করেছে। প্রশ্ন হলো, হাতি তাহলে যাবে কোথায়? সরকারি জায়গায় এসব হলেও দেখার কেউ নেই। তবেই হাতির তাণ্ডব কমতে পারে। মনে রাখতে হবে, হাতি কখনই মানুষের শত্রু নয়। মানুষের শত্রু ছিল না।


বিপন্ন সুন্দরবনের পাখি
বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বিভিন্ন ধরনের পশু-পাখি রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের কিছু এলাকাকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে সুন্দরবন। ঝড়, বন্যা থেকে রক্ষা করে। মধু, গোলপাতা, মাছ ধরাসহ বিভিন্ন কাজে লক্ষাধিক মানুষ কাজ করে। জীবিকা নির্বাহ করে। সুন্দরবনকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা গড়ে উঠেছে। পর্যটকদের অন্যতম প্রধান পছন্দ সুন্দরবন। কেবল প্রকৃতিক দিক দিয়েই নয়। অর্থনীতিকভাবে সুন্দরবনের ভূমিকা অনেক বড়।

সুন্দরবন আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ। সুন্দরবনে বিভিন্ন ধরনের পাখি রয়েছে। যেমন- মদন টেক, মাছরাঙ্গা, তিলানাগ ঈগল, শিকরে, টুনটুনি, চিল, বক, সারস প্রভৃতি।

সুন্দরবনে যে সব পাখি বাস করে এদের মধ্যে বেশির ভাগই মৎস্যভোজী পাখি। এর কারণ হল সুন্দরবনে কোনো শস্য খেত নেই। গত কিছুদিন ধরে আশঙ্কাজনকভাবে পাখির সংখ্যা কমে গেছে। সুন্দরবনে আগে দেখা যেত এমন অনেক পাখিই এখন দেখা যায় না। কমে গেছে পাখি কলরব। এমনটা হওয়ার জন্য প্রধানত দায়ী কিছু লোভী মানুষ। যারা বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করে। বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারে শুধু পাখি নয়। গোটা সুন্দরবন বিপদগ্রস্ত। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। কারণ এখানে একটি প্রাণীর সঙ্গে অন্য প্রাণীর জীবন জড়িত। বিষযুক্ত পানি খেয়ে মাছ মারা যায়।

বিষওয়ালা মাছ খেয়ে পাখি মারা যায়। পাখি মারা গেলে বনে ক্ষতিকারণ পোকামাকড় বেড়ে য়ায়। ক্ষতিকর পোকা গাছের পাতা নষ্ট করে। গাছের পাতা হরিণ খায়। পাতা কমলে খাদ্যের অভাবে হরিণের সংখ্যা কমে যাবে। ফলে বাঘের খাদ্য সংকট দেখা দেবে। সুন্দরবনের মধ্যে ছোট ছোট অসংখ্য খাল আছে। এই সব খালে বিষ প্রয়োগ করা হয়।

ফলে ছোট বড় সব মাছ মারা যায়। সামান্য কিছু মানুষ লাভবান হয়। তবে পুরো বন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বন যারা দেখভাল করেন। তারা যদি একটু তৎপর হন তাহলেই এই রকম সর্বনাশা কাজ কমতে পারে। সরকার এই বিষয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। এমনটাই সুন্দরবনপ্রেমীদের প্রত্যাশা।


লেখক : বন, পরিবেশ, পশু ও পাখিবিষয়ক লেখক।
[email protected]

 
Electronic Paper